আউলিয়া মুনশির প্রতিশোধ

মুক্তিযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে। কিন্তু আমাদের জীবনে তখনো মুক্তি আসেনি। আউলিয়া মুনশির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ঠিক এমন একদিনে।

বেঁটেখাটো মানুষ আউলিয়া মুনশি। বয়স পঞ্চান্ন-ষাটের মধ্যে হলেও আরও বেশি দেখায়। গ্রামের মানুষ অকালে বুড়ো হয়ে যায়। আউলিয়াও তার ব্যতিক্রম নন। তাঁর মাথায় মাওলানা ভাসানীর মতো তালের পাতার টুপি, মুখভর্তি সাদা দাড়ি, তিলের খাজার মতো কাঁচা–পাকা গোঁফ। আধময়লা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা লোকটাকে দেখে আমি ধারণাই করতে পারিনি যে লোকটা বাঙালি। গায়ের রং দেখে ভেবেছিলাম, সিন্ধু প্রদেশের লোক হবেন। অথচ রাওয়াল লেকের তীরে তীব্র বাতাসের মধ্যে লোকটা যখন বাংলা শব্দ উচ্চারণ করলেন, আমি ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলাম।

সেদিনের কথা খুলেই বলি। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্সে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের পর আমরা হঠাৎ দেশহীন হয়ে পড়লাম। পূর্ব সীমান্তে যখন লাল-সবুজের পতাকা উঠল, তখন পশ্চিমে আমাদের চব্বিশ বছরের দেশ আমাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসল। অথচ বারো বছর ধরে এ দেশকেই ঘর বানিয়ে মানুষের সেবা করেছি। এক প্রবল আলোড়নে সবটাই ধসে পড়ল। আমাদের অপরাধ, দেশে ফিরে যেতে চেয়েছি। এ জন্য সরকারি দায়িত্ব থেকে কলমের খোঁচায় সাময়িক বরখাস্ত করে বেকার করে রাখা হলো। সেটা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, গুটিকয় বাংলাভাষী পাকিস্তানি ছাড়া সবার ক্ষেত্রেই খড়্গহস্ত হলো জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার। গোয়েন্দা সংস্থার কড়া নজরদারির মধ্যে কার্যত গৃহবন্দী হয়ে আমাদের দিন কাটতে লাগল।

আমরা কেবল সরকারের দিক থেকে কোণঠাসা হইনি, জনগণের উগ্র জাত্যভিমানী অংশটিও আমাদের কার্যত একঘরে করে ফেলল। বারো বছরের প্রবাসজীবনে বর্ণবাদের বিস্তর অভিজ্ঞতা হলেও পেটে কখনো টান পড়েনি। কিন্তু এবার তা-ও হলো। বিশেষ করে রাওয়ালপিন্ডির মাছুয়াপট্টির জেলেরা যখন আমাদের কাছে মাছ বিক্রি করা বন্ধ করে দিল, তখন সত্যি সত্যি যেন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা সাক্ষী, বাঙালি পানি ছাড়া বহুদিন বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু পাতে মাছ না পড়লে সপ্তাহখানেক টেকাও প্রচণ্ড সংগ্রামের। আমরাও মাছের অভাবে ডাঙায় তোলা মাছের মতো সারাক্ষণ খাবি খেতে লাগলাম।

উপায় বাতলাল আমার বরিশালের এক কলিগ। ভদ্রলোকের মাছ শিকারের বড্ড নেশা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মাছ ধরতে দূরদূরান্তে ছিপ-টোপ নিয়ে হাজির হন। ভদ্রলোক মাছ শুধু নিজে খান না, বন্ধু-প্রতিবেশীদের মধ্যেও দেদার বিলান বলে ভালো মানুষ হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি আছে। মাছ বিনে আমার উদাস চেহারা দেখে তিনি আমাকে বললেন, ‘আরে ভাই, কুছ পরোয়া নেই। কাল ভোরবেলা রাওয়াল লেকে চলুন। দেখবেন গাড়িভর্তি মাছ নিয়ে বিকেল নাগাদ ফিরব। ফেরার পথে বিরতি নিয়ে মাছুয়াপট্টির ওই লাটসাহেবদের মাছও দেখিয়ে আনব। যাবেন?’

মাছ ধরা এককালে আমারও প্রিয় নেশা ছিল। না করার প্রশ্নই আসে না। তৎক্ষণাৎ রাজি হলাম। সেদিন তাড়াতাড়ি শুয়ে কাকডাকা ভোরে উঠে রওনা দিলাম পনেরো মাইল দূরের রাওয়াল লেকের দিকে।

আমার কলিগ ভদ্রলোক উচ্চশ্রেণির মৎস্যশিকারি। এলেবেলে মাছ ধরেন না, তেমন বড়শিও রাখেন না। তিনি বিশেষভাবে ধরতে পছন্দ করেন মহাশোল মাছ। নামে শোল হলেও মাছটার সঙ্গে আমাদের মৃগেল মাছের মিলই বেশি। রাওয়াল লেকের গর্ব হলো মহাশোল মাছ। স্থানীয়রা বলে মাহশির। যে–সে টোপ গেলে না। যার–তার বরাতেও জোটে না। এ জন্য অভিজ্ঞ হাত ও বিশেষ টোপের প্রয়োজন হয়। কিন্তু স্রষ্টা বোধ হয় সেদিন আমার প্রতি প্রসন্ন ছিলেন। বড়শি ফেলার কুড়ি মিনিটের মধ্যে হুইলে প্রচণ্ড টান অনুভব করলাম। আমার শরীরের সমস্ত রক্ত যেন মাথায় এসে জমা হলো। হুইল ঘুরিয়ে কোনোভাবেই মাছের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলাম না। আমার অবস্থা দেখে কলিগ ভদ্রলোক হাত লাগিয়ে বললেন, ‘মাছটা বোধ হয় বড়শিসহ পাথরের খাঁজে গিয়ে ঢুকেছে। পাথর উল্টে না দিলে মাছ ধরা পড়বে না। ডুবসাঁতার ছাড়া উপায় নেই।’

কিন্তু রাওয়াল লেকের অতল জলে ডুব দেবে কে? আমি আজন্ম শহরনিবাসী। সাঁতার জানি না। অন্যদিকে আমার সহকর্মী এককালের জাঁদরেল সাঁতারু হলেও একবার স্ট্রোক করার পর পানিতে নামতে ডাক্তারের বারণ আছে। উপায়ন্তর না দেখে যখন অসহায়ের মতো মাছের বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় বসে আছি, ঠিক তখনই দেবদূতের মতো আগমন ঘটল আউলিয়া মুনশির। ভদ্রলোক উত্তরবঙ্গের টানে বললেন, ‘একবার নামিয়া দেখি, আসিম নাকি বাবারা? তোরা যদিল কন, মুই মাছটা ধরি আনোঁ।’

মহাশোলের জায়গায় বড়শিতে হাঙর মাছের ছানা উঠে এলেও অতটা বিস্মিত হতাম না, যতটা হলাম বৃদ্ধের মুখে বাংলা কথা শুনে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে স্বদেশিমাত্রই আপনজন। অসম্মতি জানানোর প্রশ্নই আসে না। বৃদ্ধ তীব্র বাতাসের মধ্যে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা অবস্থাতেই লেকের হিমশীতল পানিতে ডুব দিলেন। কিছুক্ষণ পর ভেসে উঠে বললেন, ‘কাজ হইছে। পাথর উল্টি দিছি। এখন হুইল ঘুরান।’

সত্যিই তা–ই। হুইল ঘোরাতেই যে প্রকাণ্ড সোনালি মহাশোল মাছ উঠে এল, তার দৈর্ঘ্য কোনোভাবেই চার ফুটের কম হবে না। বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি কানকো পাকড়াও করে মাছটাকে তুলে আমাদের সামনে রাখলেন।

আমি অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। শরীর থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। লেকের ঝোড়ো বাতাসে তিনি কাঁপছেন ঠকঠক করে। তারপরও এক অদ্ভুত তৃপ্তি জ্বলজ্বল করছে লোকটার চোখেমুখে।

প্রশ্ন করে জানলাম, তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে থাকেন না। সপ্তাহখানেক আগে এসেছেন। পানি দেখলে দেশের কথা মনে পড়ে বলে লেকের পাড়ে ঘুরে বেড়ান। আরও প্রশ্ন করে জানলাম, মাত্র দশ-বারো দিন আগে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ঢুকেছেন।

মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। বুড়োর প্রতি যে সহানুভূতিটুকু জেগে উঠেছিল, সেটাও একনিমেষে গলে গেল। যে পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার জন্য আমরা আটকে পড়া লাখো বাঙালি অপেক্ষা করছি, সেখানেই কিনা লোকটা স্বেচ্ছায় এসেছে। হাড়ের খোঁজে বাঘের মুখে মাথা ঢুকিয়েছে বক। কী অদ্ভুত!

আমি রাগ গোপন করতে না পেরে লোকটার সঙ্গে বাতচিত করা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু আমার কলিগ অত সহজে ছাড়লেন না। লোকটা এই অবস্থায় আর কিছুক্ষণ থাকলে ঠান্ডায় মারা যাবেন বলে তাঁকে পিকনিক টাওয়ালে মুড়িয়ে ডাটসান গাড়িতে বসিয়ে নিলেন। প্রকাণ্ড মহাশোল মাছসমেত গাড়ি গড়িয়ে চলল আমাদের সরকারি কলোনির দিকে।

বাসায় ফিরে লোকটাকে পরিষ্কার লুঙ্গি-পাঞ্জাবি দিলাম। পরিষ্কার পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরে, গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে লোকটার শরীরে যেন বল ফিরে এল। তিনি বঁটি দিয়ে নিখুঁতভাবে মাছটির ষড়ভূজাকৃতির আঁশ ছাড়িয়ে খণ্ড খণ্ড করলেন।

বহুদিন পর আমার গিন্নি মনে আনন্দ নিয়ে মাছের ঝোল রান্না করলেন। সুগন্ধে আমার জিবে পানি এল। কলোনির আরও কয়েকজন বাঙালি অফিসার সেদিন আমার বাড়ির অতিথি হলেন। খেয়েদেয়ে তাঁরা আমার স্ত্রীর রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করলেন।

আমার দুই ছেলের সঙ্গে বৃদ্ধের খাতির হয়ে গেল। খেয়েদেয়ে আয়েশ করে পান চিবিয়ে বুড়ো নিজের পরিচয় দিলেন। তাঁর নাম আউলিয়া মুনশি। বাড়ি রংপুর জেলার কোনো এক ছোট্ট গ্রামে। স্থানীয় মসজিদে ইমামতি করার পাশাপাশি বাজারের এক ছোট্ট দোকানে ৫৭০ সাবান, বড়শি ও ছিকিয়ার সুতো আর তাবিজের খোল বিক্রি করতেন। স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র আমজাদকে নিয়ে কাটানো দিনগুলো অভাবের হলেও যথেষ্ট সুখের ছিল। বেঁচে থাকা ছিল আনন্দের। নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হাজির হলো মুক্তিযুদ্ধ।

আউলিয়া মুনশি কখনো দেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবেননি। ইমামতি করেন বলে চায়ের দোকানে কান খাড়া করে রেডিও শোনার অভ্যাসও তাঁর ছিল না। দেশের মসনদের তুলতুলে নরম গদিতে কে বসল না বসল, তা নিয়ে তার চিন্তা ছিল না। ইমামতি করার পাশাপাশি স্ত্রী ও সতেরো বছরের তরতাজা সন্তানকে নিয়ে সুখেই সংসার করছিলেন।

