অসীম সাহা: দেখা হলে বলতেন, আমি ভালো আছি
গেল ১৮ জুন প্রয়াত হয়েছেন কবি অসীম সাহা। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।
গত কয়েক বছর, নানা অসুখবিসুখ তাঁকে দশ দিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। আজ ভালো তো, কাল চিকিৎসক, কদিন বাড়িবাস, কদিন হাসপাতালের পাণ্ডুর বিছানায়। এত কিছুর মধ্যেও অসীম সাহা প্রাণশক্তি নিয়ে লড়েছেন। দেখা হলে, কুশল জানতে চাইলে, ছোট্ট করে হেসে বলতেন, ‘আমি ভালো আছি, শরীরটাই ভালো যাচ্ছে না।’
এ বছরের শুরুর দিকে টানা কয়েক মাস এ হাসপাতাল, ও হাসপাতাল করেছেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়িতেও ফিরেছন। কিন্তু বাড়িবাস দীর্ঘ হয়নি। আবার হাসপাতাল। অসুখ প্রতিরোধ-প্রতিকারে মাসাধিক কাল কেটেছে। শেষাবধি, ১৮ জুন, অসীম সাহার বাঁচা শেষ হয়ে এল।
দীর্ঘদিন অসুখের সঙ্গে লড়াইটা অসীম সাহার মনে মৃত্যুবোধের সহজতা তৈরি করেছিল। মৃত্যু নিয়ে কবিদের বিচিত্র ভাবনা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুর মহিমা প্রকাশ করেছন, ‘মরণ রে,/তুঁহুঁ মম শ্যামসমান’ এমন উচ্ছ্বাসে। তবে সময়ের ব্যবধানে কবির এই অনুভবেও পরিবর্তন এসেছে। তিনিই তো আবার বলেছেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ এই চাওয়ার মধ্যেও ফাঁক রয়েছে। মৃত্যু বাস্তব, তাই জীবন সুন্দর। দর্শনের ছায়াতলে বসে এই কবির কলমেই এসেছে অত্মস্থ অনুভব, ‘জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্বের প্রয়োজন, মৃত্যু সেই দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার ওপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তাহা বড় মনোহর।’ অন্যদিকে জীবনানন্দ দাশ ব্যক্তির মৃত্যুতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি অখণ্ডতার মাত্রা যোগ করে বলেছেন, ‘মানুষের মৃত্যু হলেও মানব থেকে যায়’। এই ‘থেকে যাওয়া’র অর্থ কি নিঃশব্দ চলমানতা? একালের কবি অসীম সাহা মৃত্যুর স্পর্শসীমায় দাঁড়িয়ে যৌক্তিক সহজ স্বচ্ছ অনুভবেই বলেছেন, ‘তবুও যেতেই হবে, মানুষের এই তো নিয়তি আর/এই তো সেই গান,/সময় হলে তার দেহ থেকে উড়ে যাবে পাখির পরান।’ উদ্ধৃত কবিতাংশের ‘তবু’ শব্দটির মধ্য চাপা দীর্ঘশ্বাস লুকিয় থাকলেও অসীম সাহা মৃত্যুর বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন।
সমাজ-সংসারে অনেকে সৃষ্টিশীল মানুষ, বিশেষ করে ‘কবি’কে আলাদা করে দেখে পুলক অনুভব করেন। আমরা কে না জানি, কবিকে ‘বিপজ্জনক’ ও ‘ভিন্নতর’ মানুষ ভেবেছিলেন প্লেটোও। তিনি তো তাঁর ‘আদর্শ রাষ্ট্র’ পরিকল্পনা থেকে ‘কবি’র অবস্থান বাদ রেখেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। কবির অস্তিত্ব অছে, থাকবেও। একালের কবি হলেন সমাজের সচেতন অংশ। তাঁরা জীবনবোধের প্রত্যেক স্তরে যুক্ত থাকেন, মানে থাকতে হয়। কেননা সময়তরঙ্গে কবিদের বিচ্ছিন্ন থাকার কোনো সুযোগ নেই। প্রায় সব কবির মতো, অসীম সাহাও ছিলেন সময় ও সমাজের বিপুল তরঙ্গের এক চলিষ্ণু তরঙ্গ। বেঁচে থাকার সংগ্রামে তাঁর মেধা ও শ্রমসংশ্লিষ্টতা ছিল যথেষ্ট সংলগ্ন। একটি–দুটি উদাহরণ ছাড়া তাঁর স্থায়ী কোনো জীবিকাপথ ছিল না। সরকারি, বেসরকারি চাকরি, ছোটখাটো ব্যবসা—কত কিছুই না করেছেন! হালে পানি পানিনি। ছাপাছাপির ব্যবসাটাকে আঁকড়ে ছিলেন। শেষের দিকে দেখেছি, সম্পাদনার কাজটাকে জীবিকা করতে চাচ্ছেন। ছাপা-প্রকাশের আগে পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করা একটি জরুরি পর্য়ায়। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার কাজ করে দেবেন, এই কথা জানানও দিয়েছন। ধারণা করা যায়, তাঁর এ উদ্যোগ সফল হয়নি।
বহু দেশে ‘সম্পাদনা’ একটি সম্মানজনক পেশা। প্রকশনা প্রতিষ্ঠানের সম্পাদনা পরিষদ থাকে। তাদের অনুমোদন ছাড়া কোনো পাণ্ডুলিপি ‘বই’ হয়ে উঠবে, তা ভাবা যায় না। আমাদের দেশে হাতে গোনা কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছাড়া, সম্পাদনার বিষয়টিই কোথাও নেই। এমন অপ্রত্যাশিত বাস্তবতায় অসীম সাহার সম্পাদনাকে জীবিকা করার উদ্যোগ কী করে টিকে থাকবে!
সময়ের আলোছায়া থেকে কেউ দূরে থাকতে পারেন না। কবিদের পক্ষে তা অসম্ভবের চেয়ে একধাপ বেশি। বাংলা কবিতাযাত্রার শুরু থেকে, একালের, আজ পর্যন্ত বাঙালি কবিরা, অন্যান্য কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে দুটি বিষয় সমান্তরালভাবে ধারণ করেন; দ্রোহ ও প্রেম। ‘চর্যাপদ’–এ আছে, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলে আছে। এমনকি ‘নির্জনতার কবি’ জীবনানন্দ দাশেও আছে। তবে, কারও প্রেম ও দ্রোহের বিষয়রেখাটি স্পষ্ট, কারও ছায়াচ্ছন্ন।
কবির কালপরিধি বিশ্লেষণ করতে কবিদের আমরা দশকওয়ারি ভাগ করি। সেই বিবেচনায় অসীম সাহা ‘ষাটের কবি’। গত শতাব্দীর ষাটের দশক বা ছয়ের দশক, এ দেশে রাজনীতির ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময়পরিধি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে সামষ্টিক চেতনাগত যে জাগরণ ঘটেছিল, তা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে ষাটের দশকে এসে। কবিতা এসেছে দ্রোহের কাছে। দ্রোহ ভিড়েছে চিরলাবণ্যের ঘাটে। বায়ান্ন থেকে শুরু। দ্রোহ ও প্রেমের যাত্রাপথ কখনো ছিল সমান্তরাল, কখনো ভেদরেখাহীন—একাকার। ‘তোমার বুকে আমি পাহাড়ি ঝরনার/এক অজ্ঞাত শব্দ শুনেছিলাম,/তোমার চোখে দেখেছিলাম বন্য হরিণীর চঞ্চলতা;/তোমার সারা অঙ্গে উঁচু-নিচু পাহাড়ের আবেগ/তুমি আমাকে তোমার দেহের বাঁকে বাঁকে দেখিয়েছো উজ্জ্বল সি-বিচ/তুমি প্রাণপণ টেনেছ তোমার দিকেই,/তারপরও আমি পারিনি।’ ষাটের কবি অসীম সাহা এমন প্রেমোচ্ছল উচ্চারণ করবেন, এমনটাই স্বাভাবিক। অন্য দিকও আছে, সময়-সংহতি—‘...আর এখন যে মৃত্তিকায় আমি দাঁড়িয় রয়েছি,/সে তো উত্তপ্ত বালির বহর—আমি তার যেদিকেই তাকাই,/শুধু ধু ধু প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না।/আমি তাই আমার কাঙ্ক্ষিত বীজের উদ্গমের ভেতর থেকে আমার সেই বৃক্ষের ক্রমাগত বেড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে থাকি।’
একটি কেন্দ্রবিন্দু, থাকে বৃত্তরেখা। অসীম সাহার লেখালেখির কেন্দ্রে ছিল কবিতা। এরপরও তিনি বহুমুখী লেখালেখি করেছেন। প্রবন্ধ, গবেষণা, কথাসাহিত্য, গান, শিশু-কিশোর সাহিত্যসহ বিচিত্র বিষয়। কয়েকটি সংকলন সম্পাদনা করেছেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় অসীম সাহার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারা’। পাঠকমহলে অভিষিক্ত হলেন প্রাবন্ধিক অসীম সাহা। ১৯৯৯ সালে ‘অগ্নিপুরুষ ডিরোজিও’ বেরোয়। গবেষক হিসেব অসীম সাহা সমাদৃত হলেন। অনেকে এই গ্রন্থকে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ বলে অভিহিত করে থাকেন। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ আধুনিক ভাষায় রূপান্তর করেছেন অসীম সাহা।
ছন্দমান্যতার পাশাপাশি শুদ্ধ লেখার বিষয়টিকে অসীম সাহা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতেন। সবার জন্য সহজপাঠ্য করে লিখেছেন ‘আধুনিক ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’। তিনি অনুবাদ করেছেন অক্তাভিও পাজ ও ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা।
শত টানাপোড়েন, নানা কাজে সংশ্লিষ্ট থাকলেও অসীম সাহা সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। তিনি নিজে স্বপ্ন দেখতেন, অন্যকে স্বপ্ন দেখাতেও পছন্দ করতেন। সাহিত্য নিয়ে ছিল তাঁর নানা রকম পরিকল্পনা। কিছু বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন।
মৃত্যু এক মীমাংসা, জীবনের পূর্ণতাও। অসীম সাহা গেলেন অনন্তের পথে। তাঁর কাজ থাকল। কাজের যথাযথ মূল্যায়ন হয়। অসীম সাহাও মূল্যায়িত হবেন।