ভিসি বললে ‘হাস্যরস’, আমরা বললেই দোষ?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)
ছবি : সংগৃহীত

আবার এসেছে ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ করার প্রশ্ন। যদিও সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ চায় না। উত্তর প্রত্যাশাও করে না। শুধু মনে করিয়ে দিতে চায় হুমকির বিষয়টি। আড়েঠারে জানিয়ে দেয়, কী করিলে কী হইবে! সেই সঙ্গে বলে দেয়, ব্যক্তিভেদে বক্তব্যের দ্যোতনা ভিন্ন ভিন্ন হয়। ভিসি বললে হয় ‘হাস্যরস’, আর আমরা বললে দণ্ডনীয় অপরাধ!

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তির শিরোনাম ‘খণ্ডিত ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের স্পষ্টীকরণ’। ওই বিজ্ঞপ্তির ভাষায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ’ করা হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এখন অপরাধের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। অপরাধের মাত্রা এতটাই বেশি যে তার প্রতিকারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আইনি প্রতিকার নিয়েও ভাবতে এবং তা সংশ্লিষ্টদের মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। তবে এটা ঠিক, এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তথ্যের স্পষ্টীকরণ যতটুকু না হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হুমকির স্পষ্টীকরণ হয়েছে।

পুরো বিজ্ঞপ্তি পড়লে কিছু শব্দে চোখ আটকে যেতে বাধ্য। এই যেমন ধরুন—উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মানহানি, ভাবমূর্তি, ব্যঙ্গচিত্র ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে, ভাবমূর্তির বিষয়টি নিয়ে আসাই কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত! কারণ, ভাবের যে মূর্তি, তা ইচ্ছেমতো গড়া যায়। ফলে, ভাবমূর্তি লঙ্ঘনের ব্যাপারটিও ঐচ্ছিক। শুধু ‘অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হইয়াছে’—এটি ঘোষণা করলেই হলো। তাতেই আইনি প্রতিকার নেওয়ার ‘যুক্তি’ শক্ত ভিত পেয়ে যায়। এই কৌশল এখন আর নতুন নয়। এভাবে সাম্প্রতিক অতীতে অনেককেই ধরা খাওয়ানো হয়েছে। বর্তমানেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা করে নেওয়া যায়।
মানের হানি হওয়ার বিষয়টি নিয়ে হল্লা যখন বেশি হয়, তখন মান টিকিয়ে রাখা কঠিন। শিঙাড়ার ভালো মাল-মসলা কেনার বদলে যদি শিঙাড়ার ‘ঐতিহ্য’ নিয়েই বেশি লাফালাফি হয়, তখন শিঙাড়ার মানের হানি ঠেকানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, প্রচেষ্টার অনেকটাই যে ‘ঐতিহ্য’ প্রচারেই ব্যয় হয়ে যায়। বর্তমান পরিস্থিতি ভালো করার দিকে তখন নজর দিতে হয় কম। যদিও কথায় আছে, প্রচারেই প্রসার। তবে তাই বলে সূর্যের আলো ছড়ানোর বিষয়টি নিয়ে বেশি প্রচারের নিশ্চয় দরকার পড়ে না। কেননা, আলো ছড়ানোই সূর্যের কাজ।

উপাচার্যের যে কথার ‘ব্যঙ্গ’ করায় সীমা টানতে বলা হয়েছে, সেই কথার মূল সমস্যাও এখানেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শিক্ষা বিলানো এবং সেটির বদলে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে যদি ‘চা-শিঙাড়া’ সামনে চলে আসে, তবে মানুষের কাছে তাতে ‘কৌতুক বোধ’ হতেই পারে। যদিও তাতে মানহানি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।

উপাচার্যের যে কথার ‘ব্যঙ্গ’ করায় সীমা টানতে বলা হয়েছে, সেই কথার মূল সমস্যাও এখানেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শিক্ষা বিলানো এবং সেটির বদলে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে যদি ‘চা-শিঙাড়া’ সামনে চলে আসে, তবে মানুষের কাছে তাতে ‘কৌতুক বোধ’ হতেই পারে। যদিও তাতে মানহানি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারলি সায়মন্ডস (কিউএস) তাদের ওয়েবসাইটে ‘কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিংস-২০২২’ প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮০১-১০০০তমের মধ্যে। অর্থাৎ শিক্ষার দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান আর কতটুকু টিকে আছে, তা নিয়ে সন্দেহ জোরালোভাবেই আছে।

যেখান থেকে এত কিছুর উৎপত্তি, সেই ঘটনারও বিবরণ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে। তাতে বলা হয়েছে, ‘জানুয়ারি ২০১৯-এ টিএসসিতে নবীন শিক্ষার্থীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপাচার্য মহোদয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরেন।’ এবং সেখানে ‘তিনি নবাগত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাস্যরসে ক্যাফেটেরিয়ার সাধারণ, স্বল্পমূল্যের খাবার মেন্যু ও সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার অবারিত সেবা কার্যক্রমের কথাগুলোও বলেন’। কিন্তু তিনি বললে যা ‘হাস্যরস’, অন্যরা বললে তা হচ্ছে ‘অপতথ্য’। তাতে সংশ্লিষ্টদের গোস্‌সাও হচ্ছে। সেই রাগ এতটাই যে তা কমাতে আইনি প্রতিকারের প্রয়োজন হচ্ছে।

বিজ্ঞপ্তিতে যতই বলা হোক ‘গঠনমূলক সমালোচনা সহ্য করার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শ্রদ্ধাশীল’, অন্তত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বন্ধ করার প্রসঙ্গ টানার বিষয়টিতে সেই শ্রদ্ধা প্রতিফলিত হয়নি। দোষ আসলে আয়নার। ওই একই আয়নায় দেশের কর্তাব্যক্তিরা মুখ দেখছেন কিনা। বিশ্ববিদ্যালয়ই-বা এর বাইরে থাকবে কেন? সবাই একই লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এবং আয়নায় আর ‘শ্রদ্ধা’র প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। শ্রদ্ধা শব্দটি থেকে যাচ্ছে শুধু খাতা-কলমে, স্রেফ একটি শব্দ হিসেবে।

তবে আশার কথা এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তিতকুটে সত্য স্বীকারও করে নিয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে এ-ও বলা হয়েছে, ‘এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে অক্সফোর্ড বা জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মৌলিক গবেষণা পরিচালনা করে টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার বা টেস্টিং কিট উদ্ভাবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারেনি। তবে এর কারণ বোধ করি অনেকেই জানেন।’ যদি সেই কারণ শুধুই আর্থিক হয়ে থাকে, তবে তা হবে অজুহাত এবং সেটি এ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, যেকোনো দূরত্বে যেমন রিকশা, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল বা গাড়িতে যাওয়া যায়, তেমনই উপায়ন্তর না থাকলে হেঁটেও যাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে যাওয়ার ইচ্ছা বা প্রয়োজনটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর কবিগুরু তো বলেই গেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে...’।

যাহোক, অনেক কথা বলা হয়ে গেল। বেশি কথা বলাও আসলে ঠিক না। কোনটা আবার ‘অপতথ্য’ বা ‘ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ’ হয়ে যায়, কে জানে!

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]