কিন্তু যুদ্ধকে এড়াতে চাইলেও যুদ্ধ কি মানুষকে ছাড়ে? জুলাই মাস নাগাদ তাঁর গ্রামে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প খোলা হলো। পাঞ্জাবি সৈন্যরা ক্যাম্পের চারপাশের গ্রামগুলোয় বুটের মচমচ আওয়াজ তুলে তল্লাশি চালিয়ে বেড়াতে লাগল। মুক্তিবাহিনী বলে সন্দেহ হলেই ধরে এনে নির্যাতন করত। ভিটামাটি আগুনে পোড়ানো, নারী ধর্ষণ ছিল তাদের প্রাত্যহিক কাজ।

আউলিয়া মুনশি তাতেও উদ্বিগ্ন হলেন না। তিনি ইমাম মানুষ। কারও সাতেপাঁচে নেই। আল্লাহর ওপর অটল বিশ্বাস ছিল বলে ভেবেছিলেন, আল্লাহই তাঁকে রক্ষা করবেন। কিন্তু যুদ্ধ বড় নিষ্ঠুর। মানুষ দেখে যুদ্ধ হয় না। হিংসার লেলিহান শিখা নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। আউলিয়া মুনশি সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও তাঁর ছেলে আমজাদ কিন্তু রেহাই পেল না।

বুড়ো বয়সের একমাত্র সন্তান বলে আমজাদ ছিল তার চোখের মণি। ছেলেটাও আচার-ব্যবহারে গ্রামের মানুষের মন জয় করেছিল। আউলিয়া মুনশি ইমামতি করতেন। পেছনে দাঁড়িয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত আমজাদ। চমৎকার সুরেলা কণ্ঠে আজান দিতে পারত। নিজ হাতে তাকে কায়দা-আমপারা ও কোরআন শরিফ পড়ানো শিখিয়েছিলেন আউলিয়া মুনশি। উর্দি পরা সৈনিকেরা বাজারে ডেরা বসালে রোজ নামাজ শেষে ছেলের মাথায় সুরা ইউনুস পড়ে ফুঁ দিতেন তিনি। ভেবেছিলেন, ছেলের কোনো বিপদ হবে না।

কিন্তু যুদ্ধে বিপদ ব্যাকরণ মেনে আসে না। সেপ্টেম্বরের এক প্রবল বর্ষণের রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা হামলা চালিয়ে হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটালেন। অমনি তারা প্রতিশোধের নেশায় ফুঁসে উঠল।

এমন কিছু ঘটবে, গ্রামবাসী ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি। সেদিন ছিল হাটের দিন। জোহরের নামাজের পর থেকে হাটুরে মানুষ দূরদূরান্ত থেকে পণ্য নিয়ে এসেছিল। কেনাবেচাও চলছিল স্বাভাবিক নিয়মে। হাটের প্রাণচাঞ্চল্য ক্যাম্পের সেনাদের অহমে আঘাত করল। এত বড় ঘটনার পরও এই মানুষগুলোর মধ্যে একফোঁটা অনুশোচনা নেই! নির্লজ্জের মতো এরা হাটে এসেছে। হাসিমুখে কেনাবেচা করছে, আড্ডা দিচ্ছে।

পাঞ্জাবি সুবেদারের নির্দেশে একদল উর্দি পরা সেনা যমদূতের মতো বেয়নেট উঁচিয়ে হাটের লোকগুলোকে ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে এককাট্টা করল। মুক্তিবাহিনীর হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল চমকা নদীর তীরে। সার বেঁধে দাঁড় করানো ষাট-সত্তরজন মানুষকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করল। এদের মধ্যে একজন আউলিয়া মুনশির ছেলে আমজাদ।

