সুফিয়া কামাল নেই, যেন বারান্দাটিরও প্রাণ নেই
কবি সুফিয়া কামালের জন্মদিন আজ। নারী আন্দোলনসহ প্রগতিশীল নানান আন্দোলনে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ধানমন্ডির ‘সাঝের মায়া’ নামে যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, সেই বাড়ির বারান্দা ছিল অনেক কিছুর সূতিকাগার। এই মহিয়সীর মৃত্যুর বেশ কিছু বছর পর ২০০৯ সালের ২০ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুদিবসে প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল এই লেখা। ‘সাঝের মায়া’র বারান্দা ঘুরে এসে লেখাটি লিখেছিলেন সুমনা শারমীন। সেই বারান্দা এখনো আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের প্রায় শেষ প্রান্তের বাড়ি। ‘সাঁঝের মায়া’। দুপুরবেলা বাড়ির লোকজন বিশ্রাম করছেন। হঠাৎ ভেতরের ঘর থেকে বারান্দায় চেয়ার টানাটানির শব্দ আসছে। বেরিয়ে এলেন সুফিয়া কামালের মেয়ে সাঈদা কামাল টুলু। দেখলেন কয়েকজন অচেনা মানুষ একটি সভার আয়োজন করছেন। ‘কী ব্যাপার? আপনারা কারা?’ উত্তরে জানা গেল, ‘না, মানে আমরা অমুক সংগঠন। আমাদের একটা জরুরি সভা। কোথাও জায়গা পেলাম না, ভাবলাম খালাম্মার বাড়ির বারান্দাতেই চলে আসি।
দুঃখিত আপনাদের আগে খবর দিতে পারিনি।’ বিরক্তি চেপে মেয়ে গেলেন মায়ের কাছে। ‘এটা কেমন কথা? আমাদের জানাবে না আগে?’ সুফিয়া কামালের ধীরস্থির আত্মপ্রত্যয়ী জবাব, ‘আমার বাড়িটা, এই বারান্দাটা ওদের শেষ আশ্রয়। অধিকার নিয়ে, দাবি নিয়েই ওরা এসেছে।’
লন্ডনপ্রবাসী আওয়ামী লীগের নেতা সুলতান শরীফের মেয়ে রাজিয়া শরীফ ঢাকায় চাকরি করতেন। বিয়ে করবেন। আংটি পরবেন। কিন্তু অভিভাবকেরা প্রবাসে। ঠিক হলো, সুফিয়া কামালের বাড়িতে আংটি পরানো হবে। দৌড়াদৌড়ি করে শাড়ি-ব্লাউজ আনা; অতঃপর সেই বারান্দা, বইয়ের তাক, বেতের চেয়ার, গাছপালাঘেরা লাল মেঝের বারান্দায় দুটি মানুষের নতুন জীবন শুরু। পরিবার মানছে না, এ বারান্দায় আলোচনা হয়ে যেমন অনেক বিয়ে হয়েছে, তেমনি দুজনের দূরত্ব কমিয়ে আবার পথচলা—সেও এই বারান্দাতেই।
১৯৬২ থেকে ১৯৯৯-এর ২০ নভেম্বর। ছায়ানট, কচিকাঁচার মেলা, মহিলা পরিষদ, ব্র্যাক, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটিসহ অসংখ্য সংগঠনের নানা কর্মকাণ্ড হয়েছে এই বারান্দায়। বাংলাদেশের বহু সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিবৃতি, পোস্টার তৈরি হয়েছে এই বারান্দায়। ছুরি দিয়ে তরকারি কাটতে কাটতে সুফিয়া কামাল তাঁর মত দিতেন সভায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর আদান-প্রদানের কেন্দ্র ছিল এই বারান্দা। গানের অনুষ্ঠান, পথনাটকের মহড়া—এই বারান্দায়। দেশি-বিদেশি অসংখ্য গুণী মানুষের পদচারণ এই বারান্দায়। কিন্তু ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর সুফিয়া কামালের মৃত্যুর পর যেন সেই বারান্দার প্রাণও উবে গেছে।
আজ সেই ২০ নভেম্বর।
গত পরশু সাঁঝের মায়ায় গিয়ে দেখা হলো সুফিয়া কামালের তিন মেয়ে আমেনা কাহার, সুলতানা কামাল ও সাঈদা কামালের সঙ্গে। শেষ দিন পর্যন্ত সুফিয়া কামালের সঙ্গে যিনি ছিলেন ছায়ার মতো, সিকান্দার আবু জাফরের স্ত্রী নার্গিস জাফরও তখন দোতলায় চায়ের টেবিলে। বলছিলেন, ‘খালাম্মার সঙ্গে আমার দিনের পর দিন কেটেছে এই বাড়িতে, এই বারান্দায়। এখন একতলার ওই দিকটায় যাওয়াই হয় না।’
