চা–শ্রমিকদের মুলুক চলো আন্দোলনে কী ঘটেছিল
সবুজ পাতা কালো হয়ে লাল চায়ের লিকার হওয়ার পেছনে রয়েছে নিপীড়িত এক জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার গল্প। চা–শিল্পের এক রক্তাক্ত অধ্যায় হলো ‘চরগোলা এক্সোডাস’। যাকে বাংলায় বলে ‘মুলুক চলো আন্দোলন’। আজ জাতীয় চা দিবসে জানা যাক সেই কাহিনি।
গত শতকের বিশের দশকে বাংলার চা–শ্রমিকেরা ‘মুলুক চলো’ নামে একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন। চা–শিল্পের ইতিহাসে এই আন্দোলনের তাৎপর্য অনেক। এই আন্দোলনের একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। আর সেই প্রেক্ষাপটের সঙ্গে রয়েছে স্বদেশি আন্দোলনের যোগ।
১৯২০ সালে রাউলাট আইন বাতিলের দাবিতে এবং খিলাফত আন্দোলনের সমর্থনে ভারতীয় কংগ্রেস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। এতে লোকজন দলে দলে ব্রিটিশের চাকরি ও পণ্য পরিত্যাগ করা শুরু করেন। এ সময় মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে দালালের মাধ্যমে ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগনা, বিহার, ওডিশা, যুক্ত প্রদেশ (উত্তর প্রদেশ), অন্ধ্র প্রদেশ থেকে হাজার হাজার শ্রমিক আনা হয় জনবিরল আসামে। তাঁদের প্রথমে আনা হয় তিন বছরের চুক্তিতে।
কিন্তু বছরের পর বছর কেটে যাওয়ার পরও তাঁদের মুক্তির অনুমতি মেলে না। তাঁরা যে কেবল মানবেতর জীবনযাপন করতেন, তা নয়, এই শ্রমিকেরা অনেকটা ক্রীতদাসের মতো জীবন কাটাতেন তখন।
এই বাস্তবতায় ব্রাহ্মসমাজের মিশনারি ও কংগ্রেসের কর্মীদের গোপন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সিলেটের বিপিনচন্দ্র পাল।
১৯২১ সালের ১ ও ২ মে কংগ্রেসের উদ্যোগে চারগোলা ভ্যালির রাতারবাড়ি বাজারে জনসভা হয়। এর আগেই শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়েছিল। ফলে শ্রমিকেরা কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেয়।
৩ মে প্রথম আনিপুর চা–বাগানের ৭৫০ জন শ্রমিক স্ত্রী–পুত্রের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে কর্তৃপক্ষের বাধা উপেক্ষা করে। শুরু হয় চা–শ্রমিকদের মহানিষ্ক্রমণ অধ্যায়, যা ভারতের ইতিহাসের ‘চরগোলা এক্সোডাস’ নামে পরিচিত। শ্রমিকেরা এর নাম দিয়েছিল ‘মুলুক চলো’ আন্দোলন। অর্থাৎ চা–বাগানের বন্দিত্ব ঘুচিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন।
৩ মে প্রথম আনিপুর চা–বাগানের ৭৫০ জন শ্রমিক স্ত্রী–পুত্রের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েন কর্তৃপক্ষের বাধা উপেক্ষা করে। শুরু হয় চা–শ্রমিকদের মহানিষ্ক্রমণ অধ্যায়, যা ভারতের ইতিহাসের ‘চরগোলা এক্সোডাস’ নামে পরিচিত। শ্রমিকেরা এর নাম দিয়েছিল ‘মুলুক চলো’ আন্দোলন। অর্থাৎ চা–বাগানের বন্দিত্ব ঘুচিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন।
চরগোলা ভ্যালির ১৩টি এবং লঙ্গাই ভ্যালির ৬টি বাগানের হাজার হাজার শ্রমিক বেরিয়ে পড়েন। সরকারি হিসাবে সে সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৭৯৯। এই শ্রমিকেরা প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে করিমগঞ্জ রেলস্টেশনে হাজির হন।
চা–বাগানের ইউরোপীয় মালিক, যাঁদের প্ল্যান্টার্স বলা হতো, তাঁদের চাপে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের চাঁদপুর যাওয়ার টিকিট দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
ফলে করিমগঞ্জ শহরে এক ভয়াবহ পরিস্থির সৃষ্টি হয়। এ সময় করিমগঞ্জ শহরের বাসিন্দা ছিল ৪ হাজার ৫২২ জন। কিন্তু এ শহরে অকস্মাৎ ১২ হাজার চা–শ্রমিক এসে হাজির হন। ফলে সৃষ্টি হয় তীব্র খাদ্যসংকট।
তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কংগ্রেস নেতারা এগিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ছিলেন অন্যতম। এঁদের উদ্যোগে নারী-শিশু-বৃদ্ধরা রেলে চড়ার সুযোগ পান। পুরুষেরা পায়ে হেঁটে চাঁদপুরের দিকে যাত্রা করেন।
চরগোলা ও লঙ্গাইর শ্রমিকদের বেরিয়ে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে সিলেটের বিভিন্ন ইউরোপীয় তথা ব্রিটিশ মালিকদের চা–বাগান থেকে দলে দলে শ্রমিক বেরিয়ে পড়েন। তাঁদের সংখ্যা ৩০ হাজারের কম নয়। শ্রমিকেরা দলে দলে হেঁটে সিলেট, কুলাউড়া, বরমচাল, শমশেরনগর, শ্রীমঙ্গল, সাতগাঁও, শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশনে জড়ো হতে থাকে।
১৯২০ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চাঁদপুর রেলস্টেশনে হাজার হাজার শ্রমিক জড়ো হন। প্রথম দিকে জড়ো হওয়া শ্রমিকেরা স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের সহায়তায় গোয়ালন্দগামী জাহাজে উঠে পড়েন। এ সময় চাঁদপুরের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন সুশীল কুমার সিংহ। তিনি শ্রমিকদের পাশে ছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই প্ল্যান্টার্সদের প্রতিনিধি হিসেবে ম্যাকফারস এখানে এসে হাজির হন। তিনি আসার পর পরিস্থিতি বদলে যায়।
১৯ মে সুশীল কুমার সিংহের নেতৃত্বে সশস্ত্র সৈন্যরা জাহাজে উঠতে থাকা শ্রমিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। একসময় জাহাজের পাটাতন সরিয়ে দেওয়া হয়। এতে এক মর্মন্তুদ দৃশ্যের অবতারণা হয়। শত শত শিশু, বৃদ্ধ ও নারী ভেসে যায় মেঘনার জলে।
কিন্তু তখনো আরও নিষ্ঠুরতার বাকি ছিল। পরদিন জাহাজে নারায়ণগঞ্জ থেকে ৫০ জন গোর্খা সৈনিক আসেন। তাঁদের সঙ্গে সশস্ত্র ইউরোপীয় জুট মার্চেন্টরা। চাঁদপুর রেলস্টেশনে তখনো গিজগিজ করছে স্বদেশমুখী চা–শ্রমিকে। রাতের শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার পর স্টেশন থেকে রেলকর্মীদের সরিয়ে দেওয়া হয়। চট্টগ্রামের ডিভিশনাল কমিশনার কিরণচন্দ্র দে বা কে সি দের নেতৃত্বে সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েন ঘুমন্ত শ্রমিকদের ওপর। হাজার হাজার শ্রমিকের কালচে লাল রক্তে ছেয়ে যায় চাঁদপুর বড় স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। সেই স্টেশন এখন অবশ্য নেই। হারিয়ে গেছে মেঘনার গর্ভে।
রেলপাড়ায় প্রতিক্রিয়া
কংগ্রেসের আহ্বানে এই শ্রমিকেরা তাঁদের কর্মস্থল ত্যাগ করলেও সর্বভারতীয় কংগ্রেস তাঁদের পাশে ছিল না। বরং ১৯২১-এর ৮ জুন মহাত্মা গান্ধী লেখেন, ‘শ্রমিকেরা মালিকদের ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাকে নেতৃত্ব দিতে কেউ যদি আমার নাম নিয়ে থাকে তাহলে আমি দুঃখিত...। পুঁজি বা পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে কোনো অসহযোগিতা চলছে না। এক ব্যবস্থা হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতা চলছে।’
তখন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ছিলেন আসাম-বেঙ্গল রেল কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি। তিনি খবর পেয়েই চাঁদপুর ছুটে আসেন। তিনি রেল ও স্টিমার ধর্মঘট ডাকেন। তাঁর ডাকে রেলশ্রমিকেরা ২৪ মে থেকে আড়াই মাস আসাম-বেঙ্গল রেল ধর্মঘট পালন করেন।
চা–শ্রমিকদের সঙ্গে রেলশ্রমিকদের কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্টতা না থাকলেও মানবিক কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এর পেছনে অবশ্য দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ধর্মঘটের কারণে রেলওয়ের কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ ধর্মঘটি শ্রমিকদের কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেয়। গরু ও ঘোড়ার গাড়িতে করে রেলশ্রমিকেরা দলে দলে কোয়ার্টার ছেড়ে শহরে চলে যেতে থাকেন। তাঁরা আন্দরকিল্লার জে এম সেন হলের আশপাশে তাঁবু গেড়ে বসবাস করতে থাকে। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয় এবং দেশপ্রিয়কে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ আন্দোলনে অংশ নিয়ে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সাড়ে ৪ হাজার রেলকর্মী চাকরি হারান। সিলেটের রাজনীতিবিদ ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘রেলকর্মীদের অনেকের চাকরী গেল। এখনো করিমগঞ্জ ও কাছাড়ের আনাচে-কানাচে দুই–একজন ওইরূপ কর্মচ্যুত লোক আছেন, যাঁহারা অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করিতেছেন। বড়দের ত্যাগই বড় করিয়া দেখি। ইহাদের ত্যাগ চোখে পড়ে না। অগণিত সত্যিকার দেশপ্রেমিকগণ অজ্ঞাত, অবহেলিত।’
বাংলা তথা বাংলাদেশের চা–শ্রমিকদের ইতিহাসে মুলুক চলো আন্দোলনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এ আন্দোলনের প্রভাব হিসেবে সেই সময়ের বাস্তবতায় আপাতভাবে চা–শ্রমিকদের ক্রীতদাস–জীবনের অবসান ঘটেছিল।