গণমাধ্যমের সুবাদে জানতে পেরেছি, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের কিছু অগ্রহণযোগ্য ও অসংস্কৃত মন্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন। আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেই বলে মুরাদ হাসানের ফেসবুক লাইভের ভিডিও ও অডিওর বক্তব্য সম্পর্কে অবগত নই। কিন্তু সমাজসচেতন ব্যক্তি ও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে এ বিষয়ে কথা বলার দায় আমার ওপর বর্তেছে। যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন, তাতে ধরেই নিচ্ছি যে তাঁর বক্তব্য ও আচরণ অত্যন্ত গর্হিত ও ন্যক্কারজনক।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্ন আমার মনে জেগেছে তা হচ্ছে, এ ধরনের উক্তি যিনি করতে পারেন, এমন এক ব্যক্তি মন্ত্রীর আসনে আসীন হলেন কী করে? এটা সত্য যে আওয়ামী লীগ একটা বিশাল দল এবং বাংলাদেশের প্রাচীন দলগুলোর অন্যতম। এ দলে নানা সময়ে নানা ধরনের ব্যক্তি যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের সবাই আওয়ামী লীগের আদর্শ ও উদ্দেশ্য অনুধাবন করে যোগ দিয়েছেন, সেটা না-ও হতে পারে। বিশেষ করে এখন আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। ফলে দলে এমন অনেকেই নাম লেখাতে পারেন, যাঁদের ভিন্ন উদ্দেশ্যও রয়েছে।
কিন্তু দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা অন্তত এটুকু বিবেচনায় রাখবেন যে এমন কোনো ব্যক্তিকে ক্ষমতায়িত করা হবে না, যাঁর আচরণের কারণে দল ও দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে এবং সেই ব্যক্তির আচরণের জন্য দলের নেতাদের বিব্রত হতে হয়, নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক প্রশ্ন রয়েছে। যাঁদের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব, তাঁদের এ ব্যাপারে যথেষ্ট দায়িত্বশীল হতে হয় এই ভেবে যে এমন কোনো ব্যক্তির হাতে দেশের ও দেশের মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণের ভার তুলে দেবেন কি না। আলোচ্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলতেই হয়, এখানে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। আমি আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলো নৈতিক এ বিষয়টা বিবেচনায় নেবেন। দেশ, দল ও মানুষের জীবন এ ধরনের অর্বাচীন ব্যক্তির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ যেন সৃষ্টি না হয়।
আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করি, কোনো কোনো রাজনীতিকের এ ধরনের নিম্ন রুচির বক্তব্য আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেন রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। তবে আমরা স্বস্তি পেয়েছি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আলোচিত ব্যক্তিকে প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন। কিন্তু এখানেই বিষয়টা শেষ হতে পারে না। আমি যতটুকু জেনেছি, আলোচিত ব্যক্তি যে আচরণ করেছেন, তা আমাদের ফৌজদারি আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। আমি আশা করব, তাঁকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের আইনের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
গণমাধ্যম সুবাদে আমি জেনেছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ, নারীবিদ্বেষী, বর্ণবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়েছেন। আমি মনে করি, রাষ্ট্রের অন্য যে আইনে সেটা অপরাধ বলে চিহ্নিত, সেই আইনের আওতায় তাঁর বিচার হওয়া উচিত। যে নৈতিক স্খলনের কারণে আলোচিত ব্যক্তিকে প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে, সেই একই কারণে সাংসদ থাকার নৈতিক অধিকারও তিনি হারিয়েছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ তাদের এই সদস্যের অসদাচরণ ও নৈতিক স্খলনের দায় বহন করে তাঁকে সদস্য হিসেবে রাখবে কি না, সেটাও ভেবে দেখবে বলে আশা করি।
আমি আলোচিত ব্যক্তির আচরণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। তাঁর পরিণতি দেখে অন্য রাজনীতিকেরাও বার্তা পাবেন। সমাজ ও দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যাঁরা নেন কিংবা যাঁরা নিতে ইচ্ছুক, তাঁদের এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রী ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিয়েছেন, সেখান থেকে জনগণ আশ্বস্ত বোধ করছেন যে নীতিনির্ধারকদের নৈতিক স্খলনের কারণে কখনো কখনো জবাবদিহি করতেই হয়।
সুলতানা কামাল, মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা