‘লাপাত্তা লেডি’দের অবস্থান কোথায়
কয়েক মাস আগে সিনেমা হলে মুক্তি পায় বলিউডের সিনেমা ‘লাপাতা লেডিস’। তবে কিরণ রাও পরিচালিত এ সিনেমা সম্প্রতি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়ার পর আলোচনায় এসেছে নতুন করে। সেই সূত্রেই এই লেখা।
হিন্দি ‘লাপাত্তা’ শব্দটির অর্থ নিখোঁজ। ‘লাপাত্তা লেডিস’–এর মানে দাঁড়ায়—‘নিখোঁজ নারীরা’। রুপালি পর্দায় নারী নানা মাত্রা ও পর্যায়ে অস্তিত্বহীন, সিনেমাটিক ‘ন্যারেটিভ’ বা চলচ্চিত্রিক বয়ানে তাঁদের ‘এজেন্সি’ শূন্যের কাছাকাছি। ‘এজেন্সি’ শব্দটি এখানে বয়ান দেওয়ার ক্ষমতা হিসেবে প্রযুক্ত। ইতালির তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে বয়ান দেওয়ার ক্ষমতা নেই—এমন মানুষদের বলছেন ‘সাব-অল্টার্ন’ বা নিম্নবর্গীয়, যাঁরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভূতাত্ত্বিকভাবে ক্ষমতাক্রমের এক্কেবারে নিচে অবস্থান করেন। আর ঔপনিবেশিক শাসক প্রথমেই তাঁদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে বাতিল করে ছুড়ে ফেলেন আস্তাকুঁড়ে।
তাহলে নারী, যিনি কিনা যেকোনো আর্থসামাজিক অবস্থানেই নিম্নবর্গ, তাঁর কথা কে বলবে?
একজন বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, রাজনীতিবিদ বা মানবাধিকারকর্মীও যখন নিম্নবর্গের কথা বলতে যাচ্ছেন, তখন সেই বয়ানের অধিপতি বনে যাচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিম্নবর্গের ‘এজেন্সি’ নিয়ে তিনি বা তাঁরা বিস্তার করছেন সাংস্কৃতিক আধিপত্য। ভারতীয় তাত্ত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বলছেন, অনেক মানুষই সাব-অল্টার্নিটি (বয়ানহীনত্ব) দাবি করতে চায়। তারা সবচেয়ে কম আকর্ষণীয় এবং বিপজ্জনক। বিষয়টা স্পষ্ট করতে গায়ত্রী ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিদ্বেষের শিকার সংখ্যালঘু হলেই আপনি “সাব-অল্টার্ন” নন। প্রথমে বুঝতে হবে, এখানে বিদ্বেষের কৌশলটা কী। তাঁরা আধিপত্যমূলক মতবাদের মধ্যেই আছেন, পিঠার টুকরা চাইছেন, কিন্তু তাঁদের তা দেওয়া হচ্ছে না। কাজেই তাঁদের কথা বলতে দিন, আধিপত্যের মতবাদকে ব্যবহার করুন। তাঁদের নিজেদের সাব-অল্টার্ন বলা উচিত নয়।’
তাহলে কি হায়দরাবাদের নিজামের ঘনিষ্ঠ সামন্ত ও পরবর্তীকালে ভারত সরকারের কূটনীতিকের পৌত্রী কিরণ রাও, যিনি বেড়ে উঠেছেন কলকাতায় এবং মুম্বাই ও দিল্লির শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন, তিনি আড়াই হাত লম্বা ঘোমটার পেছনে নিখোঁজ নারীদের বয়ান তুলে ধরতে সক্ষম?
‘লাপাতা লেডিস’—নববধূ অদলবদল ও তৎ–সংক্রান্ত নাটকীয়তা যে ‘নির্মল প্রদেশ’-এ ঘটছে, তা ভারতের মধ্যপ্রদেশের কথাই মনে করিয়ে দেয়, যেখানে মোট জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশই দলিত জনগোষ্ঠীর, যারা ভারতের সবচেয়ে অবহেলিত জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত।এখানে বলে রাখা দরকার, বলিউডি সিনেমায় আজকাল দলিতের উপস্থিতি বেশ বাড়ছে। কদিন আগের আলোচিত সিনেমা ‘টুয়েলফথ ফেইল’-এরও কেন্দ্রীয় চরিত্র দলিত। ‘লাপাতা লেডিস’–এও সব প্রচলিত চরিত্ররা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ইউজুয়াল সাসপেক্টস’, যথারীতি উপস্থিত—নিষ্পাপ নববধূ, চতুর নববধূ, বোকা ‘ভালো মানুষ’ স্বামী, নিষ্ঠুর পুরুষালি স্বামী, হালকা টুইস্ট–সংবলিত কপট পুলিশ এবং সিনেমার বিবেকরূপী দাপুটে পৌঢ়া। আর এ সিনেমায় সবকিছুই যেন দৈব হস্তক্ষেপে ঘটতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সবকিছু সুন্দরমতো মিলেও যায়।
এই চলচ্চিত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, তা হলো ‘কন্ডিশনিং’ বা ধারাবাহিক নির্দেশনার মাধ্যমে আচরণ ও অবস্থানগত যে স্থায়ী পরিবর্তন আনা হয়। বিষয়টাকে সহজ করে বললে বলা যাবে, এটা এমন এক অদৃশ্য ব্যবস্থা যার মাধ্যমে আমজনতাকে চেতনাগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে আলোচ্য ছবির ফুল চরিত্রের কথা বলা যায়। ফুল বলে, তাকে তার মা ‘ভালো মেয়ে’ বানিয়েছে; তখন মঞ্জু মাই নামের অন্য এক চরিত্র বলে, ‘ভালো মেয়ে’ নয়, ‘বোকা’ বানিয়েছে। এই যে ‘ভালো মেয়ে’, সমাজের চোখে তার রূপ কেমন?
