বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে যখন ঢাকায় আসেন। তখন তাঁর সঙ্গে অসংখ্য উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ভারতীয়, আফগান, ইরান-আরবি তথা বহিরাগত মুসলমান ও হিন্দুরা ঢাকায় এসেছিলেন। এই আগমন পরবর্তী সময় আরও প্রায় ২৫০ বছর চলমান ছিল। এই ব্যাপক জনগোষ্ঠী বর্তমান পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বসতি স্থাপন করেছিল। এদের বংশধরেরাই বর্তমানে পুরান ঢাকার আদি অধিবাসী। আনিস আহামেদ ‘ঢাকাইয়া আসলি’ গ্রন্থে এই আদি অধিবাসীদের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘তাদের বংশধরেরা যে ভাষায় কথা বলত, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা করত এবং সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলত, তাকে এক কথায় ঢাকার হিন্দুস্তানি ভাষা ও হিন্দুস্তানি লোকসাহিত্য-সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা যায়।’ ১৬১০ সাল থেকেই ঢাকায় বসবাসকারী সব উচ্চ ও নিম্ন পদস্থ পরিবারগুলোর মধ্যে আরবি, ইংরেজি, গুজরাটি, তুর্কি, পালি, পর্তুগিজ, ফরাসি, ফারসি, মুন্ডা, সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দুস্তানি (উর্দু, হিন্দি) ভাষার মিশ্রণে নতুন এক মিশ্রিত কথ্য ভাষার প্রচলন শুরু হয়, যা এখনো ঢাকার আদি অধিবাসীদের আঞ্চলিক কথ্য ভাষা। পুরান ঢাকার অসংখ্য আদি অধিবাসীরা এই কথ্য ভাষায় পরিবারে, সমাজে, হাট-বাজারে ও সামাজিক অনুষ্ঠানে কথাবার্তা বলে। তবে ঠিক কত মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করে, তার হিসাব কখনো করা হয়নি। হয়তো কেউ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেনি। এই মিশ্রিত ঢাকাইয়া ভাষাকে বর্তমানে আদি ঢাকাইয়ারা ‘সোব্বাসি’ ভাষা বলে এবং নিজেদেরকে ‘সোব্বাস/সোব্বাসি’ বলে পরিচয় দেন। বর্তমানে ঢাকায় সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, বংশাল, চকবাজার, লালবাগ থানার অন্তর্গত বিভিন্ন মহল্লায় সোব্বাসিরা বসবাস করছেন।
গবেষক শায়লা পারভীনের মতে, ‘সুখবাসরা বহির্বাংলা থেকে ঢাকায় আগমনকারী অভিবাসীদের বংশধর। মুঘল আমলে প্রশাসনিক, সামরিক ও বাণিজ্যিকসহ বিভিন্ন কারণে এরা ভারতের আগ্রা, দিল্লিসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে ঢাকায় বসতি স্থাপন করে। এদের অধিকাংশেরই ভাষা ছিল হিন্দুস্তানি।’
সুখে বাস করা বা সুখবাস শব্দ থেকে ‘সোব্বাস’ শব্দের উৎপত্তি। সোব্বাস ঢাকাইয়ারা ‘সুখ’কে বলে ‘সোখ’। সুখবাস থেকে সোখবাস আর তা থেকে সোব্বাস। অর্থাৎ সুখবাস> সোখবাস> সোববাস> সোব্বাস> সোব্বাসি। ঠিক যেমন ‘চাঁদনী ঘাট’ থেকে ‘চান্নিঘাট’, ‘রায় সাহেব বাজার’ থেকে ‘রাসাবাজার’, ‘শেখ সাহেব বাজার’ থেকে ‘সিক্সাবাজার’ বা মুন্ডা ভাষার শব্দ ‘বইনটি’ থেকে সোব্বাসি ‘বায়ঠি’, ফারসি ‘তখৎ’ সোব্বাসিতে ‘তাক্তা’ হয়ে গেছে, সেভাবেই সুখবাস হয়ে গেছে সোব্বাস। ঢাকার কথ্য ভাষার মিশ্রণ প্রসঙ্গে ড. কানিজ-ই-বাতুল বাংলা পিডিয়ায় লিখেছেন, ‘আঠারো শতকে ঢাকা চাল ব্যবসায়ের কেন্দ্র ছিল এবং ব্যবসায়ীরা ছিলেন মাড়োয়ারি। তাঁরা বাংলাভাষী চাল বিক্রেতাদের সঙ্গে হিন্দুস্তানি বা রিখতা ভাষায় কথা বলতেন। তা ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি সভা ও কোর্ট-কাচারিতে হিন্দুস্তানির ব্যবহার প্রচলিত ছিল।’ অর্থাৎ ১৬১০ সাল থেকেই ঢাকায় সব শ্রেণি–পেশার মানুষের মধ্যে মিশ্রিত হিন্দুস্তানি ভাষার ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং তা আরও পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে কথ্য সোব্বাসি ভাষায় পরিণত হয়েছে।
ঢাকায় প্রচলিত সোব্বাসি কথ্য ভাষা একটি নাগরিক বা নগর উপভাষা হওয়ার পরও এটির উৎপত্তি ও বিবর্তন নিয়ে গবেষণা কম হওয়ার একটি কারণ হয়তো এই ভাষার প্রাচীন কোনো নমুনা না থাকা। যেহেতু এটি কথ্য ভাষা, তাই লিখিত নমুনা না থাকাই স্বাভাবিক। ঢাকার ভাষার প্রাচীন যে নমুনা পাওয়া যায় গ্রিয়ারসনের ১৮৯৮ সালের, তা মানিকগঞ্জের ভাষার। সোব্বাসিরা বংশপরম্পরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলার মাধ্যমে এই ভাষা এবং ভাষার ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছে এবং দিচ্ছে; এভাবে পৌঁছানোর এই প্রক্রিয়া ১৬১০ সাল থেকেই চলমান। সোব্বাসিদের নিজস্ব গল্প, ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, ইতিহাস এভাবেই শ্রুতির মাধ্যমে চলমান। সোব্বাসি ভাষা কখনোই কোনো বর্ণমালা ব্যবহার করে লেখা হয়নি। তবে ইদানীং বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে সোব্বাসি ভাষায় লেখালেখি হচ্ছে এবং ১৫ জানুয়ারি ২০২১ ‘বাংলা-ঢাকাইয়া সোব্বাসি ডিক্সেনারি’ নামে সোব্বাসি ভাষার অভিধান প্রণীত হয়েছে।
ভাষা প্রবহমান নদীর মতো; চলার পথে যা পায়, তাকেই সঙ্গী করে সামনের দিকে ধাবিত হয়, পেছনে ফেরার উপায় নেই। প্রতিনিয়তই সোব্বাসি ভাষায় নতুন শব্দের সমাহার হচ্ছে আবার অনেক পুরোনো শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। তথাপি বলা যায়, একটি নাগরিক বা নগর উপভাষা হিসেবে বর্তমানে প্রচলিত সোব্বাসি কথ্য ভাষার যে যাত্রা ঢাকায় ১৬১০ সালে হিন্দুস্তানি কথ্য ভাষা থেকে শুরু হয়েছিল, তা বিভিন্ন ভাষার প্রভাবে বিবর্তিত হয়ে এখনো ঢাকার বুকে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এটি এমন একটি নগর উপভাষা, যাকে বলা যায় একটি মিশ্রিত কথ্য হিন্দুস্তানি উপভাষা থেকে বিবর্তিত আরেকটি মিশ্রিত কথ্য নগর উপভাষা।
সোব্বাসি ভাষার জটিল বিষয়গুলোর একটি ‘া’(আ-কার)। ঢাকাইয়া সোব্বাসিরা দুই রকমের ‘া’(আ-কার) উচ্চারণ করে; একটি জোর দিয়ে আরেকটি আস্তে, নরম সুরে। যেমন ‘আকাশের মেঘ’-এর সোব্বাসি ‘আসমানকা আবার’; এখানে ‘আসমানকা’ শব্দে প্রতিটি ‘া’(আ-কার) জোর দিয়ে উচ্চারিত হবে আর ‘আবার’ শব্দে প্রতিটি ‘া’(আ-কার) আস্তে, নরম সুরে উচ্চারিত হবে। এই ‘া’(আ-কার)–এর উচ্চারণের কারণে যারা সোব্বাসি ভাষা জানে না তাদের সোব্বাসি শব্দ উচ্চারণে সমস্যা হতে পারে।
সোব্বাসি শব্দে ‘ই’এবং ‘ি’(ই-কার)–এর ব্যবহার ক্ষেত্রভেদে ‘এ’এবং ‘ে’(এ-কার)–এ বিবর্তিত। যেমন
‘ই’–এর স্থলে ‘এ’: এলেম, এমাম, এজহার, এরাদা, এজারা, এজ্জাত, এজারবান্দ, এংরেজ, এন্তেজাম, এন্তেজার, এন্তেকাল ইত্যাদি।
‘ি’-এর স্থলে ‘ে’: কেরায়া, খেলাফাত, গেলাস, ঘেন, চেকনা, ছেদা, জেকার ইত্যাদি।
সোব্বাসিরা চন্দ্রবিন্দু খুব কমই ব্যবহার করে এবং যেকোনো শব্দ দ্রুত উচ্চারণ করে। যেমনÑ‘চাঁন খার পুল’কে দ্রুত বলে ‘চাংখাকাপোল’। ঠিক তেমনি ‘ঊ-কার’, ‘ঈ-কার’, ‘শ’-এর ব্যবহার কম। ‘শ’, ‘স’Ñ উভয়কেই অধিকাংশ শব্দে ‘স’-এর মতো উচ্চারণ করে।
ঢাকাইয়াদের ভাষা প্রসঙ্গে বেশ কিছু প্রচলিত মত আছে; তার মধ্যে কয়েকটি নিচে দেওয়া হলো:
এক. অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের মতে, মুঘল প্রশাসকদের ভাষা ছিল ফার্সি ও আরবি। জনসাধারণের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের প্রয়োজন হতো না বলে বাংলা ভাষা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা ছিল না। প্রশাসনিক প্রয়োজনে হিন্দুস্তানি ভাষা ব্যবহৃত হতো।
ড. সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ঢাকার ফ্যাক্টর জন বেন ইউরোপীয় নিয়োগকর্তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন স্থানীয় ভাষা শেখার জন্য। যাতে তারা স্থানীয় নিয়োগকর্তা এবং দালালদের কথার প্যাঁচ অথবা চাতুরী ধরতে পারেন। জন বেন একটি কৌশলও শিখিয়েছিলেন। কৌশলটি ছিল হিন্দুস্তানি মিশ্রিত বাংলা ব্যবহারের।
দুই. মউদুদ উর রশীদের মতে, সোব্বাসিরা নবাবদের সহবাসী বা সহচর এবং শৌখিন সংস্কৃতির সেবক। এরা মুঘল আমল ও পরবর্তীকালে ফারসি চর্চা করেছে। এরা কোম্পানি আমলে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেও আরবি-ফারসি ভাষার সঙ্গে একটা সাংস্কৃতিক বন্ধন সর্বদা অটুট রাখার চেষ্টা করেছেন।
তিন. হেকীম হাবীবুর রাহমানের মতে, এরা তারাই যাদের পূর্বপুরুষ দিল্লি এবং আগ্রা থেকে এখানে আগমন করেছিল। তাদের ভাষা উর্দু। আলবত তারা পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গের কোনো গুরুত্ব অনুভব করে না বা গ্রাহ্য করে না। উনি ‘সংগীতের আসর বা চর্চা’ অধ্যায়ে বলেন, ঠুমরি বা খেয়াল হিন্দুস্তানি ভাষার মাধ্যমে গাওয়া হতো। একই অধ্যায়ে অন্যত্র বলেন, এই হোলিসমূহের প্রত্যেকটা দল হিন্দুস্তানি ভাষায় গান গাইত। এমনকি সেই লোকেরাও যাদের মাতৃভাষা একমাত্র বাংলা ছিল তারাও হিন্দুস্তানিতে গাইত। হোলির গান রচনাকারী কবিরা বেশির ভাগ হিন্দু আর অল্পসংখ্যক মুসলমান ছিল।
চার. হাশেম সূফীর মতে, ইংরেজ আমলে উর্দুচর্চার প্রাণকেন্দ্র হলো লক্ষণো, দিল্লি, হায়দ্রাবাদ ও আগ্রা। ফারিসচর্চার বিকল্প হিসেবে উর্দু ১৮৩০ সালের পর ঢাকায় চালু হয়।
পাঁচ. অধ্যাপক আবদুল মমিন চৌধুরীর মতে, উর্দুর প্রসঙ্গ অবান্তর, কেননা উর্দুভাষার জন্ম তখনো হয়নি। পরবর্তী সময় ঢাকার নবাব পরিবার উর্দু ভাষা ব্যবহার করত।
পুরান ঢাকার ভাষা দুই ধরনের—সোব্বাসি ও কুট্টি। দুটিই ঢাকার নগর উপভাষা হলেও, এ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা। শব্দ এবং উচ্চারণে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। এ দুটোকে এক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
যেমন Ñ
১। বাংলা : কুঁজোর আবার চিত হয়ে ঘুমানোর শখ।
সোব্বাসি : কুজাকা ফের চেত হোকে শোনেকা শাওখ।
কুট্টি : গুজারবি আবার চিত অয়া হুইবার সক।
২। বাংলা : কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না।
সোব্বাসি : কোত্তাকা পেটমে ঘি হাজাম হোতানি।
কুট্টি : কুত্তার প্যাটে গি অজম অহে না।
৩। বাংলা : বসতে দিলে ঘুমাতে চায়।
সোব্বাসি : বায়েটনে দেনেসে শোনে মাঙতা।
কুট্টি : বইবার দিলে হুইবার চায়।
হেকীম হাবীবুর রাহমানের যে মত, ‘আলবত তারা পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গের কোনো গুরুত্ব অনুভব করে না বা গ্রাহ্য করে না।’এটা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। সোব্বাসিরা পুং এবং স্ত্রী লিঙ্গ সূচক শব্দ অবশ্যই ব্যবহার করে। যেমন—Ñ
১। বাংলা: আমার বোন ভাত খাবে।
সোব্বাসি: মেরা বাহেন ভাত খাগি।
বাংলা: আমার ভাই ভাত খাবে।
সোব্বাসি: মেরা ভাই ভাত খাগা।
২। বাংলা: মা ডাকছে।
সোব্বাসি: আম্মা/আম্মাজান বোলারাহি।
বাংলা: বাবা ডাকছে।
সোব্বাসি: আব্বা/আব্বাজান বোলারাহা।
৩। বাংলা: তাবরেজ আগামীকাল আসবে।
সোব্বাসি: তাবরেজ আতাকাল আগা।
বাংলা: সীমা আগামীকাল আসবে।
সোব্বাসি: সীমা আতাকাল আগি।
জেমস টেলর ১৮৩৮ সালে ঢাকাবাসীদের ১৬২টি পেশার তালিকা দিয়েছেন। এই অসংখ্য পেশাজীবীর সবাই কোনো একটি সুনির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলত না। নিজেরা নিজেদের মধ্যে এক রকম ভাষায় কথা বলত, কিন্তু হাটে-মাঠে-বাজারে, রাস্তা-ঘাটে একটি সাধারণ কথ্য হিন্দুস্তানি ভাষায় কথা বলত। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি অংশ সোব্বাসি জনগোষ্ঠী। এই সোব্বাসি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত কথ্য হিন্দুস্তানি ভাষার ওপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাষা প্রভাব বিস্তার করেছিল। ১৬১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কে যদি ধরা হয় তাহলে:
১৬১০ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত ফারসি ভাষার প্রভাব,
১৮৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজি, উর্দু ভাষার প্রভাব,
১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত উর্দু ভাষার প্রভাব এবং
১৯৭১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রভাব ছিল।
প্রচলিত যেকোনো কথ্য ভাষার ওপর রাজনৈতিক, সামরিক, প্রশাসনিক, সামাজিক প্রভাব বিদ্যমান থাকে। মুঘল আমলে সোব্বাসিদের প্রচলিত কথ্য ভাষার ওপর তৎকালীন প্রশাসকদের ভাষা ফারসি, আরবির প্রভাব ছিল। এমনকি কোম্পানি আমলে নিমতলির বারোদুয়ারিতে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আনোয়ার পাশা ভবনের অন্তর্ভুক্ত) যখন সোব্বাসি সরদাররা মুঘল নবাব তথা নায়েব নাজিমদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন, তখন ফারসি ভাষায় যে কোনো আলোচনা হতো। কিন্তু সরদাররা মহল্লায়, সমাজে, পরিবারের মধ্যে হিন্দুস্তানি/সোব্বাসি ভাষায় কথাবার্তা বলতেন। আবার ১৮৭৫ সালে যখন খাজা পরিবার ঢাকার নবাব, তখন উর্দুর ব্যাপক প্রভাব ছিল, যা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। আহসান মঞ্জিলে যখন সোব্বাসি সরদাররা খাজা নবাবদের সঙ্গে কথা বলতেন, তখন উর্দু ভাষায় যেকোনো আলোচনা হতো। কিন্তু সরদাররা মহল্লায়, সমাজে, পরিবারের মধ্যে কথা বলতেন, তখন সোব্বাসি ভাষা ব্যবহার করতেন।
১৯৪৭ সালে ভারত থেকে অসংখ্য মুহাজির ঢাকায় প্রবেশ করে, তখন সোব্বাসি ভাষার ওপর এই মুহাজিরদের, যাদের ‘বিহারি’ বলা হয়, তাদের ভাষা উর্দু প্রভাব বিস্তার করেছিল। এখনো অনেককেই ঢাকার এই বিহারি উর্দুর সঙ্গে সোব্বাসি ভাষাকে গুলিয়ে ফেলতে দেখা যায়।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর সোব্বাসি ভাষায় ব্যাপক হারে বাংলা শব্দের প্রবেশ ঘটেছে এবং ঘটছে। ইদানীং ভারতীয় হিন্দি চ্যানেলের সুবাদে হিন্দি শব্দ প্রবেশ করছে। যেমন—Ñ
বাংলা: এর কারণ কী?
সোব্বাসি: ইস্কা ওজা ক্যায়া?
বাংলা/হিন্দি চ্যানেলের প্রভাবে: ইস্কা কারান ক্যায়া?
বাংলা: আমার গর্ব হচ্ছে।
সোব্বাসি: মেরা/হামরা ফাকার/ফাখার মাহেসুস হোরাহা।
বাংলা/হিন্দি চ্যানেলের প্রভাবে: ম্যারা/হামরা গার্ভ হোরাহা।
ভাষা প্রবহমান নদীর মতো; চলার পথে যা পায়, তাকেই সঙ্গী করে সামনের দিকে ধাবিত হয়, পেছনে ফেরার উপায় নেই। প্রতিনিয়তই সোব্বাসি ভাষায় নতুন শব্দের সমাহার হচ্ছে আবার অনেক পুরোনো শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। তথাপি বলা যায়, একটি নাগরিক বা নগর উপভাষা হিসেবে বর্তমানে প্রচলিত সোব্বাসি কথ্য ভাষার যে যাত্রা ঢাকায় ১৬১০ সালে হিন্দুস্তানি কথ্য ভাষা থেকে শুরু হয়েছিল, তা বিভিন্ন ভাষার প্রভাবে বিবর্তিত হয়ে এখনো ঢাকার বুকে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এটি এমন একটি নগর উপভাষা, যাকে বলা যায় একটি মিশ্রিত কথ্য হিন্দুস্তানি উপভাষা থেকে বিবর্তিত আরেকটি মিশ্রিত কথ্য নগর উপভাষা।
* মো. শাহাবুদ্দিন : সম্পাদক, বাংলা-সোব্বাসী ডিক্সেনারি ও বিভাগীয় প্রধান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, সাভার সরকারি কলেজ সাভার, ঢাকা।