বাংলাদেশে সুফিয়া কামাল একমাত্রিক পরিচয়ে পরিচিত নন। সাহিত্যের আলোচনায় তিনি কবি। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহেরও অন্যতম চরিত্র বলে তিনি পরিগণিত হন। এসবের পাশাপাশি তিনি মৃত্যুর আগে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদবিরোধী ব্যক্তিত্ব হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া নারীমুক্তির আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি নারী আন্দোলনের পথিকৃতের মর্যাদা পান। কেউ কেউ তাঁকে নারীবাদীও আখ্যা দেন। সুফিয়া কামালের এসব পরিচয়ের কোনোটিই অমূলক নয়। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে দেখা যাবে যে তিনি আসলে বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সুফিয়া কামালের আর আর সব পরিচয়ই তাঁর এই সাংস্কৃতিক চৈতন্যেরই বাইপ্রডাক্ট।
বাংলাদেশের ইতিহাসটাই আসলে এমন যে এখানে পাকিস্তান আমলের সব সাংস্কৃতিক চরিত্রই রাজনৈতিক চরিত্র। কারণ, বাংলাদেশ পৃথিবীর বিরল দেশগুলোর একটি, যেখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামে রাজনীতির ময়দানের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ময়দানও সমান সক্রিয় ছিল। এই অর্থে সুফিয়া কামাল রাজনীতিমুক্ত ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তিনি আসলে তাঁর ওই সাংস্কৃতিক সত্তা নিয়েই গভীরভাবে সক্রিয় ছিলেন ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে। এমনকি বাংলাদেশ পর্বেও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর যে অবস্থান, তা-ও ওই সাংস্কৃতিক সত্তারই বর্ধিত রূপ।
আর সুফিয়া কামালের প্রগতিশীলতার ব্যাপারটাও সেই সাংস্কৃতিক চৈতন্যেরই একটা অভিপ্রকাশ। আসলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের খাসলতের সঙ্গেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রগতিশীলতার ব্যাপারটা গভীরভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ইতিহাস বলছে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি কার্যকরভাবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়ানোর চেষ্টা না করে বা ব্যর্থ হয়ে অন্তত পঞ্চাশের দশক থেকেই ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। ফলে বাংলাদেশ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের ব্যাপরটাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। ফলে বাঙালির প্রগতিশীলতার সঙ্গে ধর্মের একটা খুনসুটির ব্যাপার গোড়া থেকেই ছিল। এই খুনসুটি স্বাধীন বাংলাদেশে আরও স্পষ্ট হয়েছে। সুফিয়া কামাল যেহেতু বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার পক্ষের সাংস্কৃতিক কর্মী ছিলেন, সেহেতু তিনি স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে প্রগতিশীল বলে পরিগণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদবিরোধী চরিত্র হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছেন। এই পরিচয় তিনি আমৃত্যু বহন করেছেন এবং এখনো যখন সুফিয়া কামালের চেতনার রূপরেখা হাজির করা হয়, তখনো তাঁর ওই পরিচয় খুবই মুখ্য হয়ে ওঠে।
সুফিয়া কামাল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মুক্তির জন্য খুব যে লিখেছেন, তা কিন্তু নয়। যেমনটি রোকেয়া লিখেছিলেন আজীবন। তাহলে তিনি নারীবাদী কীভাবে! তিনি নারীবাদী আসলে লেখালেখি করে নন; নারীর জন্য শুভাকাঙ্ক্ষায় এবং নারীবান্ধব কিছু সংগঠন গড়ার ভেতর দিয়ে তিনি বোধ করি নারীবাদী বা নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ আখ্যা পেয়েছেন।
সুফিয়া কামালকে মূলত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলার কারণটি তাঁর উন্মেষ পর্বের মধ্যেই নিহিত আছে। অতি অল্প বয়সে তিনি কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সেটা বোধ করি ১৯২৬ সাল। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫ বছর। সেই বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ প্রকাশিত হয় ওই সময়ের খুবই গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ‘সওগাত’-এ। তিনি কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথের পর্যন্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। স্নেহ ও শুভাকাঙ্ক্ষা লাভ করেছিলেন ‘সওগাত’-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন থেকে শুরু করে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখের। একটা সময় তিনি ‘সওগাত’–এর নিয়মিত লেখক হিসেবে বিবেচিত হতেন। ১৯৩৭ সালেই প্রকাশিত হয়ে যায় তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’। আর ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’। এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এর ভেতর দিয়েই তিনি ১৯৪৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হওয়া ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদকও নিযুক্ত হয়েছিলেন। এরপর কমবেশি বিরতি দিতে দিতে তিনি একের পর এক রচনা করে গেছেন বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ ও শিশু-কিশোর কবিতার বই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি লিখেছেন অত্যন্ত কম। আসলে এই পর্বে তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা ও প্রযত্নে সময় দিয়েছেন বেশি। এর ভেতর দিয়ে তিনি সেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক রাজনীতিটাকে বহন করে নিয়ে চলেছেন।
সুফিয়া কামাল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মুক্তির জন্য খুব যে লিখেছেন, তা কিন্তু নয়। যেমনটি রোকেয়া লিখেছিলেন আজীবন। তাহলে তিনি নারীবাদী কীভাবে! তিনি নারীবাদী আসলে লেখালেখি করে নন; নারীর জন্য শুভাকাঙ্ক্ষায় এবং নারীবান্ধব কিছু সংগঠন গড়ার ভেতর দিয়ে তিনি বোধ করি নারীবাদী বা নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ আখ্যা পেয়েছেন।
সুফিয়া কামাল এমন একটি সময়ে বাংলা ভাষায় কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন যখন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বাংলা শিক্ষারই প্রচলন হয়নি; আরবি-ফারসি-উর্দুরই ছিল চল। কবিতায় নারীর মনের ভাব প্রকাশের ব্যাপারটা তো বহুত দুরস্ত। কিন্তু সুফিয়া কামাল বাংলা শিখেছিলেন এবং কবিতাও লিখেছিলেন। তিনি সেই যুগে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, যে যুগে কোনো ফটোগ্রাফার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পুরুষের ছবি তুলতে গেলে পুরুষেরা বলতেন, ‘আল্লাহর কসম লাগে, ছবি তুলবেন না।’ এমন একটা যুগে সুফিয়া কামাল ‘সওগাত’ পত্রিকায় ছবিসহ কবিতা ছেপেছিলেন। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত স্টুডিওতে তিনি ছিলেন প্রথম মুসলিম নারী, যিনি ছবি তুলেছিলেন। তিনি কলকাতার প্রথম নারী যিনি উড়োজাহাজে করে আকাশে চক্কর দেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, নারী অগ্রগতির ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সুফিয়া কামালের আজ জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।