আউলিয়া মুনশি আজও সেই দিনের জন্য নিজেকে অভিশাপ দেয়। সেদিন সে দোকানে ছিল না। জ্বরে কাবু এক নবজাতককে পানিপড়া দেওয়ার জন্য তিন মাইল দূরের বেণীপুর গ্রামে গিয়েছিল। তার জায়গায় দোকান নিয়ে বসেছিল আমজাদ। ছেলের জায়গায় সে নিজে থাকলে একটুও আফসোস থাকত না। দুনিয়ার জীবনের চেয়ে পরকালের অনন্ত জীবনটিই তাঁর কাছে পরম কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু আমজাদের কী দোষ ছিল? সে জীবনটাকে ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো। মৃত্যুর আগে জানতেও পারল না, তার কী অপরাধ ছিল।

আউলিয়া মুনশির রক্তে সেদিন থেকে প্রতিশোধের বান ডেকেছে। স্থানীয় রাজাকারদের কাছ থেকে জেনেছে, যেই সুবেদারের বন্দুকের গুলিতে খুন হয়েছে তার আদরের ছেলে আমজাদ, ঘটনাক্রমে খুনিটির নামও আমজাদ।

যে আউলিয়া মুনশি কোনো দিন ঢাকায়ও যায়নি, প্রতিশোধের আগুনে প্রজ্বলিত হয়ে সে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত হয়ে পাকিস্তানে এসে ঢুকেছে। শুরুতে কয়েক দিন করাচিতে ছিল। সেখান থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে এসেছে। রাজাকাররা বলেছিল, সুবেদার আমজাদ নাকি রাওয়ালপিন্ডির লোক। পাঞ্জাবিরা মাছ অপছন্দ করলেও সে নাকি খুব পছন্দ করে। লোকটা কোনো না কোনো দিন রাওয়াল লেকে মাছ শিকার করতে আসবে সন্দেহ করে সে এখানে রেকি করতে শুরু করেছে।

গল্প শেষ হতে হতে রাত হয়ে গেল। গোয়েন্দা সংস্থার শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে আউলিয়া মুনশিকে বাড়িতে জায়গা দেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। এমনিতে আমরা দেশদ্রোহী হিসেবে সাময়িক বরখাস্ত হয়ে আছি, উটকো বিপদে পড়ার আগে পরিবারের স্বার্থে চিন্তাভাবনা করতে হয়। সুতরাং কিছু পরিষ্কার কাপড়চোপড় ও টাকা দিয়ে আউলিয়া মুনশিকে বিদায় দিলাম। প্রতিশোধ নেওয়ার ভাবনা ত্যাগ করে দেশে ফিরে যেতে বললাম। আউলিয়া মুনশি মুচকি হেসে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।

আউলিয়া মুনশির কথা এরপর ভুলেই গিয়েছিলাম। মাছের দাম কমে যাওয়ায় লেকের দিকেও আর যাওয়া হয়নি। সিমলা চুক্তির পর পাকিস্তান সরকার আমাদের ঢাকায় ফেরার অনুমতি দিল। সপরিবার দেশে ফেরার আনন্দে মন নেচে উঠল। পরাধীনতা কাকে বলে, এই দুই বছরে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। এবার পা রাখব স্বাধীন দেশের মাটিতে। এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে বসে আছি। এমন সময় এক সহযাত্রীর মেলে ধরা জংপত্রিকার পাতায় চোখ আটকে গেল। রাওয়াল লেক থেকে আমজাদ খান নামের এক সাবেক সেনা কর্মকর্তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ আউলিয়া মুনশি নামের এক ভবঘুরে লোককে আটক করেছে।

আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। ঠিক সে সময় স্পিকারে উর্দুভাষী ঘোষকের ভরাট কণ্ঠ গমগম করে উঠল, ‘পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের ইসলামাবাদ-কাঠমান্ডু ফ্লাইটে আসন গ্রহণের জন্য আপনাকে অনুরোধ করা হলো।’

দুই ছেলের হাত শক্ত করে ধরে প্লেনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।