ভাষা কি সত্যি পাল্টে যাচ্ছে, পিও?

‘নাটক কম করো পিও!’-এর মতো ভাষা আর শব্দের নতুন ব্যবহার এবং নতুন ধরনের বাঁকবদল দেখা গেছে সাম্প্রতিক ছাত্রদের আন্দোলনে। সেই সূত্রেই প্রশ্ন আসছে যে ভাষা কি এবার সত্যিই পাল্টে যাচ্ছে?

ছাত্রদের আন্দোলনে ‘নাটক কম করো পিও’ কথাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরে বিভিন্ন দেয়ালেও এই ভাষা স্থান করে নেয়ছবি: সংগৃহীত

‘নাটক কম করো পিও!’

‘হাউন আংকেলের ভাতের হোটেল!’

‘কাউয়া কাদের!’

‘আওয়াজ উডা! কথা ক!’

ভাষা আর শব্দের এমন অজস্র নতুন নতুন বাঁকবদল দেখলাম আমরা গত কিছুদিনে। প্রচলিত শব্দের নতুন ভোকাবুলারি বা শব্দভান্ডার, নতুন বানান, রাস্তার কথ্য ভাষা, গালি, স্ল্যাং, তুই তোকারি প্রচুর ব্যবহৃত হয়েছে সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার মুখে। স্লোগান ও গ্রাফিতিতেও ছিল ভিন্নতা ও নতুনত্ব। বিপ্লবের সময় ভাষার এই বাঁকবদল নতুন কিছু নয়। আমরা জানি যে ইউরোপে শিল্পবিপ্লব আমূল বদলে দিয়েছিল ইংরেজি ভাষাকে। মূলত জার্মান ও লাতিননির্ভর ইংরেজি ভাষা পরিবর্তিত হয়ে নিয়েছিল একেবারেই নতুন এক অ্যাংলো-স্যাংক্সন কথ্য ভাষার আঙ্গিক। আর এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা ইন্টারনেট ও স্মার্ট প্রযুক্তি যে এই প্রজন্মের ভাষা একেবারেই পাল্টে দিয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এখন নেট–দুনিয়ায় কত যে শব্দ দেখা যায়, যার সব অর্থ আমরা বুঝতেও পারি না ঠিকঠাক। সাম্প্রতিক এই আন্দোলন আর আন্দোলনকারী প্রজন্মকে বুঝতে হলে তাদের ভাষা, নতুন শব্দ, নতুন মকারি আর নতুন সংস্কৃতিকেও বোঝা দরকার।

