করজোড়ে কাঁদি চল সবে
পেছনে উদ্যত হাতুড়ি। প্রচণ্ড প্রতিহিংসায় ভাঙছে তাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁই। না না, পাকা ছাদ নয়। বড় হাতুড়ি চাইছিল বাঁশ–কাপড়–চাটাইয়ে তৈরি হালকা–পাতলা অস্থায়ী আশ্রয়টিকেও মাটিতে মিশিয়ে দিতে। ক্ষমতার সামনে কুঁকড়ে থাকা নূরজাহান বেগম চোখের জলে নিস্তার চেয়েছিলেন। কিন্তু উলুখাগড়াদের আকুতিতে কি আর রাজাদের মন গলে?
না, গলেনি। ওপরের ছবিটি যিনি ক্যামেরার লেন্সে বন্দী করেছিলেন, তিনিই নিশ্চিত করলেন। আশা এক অদ্ভুত মায়া। খোঁজ নেওয়ার সময় বারবার মনে হচ্ছিল, যদি শুনি চোখের জলে পাথর গলেছে! কী ভালোই না হতো! জানেন তো, চোখের সামনে অন্যের হাতুড়িতে ঘর ভেঙে যাওয়া দেখার বদলে নিজের গতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে হার মেনে নেওয়া কিছুটা স্বস্তির। তাতে অন্তত অপমানের নীলরঙা আকাশে একটু সাদা মেঘ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পায়। হয়তো নিজের মতো করে নিজেকে সামলেও নেওয়া যায়।
কিন্তু নূরজাহান বেগম সেই সুযোগ পাননি। রাজারা সুযোগ দিতেও চায় না। কেন দেবে? তখন তো আর ক্ষমতার উচ্চ–নিচে ভেদ থাকে না। আর কে না জানে, ভেদাভেদেই টিকে আছে এখনকার দুনিয়া। পার্থক্য যত বাড়বে, ততই সুসংহত হবে আজকের দালানকোঠার ভিত। তার চারপাশে, বিশেষ করে পায়ের কাছে থাকা বাঁশের আগায়, যে নীল-কালো রঙের প্লাস্টিক অগণিত উষ্কখুষ্ক চুলে আছড়ে পড়তে চাওয়া রোদ-বৃষ্টিকে বাধা দিতে চায়, সেটির দিকে কারও খেয়াল থাকে না। বেখেয়াল একসময় অস্বীকারে রূপ নিতে চায়। ঠিক তখনই হাতুড়ি সবেগে উদ্যত হয়।
হাতুড়িকে পেছনে রেখে, যে হাতজোড়া মিনতির ভঙ্গিতে অবনত হয়, সেটিও কিন্তু একদিন হাতুড়ি চালিয়েই এসেছে। কোনো না কোনো দিন নূরজাহানের হাতেও নিশ্চয়ই হাতুড়ি উঠেছিল। উঠতেই যে হবে। কারণ, হাতুড়ি যারা চালায়, তাদের প্রবঞ্চনাই যে পুঁজির ভিত্তি। তাতেই গড়ে ওঠে অট্টালিকা, বড় বড় শপিং মল। গড়ে ওঠে বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার, ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। সেই রাস্তার এক কোনায় বা সড়ক বিভাজকের ওপরে সেসব হাতুড়ি চালানো মানুষের অবস্থান বড্ড বেমানান লাগে।
যদিও রাস্তা দখল করে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি বাস বা দামি গাড়ি, ফুটপাতের অধিকাংশে পোড়া মাংসের হাঁড়িকাঠ লাগানো হোটেল কিংবা বখরা বুঝিয়ে দেওয়া ইংলিশ বুলির বাঙালি সংস্কৃতির হাট নিয়ে কখনো কেউ আপত্তি তোলে না। কারণ, তাতে যে ভাবমূর্তিতে কালি মাখে না। কিন্তু একটা কোটি টাকার গাড়ির লাখ টাকার রঙিন জানালা দিয়ে সড়ক বিভাজকের ওপরে রাঁধতে বসা নূরজাহান বেগমকে দেখলে শীতলীকরণ যন্ত্রের আয়েশে বলে আসা কথাগুলো যে মিথ্যা হয়ে যায়। আর যা–ই হোক, শিক্ষিত লোকের পক্ষে নিজের বুলি পাল্টানো খুব কঠিন! তাই শেষে আসে হাতুড়ি পাঠানোর আদেশনামা। নূরজাহানের হাতুড়ি কেড়ে নেওয়া হয়। তা দেওয়া হয় নবীন হাতে। একসময় নিজের হাতুড়ির সামনেই নত হয় নূরজাহানরা, উচ্ছেদ হয়। আহা, নূরজাহানদের যদি নিজেদের একটি হাতুড়ি থাকত!
থাকলে হয়তো উচ্ছেদের ইশতেহার বদলে যেত।
তবে তা হয় না, হয়তো হবেও না সহসা। নূরজাহানদের কেঁদেই যেতে হবে। হাতজোড় করতে হবে তারই কাছে, যাকে একদিন তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন। তবু তাঁর ঘর টিকবে না। এক সড়ক বিভাজক থেকে উচ্ছেদ হয়ে খুঁজতে হবে নতুন কোনো বিভাজক। তাঁদের যে বিভাজনেই গন্তব্য।
ওদিকে সদ্য পরিষ্কার, ফকফকা বিভাজকের পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে উড়ে যাবে কোটি কোটি টাকার গাড়ি। যেতে যেতে গর্বভরে বলবে, ‘জানো, আমরা উন্নয়নের জোয়ারে নেয়ে চলেছি!’ তাতে কোনো ভাটা নেই বলে জোর গুজব ছড়ানো হবে। যদিও সেই গুজবকে ভুল প্রমাণ করার ‘ভুল’ কেউ করার সাহস দেখাবে না। কারণ, জীবন যে একটি মূল্যবান ও নির্বিবাদী বস্তু, তাতে আপত্তি জানানোর মতো কাউকে আর সেদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তবে হ্যাঁ, বিশিষ্টজনেরা ভেসে থাকবেন ঠিকই। ডুববে শুধু অভাজনেরা। তারা খুঁজে চলবে অন্য কোনো সড়ক বিভাজকের এমন কোনো কোনা, যেখানে ঝুপড়ি বানালেও লাখ টাকার কাচের জানালায় ধরা পড়বে না। এভাবে অদৃশ্য, অস্তিত্বহীন হতে পারলেই একদিন হয়তো হাতুড়িরা নিরুদ্দেশ হবে। আর খুঁজে ফিরবে না করজোড়ে কেঁদে চলা চোখের প্রকম্পিত মণি।