ফিলিস্তিনের পক্ষে কেন ‘শিবির প্রতিবাদ’–এর ধরন বেছে নিলেন মার্কিন শিক্ষার্থীরা
গেল মাসে নিউইয়ের্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ লনে ফিলিস্তিনের পক্ষে ‘গাজা সংহতি শিবির’ গড়ে তুলতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর সেই প্রতিবাদ ছড়িয়ে গেল দাবানলের মতো। ‘এনক্যাম্পমেন্ট প্রোটেস্ট’ বা ‘শিবির প্রতিবাদ’ নামে এই প্রতিবাদ এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে শত শত বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শুধু বিঘে–দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’
—দুই বিঘা জমি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূখণ্ডের অধিকার সব সময়ই ক্ষমতার প্রতীক। আর তাই যার ভূমির অন্ত নেই, সেই ভূপতিও উপেনের মতো দরিদ্রের দুই বিঘা জমিও দখলে নিতে চায়। কাজেই একটি স্থান কার দখলে আছে, তা যেকোনো আর্থ–রাজনৈতিক সমীকরণে একটা বড় নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ফিলিস্তিনপন্থী প্রতিবাদও স্থানিক। মার্কিন শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের ধরনকে বলা হয় ‘এনক্যাম্পমেন্ট প্রোটেস্ট’ বা ‘শিবির প্রতিবাদ’। আর এই ‘শিবির প্রতিবাদ’ ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বজুড়ে শত শত বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেন প্রতিবাদের এ ধরন বেছে নিলেন মার্কিন শিক্ষার্থীরা?
নিউইয়ের্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ লনে ১৭ এপ্রিল ‘গাজা সংহতি শিবির’ গড়ে তুলতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা যখন একের পর এক তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মিনোশ শাফিক মার্কিন কংগ্রেসে কলাম্বিয়ায় ইহুদিবিদ্বেষ মোকাবিলার বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন। ১৮ এপ্রিল ‘গাজা সংহতি শিবির’ ভেঙে দিয়ে শিক্ষার্থীদের হটিয়ে দিতে নিউইয়র্ক পুলিশকে অনুমোদন দেন শাফিক। দাঙ্গা মোকাবিলার সরঞ্জাম নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। ব্যাপক ধরপাকড় চালানো হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের দমানো যায়নি। শিবির ছেড়ে যাননি তাঁরা। ৩০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যামিল্টন হল দখল করে নেন শিক্ষার্থীরা এবং এর নাম দেন ‘হিন্দ হল’, সেই ছয় বছরের ফিলিস্তিনি বালিকার স্মরণে, গাজা থেকে পালাতে গিয়ে ইসরাইলি বিমান হামলায় গাড়িতেই যার প্রাণ যায়।
১৯৬৮ সালেও একইভাবে হ্যামিল্টন হল দখল করে নিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। তখন এর নাম দেওয়া হয় ‘ম্যালকম এক্স হল’। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন তাঁরা।
ঐতিহাসিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গ কর্মজীবীপাড়া হিসেবে পরিচিত হারলেমের সঙ্গে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা করে রেখেছিল মর্নিংসাইড পার্ক। সেই ভূখণ্ডে ব্যায়ামাগার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়টি, যেখানে শিক্ষার্থী–কর্মী এবং হারলেমের বাসিন্দাদের জন্য রাখা হয় পৃথক প্রবেশপথ। শুধু তাই নয়, হারলেমবাসী কেবল একটি তলাতেই প্রবেশাধিকার পাবেন। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা তখন আাবিষ্কার করেন, সমরাস্ত্র গবেষণা ও কৌশল নির্ধারণে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করছে তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
অ্যামহার্স্ট কলেজের অধ্যাপক স্টেফান এম ব্র্যাডলি ১৯৬৮ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যায়ের শিবির প্রতিবাদের বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর বই ‘হারলেম ভার্সেস কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি: ব্ল্যাক স্টুডেন্ট পাওয়ার ইন দ্য লেট নাইনটিন সিক্সটিজ’–এ। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরেই আশপাশের জমি কিনে নিচ্ছিল আর হারলেম স্থান সংকোচন আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছিল। যখন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস দখল করে নেয়, তখন যেন উল্টে গেল ক্ষমতার ছক। ব্র্যাডলি বলেন, ‘আপনি “স্থান” শব্দটি বাদ দিয়ে দিন আর সেখানে বসিয়ে দিন “ক্ষমতা”। ক্যাম্পাসের মালিকানা নিয়ে, তরুণরা স্থানটি দখল করে নিয়েছে এবং দখল করে নিয়েছে ক্ষমতাও।’
১৯৮৫ সালেও এই ঘটনার পৃনরাবৃত্তি ঘটে। তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরোধীতায় তিন সপ্তাহের জন্য ক্যাম্পাস দখল করেন শিক্ষার্থীরা, হ্যামল্টন হলের নামকরণ তখন করা হয় ম্যান্ডেলা হল। সে সময় দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা, যেমন এখন ইসরায়েলের সঙ্গে যেকোনো ধরনের বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জোর দাবি জানানো হচ্ছে।
‘শিক্ষার্থী আন্দোলনের এই পুনরাবৃত্তি আমাদের বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্যে যে সংযোগ রয়েছে, তা বুঝতে সাহায্য করে।’—বলছিলেন স্থাপত্যের রাজনৈতিক দিক বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াই থিংক ট্যাংকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ক্রুজ গার্সিয়া। তিনি বলেন, ‘হারলেমে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বাস্তুচ্যুতি, ভিয়েতনামে যুদ্ধ, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ কিংবা ফিলিস্তিনে নাকবা—এই সমস্ত আন্দোলনেই একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি আর চেতনা উন্মুক্ত হয়।’
স্থান হিসেবে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আলাদা গুরুত্ব বহন করে। আদর্শিকভাবে এটি এমন একটি স্থান যা বৈচিত্র্য ও বহুমতকে ধারণ করে। যেখানে স্বাধীন মতপ্রকাশকে উৎসাহিত করা হয়। কাজেই শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক মতাদর্শ তুলে ধরার অধিকার এখানে স্বীকৃতি পাবে এমনটা ধরে নেওয়া যায়।
‘শিক্ষার্থী আন্দোলনের এই পুনরাবৃত্তি আমাদের বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্যে যে সংযোগ রয়েছে, তা বুঝতে সাহায্য করে।’—বলছিলেন স্থাপত্যের রাজনৈতিক দিক বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াই থিংক ট্যাংকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ক্রুজ গার্সিয়া। তিনি বলেন, ‘হারলেমে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বাস্তুচ্যুতি, ভিয়েতনামে যুদ্ধ, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ কিংবা ফিলিস্তিনে নাকবা—এই সমস্ত আন্দোলনেই একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি আর চেতনা উন্মুক্ত হয়।’
কিন্তু আদর্শিক অবস্থান থেকে বাস্তবতা অনেক দূরে। ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীদের ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে গণবহিষ্কার করেছে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
গাজায় এখন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অবশিষ্ট নেই। হামাসকে নিশ্চিহ্নের লক্ষ্যে অব্যাহত ইসরাইলি বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজা উপত্যকা। বাস্তুহারা মানুষেরা আশ্রয় নেওয়ায় তাঁবুর শহরে পরিণত হয়েছে দক্ষিণ গাজার শহর রাফাহ। বিশ্বজুড়ে শত শত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রতিবাদের তাঁবুগুলো কি গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের অস্বস্তিকর সত্যের দিকে বিশ্বকে নজর ফেরাতে বাধ্য করছে? গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েলি দখলদারত্ব ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে ‘শিবির প্রতিবাদ’ তাই যেকোনো রূপকেই অর্থবহ হয়ে ওঠে।