সংগ্রামে ও লেখায় সাহসিকা যিনি

বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনগুলোয় কবি সুফিয়া কামাল যেমন ছিলেন সামনের সারিতে, তেমনি সেই প্রতিবাদী উত্তাপ ছিল তাঁর লেখাতেও। ২০ জুন এই মহীয়সীর জন্মদিন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

সুফিয়া কামাল (২০ জুন ১৯১১—২০ নভেম্বর ১৯৯৯)
ফাইল ছবি

কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হননি সুফিয়া কামাল। কিন্তু অবরুদ্ধ, নিষ্পেষিত জীবনে সজীব প্রাণের প্রবাহ বইয়ে দিতে ছিল তাঁর অন্তহীন প্রয়াস। যোগ দিয়েছেন প্রধানত নারীদের সংগঠনে, সভায়, মিছিলে। সমান গুরুত্ব দিয়েই নেতৃত্ব দিয়েছেন কবি-সাহিত্যিকদের সভা ও সেমিনারে। এসবের সঙ্গে সঙ্গে সুফিয়া কামাল কবি হিসেবেও খ্যাতিমান ছিলেন। বিভিন্ন সময় তাঁর কবিতায় উদ্ভাসিত হয়েছে লড়াই–সংগ্রাম ও প্রতিরোধ–প্রতিবাদের বিষয়–আশয়।

১৯৪৭ সালে সুফিয়া কামাল বেগম পত্রিকার সম্পাদনা করেছিলেন। ঢাকায় বেগম প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সাল থেকে। ১৯৫৪ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ‘বেগম ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করলেন। শামসুন্নাহার মাহমুদের সভানেতৃত্বে এই ক্লাবের প্রধান সংগঠক ছিলেন কবি ও সমাজসেবী সুফিয়া কামাল। পূর্ব পাকিস্তানের নারীসমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই ক্লাবের মাধ্যমে সে সময় সাধারণ গৃহিণীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

সুফিয়া কামাল সচেতন ছিলেন, যাতে দলীয় রাজনীতির সাংগঠনিক কাজে জড়িয়ে না পড়েন। কিন্তু রাজনীতিসচেতন মানুষ ছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের আইনসভার নারী প্রার্থীদের সমর্থনে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, নারীরা প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হবেন, দেশ ও মানুষের কথা বলবেন, নারীদের জন্য আইন প্রণয়ন করবেন।

এর আগে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারি, রাষ্ট্রভাষা ও শহীদ মিনার নিয়ে তিনি লিখেছেন ৬৫টি কবিতা। এসব কবিতার কিছু কিছু তাঁর বইয়ে স্থান পেয়েছে, কিছু অগ্রন্থিতও থেকে গেছে। নিচে থাকল এ রকমই অগ্রন্থিত একটি কবিতা:

‘বাংলা মায়ের বুকের দুলাল

বাংলা মায়ের আশা

তাদের মুখে গানের মতো

ছন্দ মধুর ভাষা।

এই ভাষাকে রাখতে গিয়ে

শহীদ হল যারা,

বাংলাদেশের গানে গানে

রইল বেঁচে তারা।

তাদের তরে কান্না ত নয়

কণ্ঠে জাগাও সুর,

শহীদ বীরের বন্দনাতে

পরাণ ভরপুর।’

(আপন ভাষা)

সেই সময়ের পাকিস্তানি সরকারের শাসনামলে একপর্যায়ে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসের ছুটি বাতিল করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় একুশের শোভাযাত্রা, বহু ছাত্র–ছাত্রীকে ভরা হয় জেলে। সরকারের এই সব স্বৈরাচারী পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানাতে সুফিয়া কামাল সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহ্বান জানান, নেতৃত্ব দেন সভায়, মিছিলে।

১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কায়েম ছিল সামরিক স্বৈরশাসনের অত্যাচার, নির্যাতন ও ভয়–ভীতির রাজ্য। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনীতি, সেমিনার, সভা করা ছিল নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবী ও বুদ্ধিজীবীরা সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠান পালনে ঐক্যবদ্ধ হলেন। সামরিক সরকারের পদস্থ প্রতিনিধি ও ধর্মীয় ব্যক্তিরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে এই উদ্যোগ থেকে সরে আসতে বললেন। কিন্তু সুফিয়া কামাল অসমসাহসে সব বাধা তুচ্ছ করে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বয়স তখন ৫০ বছর। কাজী মোতাহার হোসেন, দার্শনিক গোবিন্দচন্দ্র দেব, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, বিচারপতি এস এম মুর্শেদ, সন্​জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক প্রমুখ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিসহ আরও অনেকে তাঁকে মধ্যমণি করে এই কর্মযজ্ঞে সক্রিয়ভাবে শামিল হলেন। সে সময় চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমেদ ধমকের সুরে সুফিয়া কামালকে বলেছিলেন, ‘ইয়ে সব কেয়া হো রাহা হ্যায়?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সারা পৃথিবীতে যা হচ্ছে, এ-ও তা-ই।’

