কোভিডের আঘাতে সব দেশের অর্থনীতিই সংকুচিত হয়েছে। সংকোচন কমিয়ে আনতে রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যক্তির হাতে ও ব্যবসায় সরাসরি অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে চাহিদা বাড়ানোর নীতি নিয়েছে। প্রশ্ন হলো নীতি-কৌশল প্রণয়নে বাংলাদেশে কী ধরনের অনুমান করা হয়েছিল? গৃহীত নীতিকৌশল অনুমিত ফলাফল অর্জন করে অর্থনীতির সংকোচন হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখছে কি?
সঠিক অনুমিতির অভাব
রাষ্ট্র অর্থনীতির সামগ্রিক চাহিদা বাড়াতে ব্যক্তিপর্যায়ে ভোগব্যয় এবং ব্যবসায়ে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ধরে রাখতে নগদ অর্থ সরবরাহ করছে। উন্নত দেশগুলোতে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশ প্রণোদনাসহ অন্যান্য মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়েছে। এসব কার্যক্রমে রাজস্ব ও মুদ্রানীতি উভয়কেই ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশে সরকার মনে করেছে অর্থনীতি খুব দ্রুতই অতিমারির রেশ কাটিয়ে আগের অবস্থানে ফিরে যাবে। ভাইরাসের প্রকোপের অনিশ্চয়তাকে আমলে নেওয়া হয়নি। স্বল্পমেয়াদি নীতিমালাই গ্রহণ করা হয়েছে। অনুমান করা হয়নি বিদ্যমান কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অর্থনীতিতে আরও বেশি সংকোচন ঘটতে পারে। বিদ্যমান মৌলিক কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কর্মসূচি নেওয়া হলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউয়ের তীব্রতা থেকে রেহাই পাওয়া যেত। বিশ্ব যখন সম্প্রসারণশীল নীতির দিকে ঝুঁকছে, বাংলাদেশে তখন রাজস্ব ব্যয় আরও সংকুচিত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতির কারণে ঘোষিত ঋণভিত্তিক প্রণোদনা ক্ষতিগ্রস্ত কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পৌঁছাতে পারেনি। অধিকাংশ মানুষের কর্ম নিয়োজনকারী খাতগুলো বঞ্চিত থেকে গেছে। সচ্ছল অংশই মূলত লাভবান হয়েছে। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে বৈষম্য বাড়িয়ে চলছে।
কমেছে সরকারি ব্যয়
রাজস্ব নীতির মাধ্যমে মূলত দুটি উপায়ে অর্থ সরবরাহ করা হয়। রাজস্ব বা পরিচালন ব্যয় ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দের মাধ্যমে সরকারি ব্যয় করা হয়। বিগত বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ হ্রাস পেলেও ২০২০-২১ বাজেটে জিডিপির তুলনায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমেছে ৫ শতাংশ। বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন উভয়ই কমেছে। গত ১০ মাসে বাজেটে ঘোষিত মোট সরকারি ব্যয়ের মাত্র ৪৪ শতাংশ খরচ হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের অবস্থা আরও খারাপ, মাত্র ২৯ শতাংশ। বাজেট বাস্তবায়নের গড় হার ৮৫ শতাংশ অর্জন করতে হলে সরকারকে চলতি অর্থবছরের শেষ দুই মাসে প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যয় করতে হবে। একেবারেই যা অসম্ভব। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি ব্যয় থেকে প্রবৃদ্ধির একটি অংশ এসেছে। করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় সরকারি ব্যয় বাড়ানো দরকার। অথচ আগের তুলনায় তা কমেছে। আরও সংকোচনের পথে গেছে অর্থনীতি। অভিবাসী আয় না কমায় ও কৃষকের উৎপাদন চালু থাকায় অধিক সংকোচন থেকে বাঁচা গেছে।
সরকারি ব্যয় অধিক হারে বাড়ানোর জন্য অর্থের জোগানেরও সুযোগ ছিল। বাজেট ঘাটতি ১০ শতাংশ হলেও বড় সমস্যা হতো না। ঋণ-জিডিপির অনুপাত অন্য অনেক দেশের চেয়ে কম, মাত্র ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বহিঃস্থ এবং বাকি পুরোটাই অভ্যন্তরীণ। জাপানে এ অনুপাত ২৩৭ শতাংশের ওপরে, যুক্তরাষ্ট্রে ১০৬ আর ভারতে ৭০ শতাংশের কাছাকাছি।
প্রণোদনা অর্থের অসম বণ্টন
সরকার ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মার্চের হিসাব অনুযায়ী মোট বাস্তবায়নের অগ্রগতির হার ৬০ শতাংশ। রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বরাদ্দ ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিলের পুরোটাই বাস্তবায়িত হয়েছে। কৃষি খাতের অবস্থা নাজুক। কৃষি ভর্তুকির ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে সরবরাহ হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। কৃষিকাজ যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ২৪৩ কোটি টাকা। কিন্তু কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে (এসএমই) সবচেয়ে বেশি মানুষ নিয়োজিত থাকলেও এই খাতের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম ২ হাজার কোটি টাকা, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নগদ ৯৩০ কোটি টাকা বরাদ্দের এক টাকাও সরবরাহ করা হয়নি। অন্যদিকে তৈরি পোশাক ও চামড়া খাতের শ্রমিকদের সহায়তার জন্য বরাদ্দ দেড় হাজার কোটি টাকার মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ৬ কোটি টাকা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ দেড় হাজার কোটি টাকার মধ্যে সরবরাহ হয়েছে মাত্র ৫৭০ কোটি টাকা। অধিকাংশ মানুষের কাছেই অর্থ পৌঁছায়নি। আবার অনেকে যথাসময়ে পায়নি।
অত্যধিক তারল্য, ঋণপ্রবাহ বাড়ছে না
ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন অর্থের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছিল। অধিক তারল্য থাকলেও ঋণপ্রবাহ বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ ঘোষণা করলেও অর্জন হয়েছে মাত্রা ৮ শতাংশ। আবার ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে নানা প্রাতিষ্ঠানিক বাধা রয়েই গেছে। অর্থ আছে কিন্তু নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তৈরিতে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। একদিকে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমেছে, অন্যদিকে সরকারি খাতে ব্যয়ও কমেছে। ফলে সংকোচন আরও বেড়েছে।
উত্তরণের পথ
সংকোচন রোধ ও পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের কর্মসূচি জরুরি। এ কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হবে দুটো ইউনিট—খানা বা গৃহস্থালি এবং কারবার বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। অভিঘাত মোকাবিলার জন্য প্রতিটি খানায় সরাসরি নগদ অর্থ পৌঁছাতে হবে। সর্বোপরি সর্বজনীন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে যেকোনো অভিঘাতে মানুষের ঝুঁকি প্রশমনের সক্ষমতা বাড়ে। দ্বিতীয়ত, নীতি-কৌশল ও বরাদ্দে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিয়োজিত খাতগুলোতে অধিক প্রাধান্য দিতে হবে। কুটির, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে সহায়তা বাড়াতে হবে। রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনে ও বাণিজ্যে বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান ধরে রাখতে হবে। আশা করা যায় আগামী বাজেটে সরকার এসব ব্যবস্থা নেবে। তবেই মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন