হেলাল হাফিজ এবং তাঁর কবিতা—কে কাকে লিখেছে

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—ষাটের দশকের শেষে লিখেছিলেন কবি হেলাল হাফিজ। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ নামের এই কবিতা তাঁকে খ্যাতির তুঙ্গে পৌঁছে দেয়। বাংলাদেশের প্রবল জনপ্রিয় সেই কবি প্রয়াত হয়েছেন ১৩ ডিসেম্বর। তাঁর জনপ্রিয়তার কারণ কী, প্রয়াণের পর কবিকে স্মরণ করে প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা

হেলাল হাফিজ (৭ অক্টোবর ১৯৪৮—১৩ ডিসেম্বর ২০২৪)ছবি: জিয়া ইসলাম

হেলাল হাফিজের বিখ্যাত কবিতাগ্রন্থ যে জলে আগুন জ্বলে বেরিয়েছিল ১৯৮৬ সালে। বইয়ের প্রথম কবিতাটির নাম ছিল ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। বাংলাদেশের প্রায় সব কবিতা পাঠক এই কবিতার প্রথম দুই লাইন মুখস্থ বলতে পারেন: ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। যদিও বইটির অনেকগুলো কবিতাই জনপ্রিয়তা পেয়েছে, কিন্তু প্রথম কবিতার এই দুই লাইন সম্ভবত জনপ্রিয়তার সব মাত্রা অতিক্রম করেছে। মিথ হয়ে ওঠা যাকে বলে। ব্যবহৃত হয়েছে স্লোগানে, দেয়াললিখনে, বক্তৃতায়, বাখোয়াজিতে এবং জনপরিসরে আরও যা যা উপায়ে যৌবন ও সাহসের যুগলবন্দী করা সম্ভব—সব আলাপে।

‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি লেখা হয়েছিল ১৯৬৯ সালে, গণ–অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে। আর ১৯৮৬ সালে হেলাল হাফিজের বইটি যখন বেরোয়, তখন দেশে সামরিক শাসন চলছে। সাহসের বড় সংকট চারদিকে। প্রতিবাদী কবিরা একত্র হয়ে ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’ নামে একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন। ১৯৮৬ সালেই স্বৈরাচার এরশাদের পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাউফুন বসুনিয়াকে গুলি করে হত্যা করে। সে সময় বিক্ষোভ আর প্রতিবাদে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে মানুষ। কাকতালীয়ভাবে হেলাল হাফিজের যে জলে আগুন জ্বলে একই সময়ে বের হলো। তাঁর এই পুরোনো কবিতা নতুন পটভূমিতে সাংঘাতিক রকম প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল।

দেশে তখন আবৃত্তিচর্চার রমরমা। বইমেলায় বইয়ের চেয়ে আবৃত্তির ক্যাসেট বেশি বিক্রি হয়। আবৃত্তিকারেরা কবিদের চেয়েও বড় সেলিব্রিটি। আবৃত্তিযোগ্যতা কবিতার বাছাইয়ের একটা বড় ক্যাটাগরি হয়ে উঠেছে। ফলে মাত্রাবৃত্ত কিংবা স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতা, কিংবা অন্ত্যমিলে লেখা কবিতা অনেক বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে। হেলাল হাফিজের এই বই আবৃত্তিমনা পাঠকের এই খোরাকটুকুও অবিলম্বে মিটিয়ে দিল।

হেলাল হাফিজের অতটা পাবলিক পারসোনা ছিল না। তিনি নানান সমাবেশে কবিতা পড়েছেন, বইমেলায় কিংবা সাহিত্যের অনুষ্ঠানে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে ঘুরেছেন, অটোগ্রাফ দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর উপস্থিতির চেয়ে বেশি উচ্চকিত ছিল তাঁর অনুপস্থিতি। তাঁর কবিতা সবাই পড়ছে, কিন্তু তিনি সর্বত্র নেই। তিনি ছিলেন তাঁর নির্জনতার চিলেকোঠায়।

নানান বিচারে, হেলাল হাফিজের এই বই সে সময়ের কবিতা পাঠকের কাছে ছিল একটা কমপ্লিট প্যাকেজ: দ্রোহ, যৌবন, মিছিল, অন্ত্যমিল, সাহস, প্রেম, বিরহ—সব মিলিয়ে গেল শতকের আশির দশকে বেড়ে ওঠা তারুণ্য হেলাল হাফিজের আয়নায় নিজেকে চিনতে মোটেও ভুল করল না। হেলাল হাফিজে হতাশা আছে, কিন্তু সেটা সত্তরের দশকের আরেক বিখ্যাত কবি আবুল হাসানের মতো ‘অকর্ষিত অমা’ নয়; বরং এই হতাশাসমেত কোনো মিছিলে ছুটে যাওয়া যায়। বিরহ আছে, কিন্তু তার দাওয়াইও আছে, একটা ঠোঁট-ওলটানো ভাবও দেখানো যাচ্ছে এই বলে যে ‘কী আসে যায়’। নিজের ভুল, নিজের ক্ষয়ক্ষতি অবলীলায় মেনে নিয়ে ‘কী আসে যায়’ জেশচারটাই হেলাল হাফিজের পোয়েটিক সিগনেচার। দুঃখের তিমিরে ডুবে থাকার লোক তিনি নন, অতটা তাকে পোষায়ও না, বরং তিনি তার বেদনাকে বলেন, কেঁদো না!

যে জলে আগুন জ্বলে বইয়ের তেত্রিশের বেশি সংস্করণ হয়েছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশের সমসাময়িক কোনো কবিতাগ্রন্থের এতগুলো সংস্করণ আর হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এর পরে হেলাল হাফিজ ২০১২ সালে কবিতা ৭১ নামে এবং ২০১৯ সালে বেদনাকে বলেছি, কেঁদো না নামে আরও দুটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশ করেন। সেসব বই আর আলাদা করে কোনো মাত্রা পেয়েছে বলে মনে হয়নি। দুটো বই–ই তাঁর প্রথম বইয়ের বিস্তরণ। তিনি কবিতার জন্য ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার যখন পান, তখন তাঁর তৃতীয় বইটি প্রকাশিত হয়নি। ২০১২ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় বইটিও কোনো অভিঘাত তৈরি করেনি। অর্থাৎ বাংলা একাডেমিও তাঁকে তাঁর একটি বইয়ের জন্যই এই স্বীকৃতি দিয়েছে। হেলাল হাফিজ তাই, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ওয়ান বুক ওয়ান্ডার’।

হেলাল হাফিজের কবিতা কেন এত জনপ্রিয়? আগেই বলেছি, ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর যে জলে আগুন জ্বলে বইটি একটা কমপ্লিট প্যাকেজ। এই বইয়ে তিনি আবুল হাসানের অনতিক্রম্য বিষাদকে নামিয়ে এনেছেন ঝলমলে বিরহের বাগানে। তাঁরও সাহসী যৌবন আছে, কিন্তু সেটা মোহাম্মদ রফিকের মতো অতখানি বেপরোয়া প্রেমহীন নয়, নির্মলেন্দু গুণের মতো অতটা উদ্বাস্তু-উন্মূল নয়। আবার তাঁর যে প্রেম, সেটা মহাদেব সাহার মতো অতখানি প্রেমাপেক্ষ নয়। তিন চিমটি সাহস, একমুঠো প্রেম আর দুই লিটার বিরহ মিলিয়ে হেলাল হাফিজের জরুরি কবিতা-স্যালাইন; আশির দশকের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত প্রতিবাদী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী তারুণ্যের জন্য এভাবেই তা অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠে।

নিজের হাতে লেখা হেলাল হাফিজের কবিতা

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কবিতা ও আবৃত্তিচর্চার ব্যাপক ভূমিকা ছিল। বলা যায়, এরশাদবিরোধী ন্যারেটিভ প্রায় এককভাবেই কবিতার অঙ্গনে তৈরি হয়েছিল। সেখানে গানের ভূমিকা কম, চিত্রকলারও অতি সামান্য। কামরুল হাসানের ‘বিশ্ব বেহায়া’ চিত্রকর্মটি বাদ দিলে আর তেমন কিছুই স্মরণে পড়ে না। কিন্তু কবিতা প্রচুর হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে আবৃত্তি। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ তখন নাগরিক পরিসরের দখল নেওয়ার সংগ্রাম শুরু করেছে। ফলে স্বৈরাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানুষ নিজেদের সংগঠিত করছে প্রেমের ভেতর, স্মৃতির ভেতর, অকপটতার ভেতর, বিরহের ভেতর এবং সরল অনুপ্রাসের আর অন্ত্যমিলের ভেতর। মানুষের মধ্যে তৈরি হতে থাকা সাংস্কৃতিক সংগঠনটিই আরও কয়েক বছর পর নব্বইয়ে এরশাদকে টেনে নামিয়েছিল।

ফলে হেলাল হাফিজ কেন জনপ্রিয়—এই প্রশ্নের উত্তর কেবল হেলাল হাফিজের কবিতার মধ্যে নিহিত নেই। আশির দশকের রাজনৈতিক-সামাজিক পটভূমিতে হেলাল হাফিজকে আরও নিবিড়ভাবে বোঝার দরকার আছে।

ষাট ও সত্তরের কবিদের মধ্যে বিশেষ ধরনের পোয়েটিক পারসোনা আছে। যেমন নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন কাল্ট পাবলিক ফিগার (এখনো তা–ই), মহাদেব সাহাকে নেহাত অন্ধ লোক ছাড়া আর সবাই কবি হিসেবে চিনতে পারত, শামসুর রাহমান তো বাংলাদেশের একমাত্র ‘পোয়েট লরিয়েট’, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে সেলিব্রিটি, আর আল মাহমুদ রেবেল। ঢাকা শহরে হঠাৎ আপনি দেখছেন, একটা বেবিসাইকেল চালিয়ে আলখাল্লা পরা সাবদার সিদ্দিকি ছুটে চলেছেন রমনায় কিংবা চানখাঁরপুল এলাকায়। ভাবা যায়, শামসুর রাহমানকে নিয়ে আশির দশকে বিচিত্রা প্রচ্ছদ রচনা তৈরি করেছিল, যেখানে তিনি বলেছিলেন, পরকীয়া প্রেমে পাপ নেই! এটাই ছিল পত্রিকার প্রচ্ছদে, শামসুর রাহমানের সুদর্শন চেহারার নিচে টাইটেল হিসেবে। এ কালের কবিরা এসব শুনলে হয়তো চোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। একদা আমাদের কবিরা রকস্টার ছিলেন।

হেলাল হাফিজের যে জলে আগুন জ্বলে কাব্যগ্রন্থটির তেত্রিশের বেশি সংস্করণ হয়েছে

হেলাল হাফিজের অতটা পাবলিক পারসোনা ছিল না। তিনি নানান সমাবেশে কবিতা পড়েছেন, বইমেলায় কিংবা সাহিত্যের অনুষ্ঠানে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে ঘুরেছেন, অটোগ্রাফ দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর উপস্থিতির চেয়ে বেশি উচ্চকিত ছিল তাঁর অনুপস্থিতি। তাঁর কবিতা সবাই পড়ছে, কিন্তু তিনি সর্বত্র নেই। তিনি ছিলেন তাঁর নির্জনতার চিলেকোঠায়, জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন প্রেসক্লাবের তাসের টেবিলে, মনে করিয়ে দিয়েছেন দস্তয়েভস্কির সেই অসম্ভব সংরাগী জুয়াড়ির কথা এবং এভাবে বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম কবি হয়েও থেকে গেছেন লোকচক্ষুর খানিকটা আড়ালে। কবিতার এসব জনপরিসরে তাঁর তুলনামূলক শারীরিক অনুপস্থিতি হেলাল হাফিজ মিথলজিকে আরও স্থায়িত্ব দিয়েছে। আরও আরও আলাপের জন্ম হয়েছে এই ‘অনুপস্থিত’ কবিকে নিয়ে। আমরা ক্রমে বুঝতে পেরেছি, হেলাল হাফিজ কবি হিসেবে যে জলে আগুন জ্বলে লিখেছেন এমনটা নয়, পাশাপাশি তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলোও পরবর্তী সময়ের হেলাল হাফিজের ব্যক্তিগত জীবনের গতিধারা নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ হেলাল হাফিজ ও তাঁর কবিতাগুলো একে অপরকে লিখেছে। তারা মিলেমিশে এমনই একটা জগৎ বানিয়েছে, যেখানে উঁকি দেওয়ার লোভ পাঠক এড়াতে পারেন না।

কিন্তু এটাও সত্য যে হেলাল হাফিজ তাঁর পাঠকদের একটা বিশেষ সময়ের কাব্যপিপাসা মেটান। হেলাল হাফিজ আপনাকে চিরকাল ধরে রাখবেন না, আপনি একসময় মিষ্টি কিছু অনুভবসমেত তাঁর বই থেকে বেরিয়ে আসবেন। জীবনের একটা পর্যায়ে আপনাকে হেলাল হাফিজের স্টেশনে থামতেই হবে। এই যে তাঁর এক মনোমুগ্ধকর স্টেশন, বেড়ে ওঠার একটা সময়ে সব কবিতাপ্রেমী মানুষ যেখানে একপশলা সময় পার করতে বাধ্য, এই মায়াবী জগৎটা তিনি বানিয়েছিলেন। এই মায়াবী জগতের মোহ অনেকের কাটলেও হেলাল হাফিজের নিজের কখনোই কাটেনি। নিজের লেখা এই ঘোরের মধ্যে তিনি তাঁর পুরো জীবনটাই খরচ করে দিলেন। আমরা শুধু হেলাল হাফিজকে ভালোবাসি না, হেলাল হাফিজের কবিতা পড়ার স্মৃতিকেও ভালোবাসি, আমাদের হেলাল হাফিজময় কৈশোরকে মিস করি।