কলকাতার জীবনের পাট চুকিয়ে ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (আজকের বাংলাদেশ) চলে আসার পর সুফিয়া কামালের যে সক্রিয় সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবী জীবনের সূচনা, তা অব্যাহত থাকে বিশ শতকের ষাট, সত্তর, আশি ও নব্বই দশক পর্যন্ত অবিচ্ছেদ্যভাবে। এই যে দীর্ঘ সময়পরিসর, সেই সময়জুড়ে তিনি দেখেছেন সরকার ও নানা রাজনৈতিক দলের ভালো এবং মন্দ, সমাজ ও সংস্কৃতির এগিয়ে যাওয়া, পিছিয়ে যাওয়া। যেমন দেখেছেন বাঙালি জাতির উত্থানের পর্বটিকে, তেমনি তাঁকে অবজ্ঞা করার ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর ‘বাহান্ন থেকে চৌষট্টির পরিক্রমা’ শীর্ষক কবিতায় ধরা আছে বাঙালির প্রতি সে সময়ের সরকারের অবজ্ঞার বিষয়টি। সেই কবিতা থেকে কিছু অংশ:

‘ইউনিভার্সিটির আস্তর পড়ে খসে,

ইনজিনিয়ার ইন্সিটিউট নিত্য নৃত্যরসে

উচ্ছল হয়ে হাসে,

মহাজন হেরে, অভাজন যারা 

ভিড় করে থাকে রমনা 

গেটের পাশে।

হাসপাতালেতে হাঁস ফাঁস করে রুগীরা 

রাত্রি দিন, 

ষ্টেটবাস, আর টাউন বাসের আওয়ায 

নহেত ক্ষীণ।

দু’নম্বর আর পাঁচ নম্বর বাসে করে কোনো

ঠা ঠা পড়া দুপুরেতে

ওই পথ দিয়ে যেতে—

শহীদ মিনার হয়নি ত, পাঁচ কঙ্কাল খাড়া হলো,

দেখে হবে মন বেদনা আতুর, 

চোখ হবে ছলোছলো।

রাস্তায় যেতে ধাঁধা লাগে চোখে, কোথা যে এলাম 

পড়ে না মনে,

ফুলার রোড-এর মাথায় এসেছি? 

এসেছি কি লণ্ডনে?

ইংলিশ রোড মুখ ভ্যাঙ্গচায়? 

বাঙ্গালী রোড কই?

বাংলা দেশেতে এখনও আমরা 

প্রধান হলাম কই?’

(বাহান্ন থেকে চৌষট্টির পরিক্রমা)

কবি কথা বলতেন কবিতায়, প্রতিক্রিয়া জানাতেন কবিতায়। মনে–প্রাণে, নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে তিনি যে কবি ছিলেন!

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের (১৯৬৫) পর দেশের মানুষ সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে সম্পদ পাচার করে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাপক উন্নতি করা হলেও এ প্রদেশের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান সরকার কিছুই করেনি। এই বাস্তবতায় একদিকে তখন দেশ রক্ষার ডাক, অন্যদিকে বাঙালির অধিকার ও বঞ্চনার জন্য প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছিল দেশজুড়ে। এ ক্ষেত্রেও সুফিয়া কামালের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।

শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে দেখতেন। আওয়ামী লীগের ছয় দফা পেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক আলোড়নের সূচনা হয় (১৯৬৬)। শেখ মুজিব মনে–প্রাণে বিশ্বাস করতেন, পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির স্বাধীনতা প্রয়োজন। সুফিয়া কামাল এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলতেন, মিছিলে যোগ দিতেন।

১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ বহুজনকে বন্দী করা হয় এবং ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুবের সামরিক সরকার তাঁদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। সে সময় সুফিয়া কামাল নীরব থাকেননি। বন্দিমুক্তি আন্দোলনে যোগ দেন। বিবৃতিতে তাঁর স্বাক্ষর থাকত শীর্ষে। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের দেওয়া ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধি তিনি ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের সময় ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন।

উনসত্তর থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়জুড়ে দেশের সংস্কৃতি বিকাশের আন্দোলনে সুফিয়া কামালের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি নারী, ছাত্র, যুব, শিশু, কিশোর ও তরুণ সম্প্রদায়ের লড়াই ও স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামও তিনি সামনের সারিতে ছিলেন।

কালি আর কলম ছিল সুফিয়া কামালের অস্ত্র। রাজপথ ছিল তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা। যদি ‘না’ বলেছেন, তবে সেই ‘না’র কথা লিখেছেন। আর যদি ‘হ্যাঁ’ বলেছেন, লিখেছেন তার কথাও। বাস্তবে তিনি এর প্রমাণ রেখেছেন পদে পদে।

‘ঊনসত্তরের এই দিনে’ কবিতায় বলেছেন:

‘মুক্তিকামী সংগ্রামী যাহারা

তাহাদের সাথে রব চিরদিন।...’

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, ১৯৬০-এর দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। আবার ১৯৭২ থেকে শুরু হওয়া প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে, ১৯৭৫ থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত অব্যাহতভাবে গণতন্ত্রের বিজয় অর্জনের আন্দোলনেও ছিল তাঁর অপরিসীম ভূমিকা।

অর্থাৎ মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনে থেকে এবং নিজের কবিতায়, লেখায় সেই মানুষের কথা লিখেই সুফিয়া কামাল হয়ে উঠেছিলেন জননী সাহসিকা।

সুফিয়া কামালের প্রতিটি দিন ও মুহূর্তের কর্মকাণ্ড লিপিবদ্ধ করলে তাঁর কবিতা বোঝার ক্ষেত্রে তা যেমন কাজে লাগবে, একইভাবে নতুন আলোকে উদ্ভাসিত হবে বাংলাদেশের ইতিহাস।