একজন শিক্ষার্থী চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত ফলাফলে মানবীয় ত্রুটি থাকতে পারে। এ ভুল ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত দুই রকমই হতে পারে। পরীক্ষাকালীন পরীক্ষক, পরবর্তীকালে টেব্যুলেশন, কম্পিউটার অপারেটর—যেকোনো স্তরেই তা হতে পারে। মানবীয় ভুলের কারণে কোনো শিক্ষার্থীর প্রাপ্য ফলাফল সন্দেহজনক হলে তাঁর বিরুদ্ধে একজন শিক্ষার্থী প্রতিকার পাওয়ার বিষয়টি বর্তমান সময়ে একরকম রুদ্ধই বলা যায়। উত্তরপত্র পুনঃপরীক্ষণ, নম্বর পুনর্গণনা ইত্যাদির পক্ষে রক্ষাকবচ তৈরির বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। সংক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীর অধিকার সংরক্ষণ ব্যতীত সুবিচার নিশ্চিত হয়েছে, তা বলা যায় না। যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে কোনো শিক্ষার্থী তার ফলাফল চ্যালেঞ্জ করতে চাইলে সে বিধান গুরুত্বসহকারে সন্নিবেশ করা প্রয়োজন। তা না হলে এখানে একজন শিক্ষার্থীর অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। ওপরে উল্লিখিত সব কটি বিষয়ে যেকোনো শিক্ষার্থী বোর্ডে আবেদন করে যথাযথ প্রতিকার না পেলে কিন্তু আদালতে যেতে পারে। এ বিষয় মাথায় রেখে ভবিষ্যতে নীতিমালাগুলো সংশোধন প্রয়োজন।
উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর ভর্তি নীতিমালা
এ প্রবন্ধের শেষাংশে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ভর্তি নীতিমালার সুনির্দিষ্ট দুটি অংশ প্রত্যাহারের আবেদন করছি। আইনের দৃষ্টিতে এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা লাভে সব নাগরিকের প্রতি সমান আচরণ এ দেশের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। এ নীতিমালায় এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন রয়েছে। এ নীতিমালার আড়ালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অধস্তন দপ্তরের কয়েক শত কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের একটি বিশেষ সুবিধাভোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠার অপতৎপরতাকে নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভর্তি নীতিমালায় কোটাপদ্ধতি বা আসন সংরক্ষণ বিষয়ে যে বিধান, বিশেষ করে মন্ত্রণালয়সহ অধস্তন সরকারি কর্মকর্তাদের পোষ্যদের জন্য ২ শতাংশ আসন সংরক্ষণ সংবিধানের সমতা ও সমাজের অনগ্রসর জনগণের বিশেষ সুবিধা প্রদান নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কেউ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড, অন্য কোনো শিক্ষাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুবাধে বিশেষ কোটায় ভর্তির সুযোগ নেওয়া সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। তা ছাড়া বর্তমান সময়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের জন্য ৫ শতাংশ কোটাও পুরোপুরি যৌক্তিক নয়। ১৯৭১ সালে যিনি ১৭-১৮ বছরের কিশোর বা যুবক, তিনি এখন ৫৯ থেকে ৬১ বছর বয়সী। তাঁদের মধ্যে কারও কারও সন্তান এখন উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তিযোগ্য থাকতে পারে। তবে সে সংখ্যা দেশের মোট ভর্তিযোগ্য আসনের ৫ শতাংশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ-জাতীয় কোটা প্রথায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা উপকৃত হন খুবই কম এবং এটি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান ও স্বীকৃতির প্রকৃত ক্ষেত্রও নয়। ভর্তিতে কোটা, চাকরিপ্রাপ্তিতে কোটা, পদোন্নতি ও অবসরে কোটা—এগুলো সমাজের সামগ্রিক ভারসাম্য নষ্ট করে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি ও সম্মানের ব্যবস্থা করে অসচ্ছল, অক্ষম ও দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্মানজনক ভাতার বন্দোবস্ত করা যায়। তাই ভর্তিব্যবস্থায় এ-জাতীয় কোটা প্রথা রহিত হওয়া উচিত। তবে গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুযোগ-সুবিধাগত বৈষম্যের কারণে বিভাগীয় সদরের বাইরের শিক্ষার্থীদের বিভাগীয় শহরের মহাবিদ্যালয়ে আসন সংরক্ষণ করা যৌক্তিক। তাই অন্তত একটি বছর হয়তো মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং বিভাগীয় শহরের বাইরের শিক্ষার্থীদের জন্য কোটাব্যবস্থাটি বহাল রেখে ২০১৪ সালের ভর্তির নীতিমালায় কোটা প্রথা সম্পূর্ণ রহিত করা উচিত। বিশেষত, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর পোষ্যদের কোটা এই মুহূর্তেই প্রত্যাহার করা উচিত। এই নীতিমালার দ্বিতীয় আপত্তিকর স্থান হচ্ছে, কলেজ পরিবর্তন-সংক্রান্ত বিধান (৭.২)। সরকারি কর্মকর্তার বদলির কারণে সংগতভাবে বদলি করা এলাকায় তাঁদের পোষ্যদের ভর্তির সুযোগ বাধা-বন্ধনহীন করা হোক। তাতে কোনো আপত্তি অবান্তর। কিন্তু শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই কি বদলির চাকরি করেন? বেসরকারি ব্যাংক-বিমার কর্মকর্তা-কর্মচারী, তাঁরাও তো বদলির চাকরি করেন। তাঁরা বদলি হলে তাঁদের পোষ্যরা কেন সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন? একজন ব্যক্তির বাড়ি রংপুর হলে তিনি তো চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি চাকরিতে যোগ দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তিনি কেন সে সুযোগ পাবেন না। কাউকে সরকারি চাকরি প্রদান করার সময়, সরকার কি এমন কোনো চুক্তি করেছে যে সরকারি চাকরিতে অনুগ্রহপূর্বক যোগ দেওয়ার কারণে ভবিষ্যতে ফ্ল্যাট, প্লট, বাড়ি, গাড়ি, পোষ্যদের ভর্তি, চাকরি—সব ব্যাপারে আপনাকে সাধারণ একজন নাগরিকের তুলনায় বাড়তি কিছু অগ্রাধিকারভিত্তিক সুবিধা দেওয়া হবে। এ দেশে সেবা ও সুযোগের নিয়ন্ত্রণে যাঁরা আছেন, সে সুযোগটি তাঁরা প্রথমে গ্রহণের পর অন্যদের প্রশ্ন আসছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজেরা বিধান করে পোষ্য কোটাব্যবস্থা তৈরি করে নিয়েছে। দেশের জাতীয় সংসদের সদস্যরা সরকারি প্লট বা জমি দরখাস্ত করলেই প্রাপ্তি নিশ্চিত। এখানে কোটার প্রশ্ন নেই। তারপর সরকারি কর্মচারী, বিচারপতি, আইনজীবী, সাংবাদিক, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী এভাবে সরকারি সম্পদ কিছু সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে আইন করে বণ্টন করা হচ্ছে, সাধারণের প্রবেশাধিকার সংকুচিত করেই। সুবিধাবঞ্চিত ও সমাজের অনগ্রসর অংশের জন্য কোটা সৃষ্টির বিধান সংবিধানে রাখা হয়েছে, কিন্তু সুবিধাভোগীর জন্য আরও সুবিধা দান এবং সুবিধা সংরক্ষণ পুরোপুরি সংবিধানের লঙ্ঘন। আশা করি, ভবিষ্যতে নীতিমালার নামে এ-জাতীয় অনৈতিক পদক্ষেপ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিরত থাকবে।
ভর্তি নীতিমালায় পরীক্ষা গ্রহণ ব্যতীত ভর্তির যে বিধান, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করে নটর ডেম কলেজ কর্তৃপক্ষ উচ্চতর আদালতে রিট আবেদন করেছে। উচ্চতর আদালত শুধু নটর ডেম কলেজের ক্ষেত্রে এ নীতিমালার কার্যকারিতা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে আদেশ জারি করেছেন। আশা করি, মাননীয় আদালত ভর্তি নীতিমালার ৩.২ এবং ৭.২ এর অসাংবিধানিক বিষয়টি ও ছয় মাস পর পূর্ণাঙ্গ শুনানি বা রায়ের সময়ে বিবেচনায় গ্রহণ করে দেশে আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিকের সমান আচরণ ও সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকারকে সমুন্নত রাখতে স্বতঃপ্রবৃত্ত পদক্ষেপ নেবেন।
অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ: সাবেক শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।