সিনেমায় দেখানো হয়, ‘ভালো মেয়ে’ হলো আজ্ঞাবহ, বিনীত ও পতিব্রতা। সে স্বামী-শ্বশুরবাড়ির কথায় ওঠে-বসে; পরিবারের ‘সম্মান’ রক্ষায় সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় থাকতেও রাজি, কিন্তু বাড়ি ফিরে যাবে না। এমন ‘ভালো মেয়ে’দের জন্য উপার্জন করতে চাওয়াটাও ‘প্রিভিলেজ’ বা বিশেষ সুবিধা দেখানো হয়। আবার মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও পড়াশোনার স্বপ্নকে দেখা হয় ‘দণ্ডনীয় অপরাধ’ হিসেবে। এই বাস্তবতায় মঞ্জু মাই বলে, নারীর আসলে পুরুষকে কোনো প্রয়োজন নেই। এটা যদি নারী বুঝে ফেলে, তবে তো পুরুষদের জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। তাই নারীকে তারা ‘ভালো মেয়ে’ বানিয়ে রাখে। লাপাতা লেডিস’ নামের পুরো সিনেমাতেই নারীবাদের এমন সব শহুরে টোটকা টক-ঝাল-মিষ্টি ঝালমুড়ি মাখার মতোই উপস্থিত, যা জিবে স্বাদ জাগায়, কিন্তু পেট ভরায় না।
আপনি যদি একজন অধিকারসচেতন স্বনির্ভর নারী হন, তাহলে এ সিনেমা দেখে আপনি হয়তো অজান্তেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবেন যে যাক বাবা আমি অন্তত নিজের জীবনের বড় সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারি; আর পুরুষেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন, যাক আমাকে নারী হয়ে জন্মাতে হয়নি। এই ক্ষণকালীন স্বস্তি দিয়েই সিনেমার চরিত্ররা রূপকথার মতোই ‘সুখে–শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল।’
আপনি যদি একজন অধিকারসচেতন স্বনির্ভর নারী হন, তাহলে এ সিনেমা দেখে আপনি হয়তো অজান্তেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবেন যে যাক বাবা আমি অন্তত নিজের জীবনের বড় সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারি; আর পুরুষেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন, যাক আমাকে নারী হয়ে জন্মাতে হয়নি। এই ক্ষণকালীন স্বস্তি দিয়েই সিনেমার চরিত্ররা রূপকথার মতোই ‘সুখে–শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল।’ নির্মাতাও হয়তো শহুরে সংবেদনশীলতার চোখে দেখা গ্রামীণ অর্থনৈতিক বৈষম্য আর নারীবিদ্বেষের সুনিপুণ সমালোচনা করতে পেরেছেন ভেবে বেশ একটু নিজের পিঠ চাপড়ে দেওয়ারই অবকাশ পাচ্ছেন; কিন্তু শত শত বছরের পিতৃতন্ত্রের নিচে চাপা পড়ে থাকা নারী চরিত্রের গৎবাঁধা অসহায়ত্ব, ক্ষমতাকাঠামোয় অনেকটা স্বীকৃত অবনত অবস্থান এবং একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকার পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা পর্দায় দেখিয়ে তিনি কি নারীর এ অবস্থানকেই আরও পোক্ত করছেন না?
ধর্মীয় কিতাব, ছাপা বই, পত্রিকার নিবন্ধ, চলচ্চিত্র, বেতার বা টেলিভিশন—কোনোটিই নিম্নবর্গের মানুষের কথা বলার যথার্থ মাধ্যম হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ, প্রতিটি মাধ্যমেই অন্য কেউ বলছে। অথবা একটা পরিপূর্ণ মহাবয়ানের সঙ্গে জৈব সম্পর্ক বহাল রাখতে সেখানে আপনার বয়ানটুকু সম্পাদনা করা হচ্ছে। এই মাধ্যমগুলোর কাজের ধরণই এমন। নব্য গ্রামসীয় তত্ত্বে ‘পপুলার কালচার’ বা জনসংস্কৃতি হচ্ছে সেই ক্ষেত্র, যেখানে সমাজের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পক্ষের শক্তিগুলোর সমন্বিতকরণ আর শোষিত গোষ্ঠীর প্রতিরোধের মধ্যে ক্রমাগত সংঘাত চলছে। জনসংস্কৃতির বিস্তারিত ক্যানভাসের মধ্যে প্রকাশ ঘটে নিম্নবর্গের আচার, জীবনাচরণ, সর্বোপরি তার মনের। আর জনসংস্কৃতির পরিসরের মধ্যে নিম্নবর্গের অস্তিত্বের উদ্যাপনও ঘটে থাকে। যে অস্তিত্ব ক্রমাগত অভিঘাতে জীর্ণ ও পরাস্ত, সেই অস্তিত্বের টিকে থাকার লড়াইয়ে উদ্দীপনা জোগায় জনমুখী সংস্কৃতি এবং তার ওপর প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য নানামাত্রিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকেন ক্ষমতাকাঠামোর ওপরের দিকে থাকা মানুষজন। অনেক আগ থেকেই খেলাটা এ ছকে হয়ে আসছে। সেই খেলায় ‘লাপাত্তা লেডিস’-এর অবস্থান কোথায়, তা নির্ধারণের ভার এখন পাঠকদের ওপরই ছেড়ে দিতে চাই।