অবাক ব্যাপার যে মূলত এই কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমে এক দফার সরকারবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপকতায় পৌঁছানোর পেছনেও রয়েছে এই ভাষা আর শব্দের ব্যবহার। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ শব্দ দুটি অকস্মাৎ এক বিস্ফোরণমূলক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে আন্দোলনকারীদের মধ্যে। প্রশ্ন হলো, গত পঞ্চাশ বছরে বহুল ব্যবহৃত এবং অপব্যবহৃত এই শব্দদ্বয় কেন এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল? এর কারণ বুঝতে হলে আমাদের ‘জেনারেশন মি’ বইয়ের লেখক ও গবেষক জেন এম টুইয়েঞ্জের কথা শুনতে হবে। তাঁর ‘আইজেন: হোয়াই টুডেজ সুপার কানেক্টেড কিডস আর গ্রোয়িং আপ লেস রেবেলিয়াস, মোর টলারেন্ট, লেস হ্যাপি অ্যান্ড কমপ্লিটলি আনপ্রিপ্রেয়ার্ড ফর অ্যাডাল্টহুড’ প্রবন্ধে জেন এম টুইয়েঞ্জ বলেছেন জেন-জির ধীর মানসিক বিকাশ, অনিরাপদ মানবিক সংকট, বিচ্ছিন্ন থাকার প্রবণতা এবং সামনাসামনি পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরির ব্যর্থতা ইত্যাদি নানা প্রকৃতির মধ্যে একটা বড় গুণ হলো তারা কোনো প্রকার বিভাজনে বিশ্বাসী নয়। হিন্দু-মুসলিম, খ্রিষ্টান-ইহুদি, হিজাব-জিনস, দাড়ি-ট্যাটু, সাদা-কালো —এসব পরিচয় তাদের কাছে গুরুত্ব বহন করে না। বরং তারা ‘কমন ইন্টারেস্ট’ ও নিজস্ব পছন্দে গুরুত্ব দেয় বেশি। যেমন বিটিএসের সংগীত বা ভ্যালোরেন্ট গেম। সে কারণে এ দেশের বহুল প্রচলিত ‘মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার’ বাইনারিও তারা সশব্দে প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিল। জেন টুইয়েঞ্জ আরও দেখিয়েছেন যে এ ধরনের আক্রমণাত্মক ও বৈষম্যমূলক বক্তব্যে তারা সাধারণত খেপে যায় এবং এই প্রবণতার নাম তিনি দিয়েছেন ‘হেয়ার ট্রিগার্ড সেনসিটিভিটি’ বা চুল খাড়া হয়ে যাওয়ার মতো সংবেদনশীলতা। এদের উদ্দেশ্যে এ ধরনের বক্তব্য বা মন্তব্য করা খুবই বিপজ্জনক। নতুন প্রজন্মকে বুঝতে পারার এই ব্যর্থতা থেকেই আসলে আগুনের সূত্রপাত। একইভাবে পরদিন হাজার হাজার ছাত্রের কণ্ঠে নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে পাল্টা স্লোগানের অর্থ বুঝতেও আমাদের অনেকে ব্যর্থ হয়েছেন। সেটা ছিল আসলে একটা প্রতিবাদী বক্রোক্তি। ‘রাজাকার’ শব্দের প্রচলিত বাগাড়ম্বরময় বয়ানকে ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা।

জেন-জি প্রজন্মের একটি জনপ্রিয় মিম
ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের তিন দশক বা চার দশক পর জন্ম নেওয়া প্রজন্মকে যে পুরোনো বিভাজন তথা মুক্তিযুদ্ধের একতরফা বয়ান দিয়ে আর ভাগ করা যাবে না—এই সাধারণ বিষয়টি বুঝতে পারেনি আওয়ামী লীগ। এমনকি যাঁরা এর সমালোচনা করেছিলেন, নিতে পারেননি ছাত্রদের পাল্টা স্লোগান, তাঁদেরও তারা বিপুলভাবে প্রত্যাখ্যান করতে থাকে। নতুন প্রজন্মের ভাষায় এই ধারার নাম ‘ক্যানসেল কালচার’ বা বাতিল সংস্কৃতি।

ক্যানসেল কালচার শব্দটির জন্ম ২০১৬ সালে। এর অর্থ অনলাইন বা ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে বহু মানুষের সম্মিলিতভাবে কোনো আইডিয়া বা কোনো ব্যক্তিগোষ্ঠীকে বাতিল বলে প্রতিপন্ন করা। পশ্চিমা বিশ্বে হ্যাশট্যাগ মিটু বা ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স আন্দোলনে এই ক্যানসেল কালচার বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যানসেল কালচার কখনো কখনো কর্তৃপক্ষের ক্ষতিকর ও আপত্তিকর বিষয়ের বিরুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য অস্ত্র হিসেবে কাজ করলেও অনেক ক্ষেত্রেই এটি হয়ে ওঠে আক্রমণাত্মক ও বিষাক্ত। ২০২০ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই প্রজন্মের ক্যানসেল কালচার প্রবণতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করা ও সমালোচনা করার তরুণ প্রজন্মের এই প্রবণতাকে আমি স্বাগত জানাই, অন্যের সঙ্গে তোমাদের মতবিরোধ হতেই পারে, কিন্তু অন্যকে একেবারে চুপ করিয়ে দেওয়াটা ভালো কাজ নয়।’ আর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রবণতাটিকে তুলনা করেছিলেন সর্বাত্মকবাদের সঙ্গে। এ নিয়ে তাঁর কথা ছিল, ‘এটি অন্যকে লাঞ্ছিত করার একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।’ শুধু দুই সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক নন, পোপ ফ্রান্সিসও তাঁর একটি বক্তব্যে বলেন যে ক্যানসেল কালচার একধরনের আদর্শগত আগ্রাসন, যা অন্যের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বিনষ্ট করে।

মুক্তিযুদ্ধের তিন দশক বা চার দশক পর জন্ম নেওয়া প্রজন্মকে যে পুরোনো বিভাজন তথা মুক্তিযুদ্ধের একতরফা বয়ান দিয়ে আর ভাগ করা যাবে না—এই সাধারণ বিষয়টি বুঝতে পারেনি আওয়ামী লীগ। এমনকি যাঁরা এর সমালোচনা করেছিলেন, নিতে পারেননি ছাত্রদের পাল্টা স্লোগান, তাঁদেরও তারা বিপুলভাবে প্রত্যাখ্যান করতে থাকে। নতুন প্রজন্মের ভাষায় এই ধারার নাম ‘ক্যানসেল কালচার’ বা বাতিল সংস্কৃতি।

যাহোক, সাম্প্রতিক আন্দোলনে বাংলাদেশেও এই প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যানসেল কালচারের ব্যাপক ব্যবহার করেছে। সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে ‘ভুয়া’ বলে ধ্বনি দেওয়া থেকে শুরু করে জুনাইদ আহ্মেদ পলককে নিয়ে অগণিত ট্রল অথবা লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে সম্মিলিতভাবে প্রত্যাখ্যান করা এই সংস্কৃতিরই অংশ।

সাম্প্রতিক আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং মাঠের স্লোগানে প্রচুর স্ল্যাংও ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। মনে পড়ছে, শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এ রকম কিছু স্ল্যাং শুনে আমরা বন্ধুরা কানে হাত দিয়ে মুখ টিপে হাসছিলাম আর বলছিলাম, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী বলছে এরা বাবা-মায়ের বয়সীদের সামনে!

এ সময়ই মনে পড়ল ইংরেজিতে এ ধরনের শব্দের ব্যবহারে তারা প্রায়ই অভ্যস্ত এবং ইংরেজি সিনেমা বা ওয়েব সিরিজে এ রকম স্ল্যা শুনে আমাদেরও কান–সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু এরপরও সর্বসমক্ষে বাংলায় উচ্চকণ্ঠে ওই স্লোগানগুলো শুনতে আমাদের অস্বস্তি হচ্ছে, যা হয়তো ওদের হচ্ছে না। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, এই প্রজন্মের জনপ্রিয় ও বহুল শেয়ার করা একটি মিম হলো, ‘যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমি ভাবি, “ফাক ইট”! আরেকটি হলো, ‘আমার খুব ভদ্র মানুষ হতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমার মুখ কো-অপারেট করে না!’ তো মনে যা আসে, তা ফস করে মুখে বলে ফেলার এই প্রবণতা ভালো কি মন্দ, তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, বাহাস হতে পারে। এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে নেটপ্রযুক্তির এই যুগে বিচিত্র সব শব্দ ও মিমের মধ্য দিয়ে যে যোগাযোগের এক ভিন্নমাত্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, প্রযুক্তি–প্রভাবিত আজকের সমাজে এসব শব্দ যে দ্রুততম উপায়ে ভাষার মধ্যে স্থানও করে নিচ্ছে। ফলে আমরা চাই বা না চাই অদূর ভবিষ্যতে এই ভাষাভঙ্গি নতুন বাংলা ভাষা তৈরিতে যে ভূমিকা রাখবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।