বাড়ির প্রথম গেট খুলে ঢুকেই দেখা যেত বারান্দা। সুফিয়া কামালের ছেলে শাহেদ কামালকে দেখা যেত বাগানে কাজ করছেন অথবা বারান্দার একপাশে বসে লাল চা খেতে খেতে সংবাদপত্র পড়ছেন। বারান্দায় অবধারিতভাবে কেউ না কেউ থাকতই।
‘সাঁঝের মায়া’। দুপুরবেলা বাড়ির লোকজন বিশ্রাম করছেন। হঠাৎ ভেতরের ঘর থেকে বারান্দায় চেয়ার টানাটানির শব্দ আসছে। বেরিয়ে এলেন সুফিয়া কামালের মেয়ে সাঈদা কামাল টুলু। দেখলেন কয়েকজন অচেনা মানুষ একটি সভার আয়োজন করছেন। ‘কী ব্যাপার? আপনারা কারা?’ উত্তরে জানা গেল, ‘না, মানে আমরা অমুক সংগঠন। আমাদের একটা জরুরি সভা। কোথাও জায়গা পেলাম না, ভাবলাম খালাম্মার বাড়ির বারান্দাতেই চলে আসি। দুঃখিত আপনাদের আগে খবর দিতে পারিনি।’ বিরক্তি চেপে মেয়ে গেলেন মায়ের কাছে। ‘এটা কেমন কথা? আমাদের জানাবে না আগে?’ সুফিয়া কামালের ধীরস্থির আত্মপ্রত্যয়ী জবাব, ‘আমার বাড়িটা, এই বারান্দাটা ওদের শেষ আশ্রয়। অধিকার নিয়ে, দাবি নিয়েই ওরা এসেছে।’
সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষ ছাড়াও শনিবার, মঙ্গলবার অনেক দূর থেকে বারান্দায় মানুষ আসত খালাম্মার নিজের হাতে তৈরি হাঁপানির ওষুধ নিতে।...কিন্তু এখন ওই প্রথম গেট বন্ধই থাকে। ছেলেমেয়েরা দোতলা-তিনতলায়। নিচতলা সেভাবেই রাখা। যেমন রেখে গিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। বারান্দায় আগের মতোই চেয়ার পাতা। পরিষ্কার লাল মেঝে। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, বারান্দাটাও আর বেঁচে নেই।
১৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়, ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় সুলতানা কামাল স্মৃতিচারণা করে বলছিলেন, ‘১৯৬২ সালে এই বাড়িতে আমরা আসি। তখন বাড়িঘর কম ছিল। ৩২ নম্বর সড়কের মাথায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। এমনও হয়েছে, বঙ্গবন্ধু মানুষজন নিয়ে লেকের পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাগানে, বারান্দায় চলে এসে মা-বাবার সঙ্গে ১০-১৫ মিনিট কথা বলে আবার চলে গেছেন। তখন তো বাড়ির প্রাচীর, গেট ছিল না। ৩২ নম্বরে আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন হাতেম আলী খান (হায়দার আকবর খান রনোর বাবা), দুই সাবেক প্রধান বিচারপতি আবু সাদত মো. সায়েম ও এ টি এম আফজাল, নূরুদ্দীন আহমেদ এবং বেগম বদরুন্নেসা আহমেদসহ অনেকেই। এনারা মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য, কুশলাদি বিনিময়ের জন্য প্রায়ই আসতেন। আর আমাদের বাড়িতে বৈঠকখানা মানেই ওই লাল মেঝের বারান্দা। পাশাপাশি এই বারান্দায় এসে খানিক বিশ্রাম নিয়ে, ঘুম দিয়ে, নাশতা খেয়ে অতঃপর আবার কাজে ফিরে যেতেন তরকারিওয়ালা, ফেরিওয়ালা, ভিক্ষুক, পনিরওয়ালা, বসন্ত ধোপা।’
সাঈদা কামাল বললেন, ‘যেই আসত, তাকে ঠিকমতো নাশতা না দিলে মা যে কী মন খারাপ করতেন। ২০ জুন মায়ের জন্মদিনে স্রোতের মতো মানুষ আসত। স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রদূত।
‘একবার দুপুরের দিকে ক্লান্ত হয়ে গেছি। কয়েকজনকে মিষ্টি, পানি দিয়েছি, চা দেওয়া হয়নি। মা যে কী মন খারাপ করলেন। তিন দিন বিছানা ছেড়ে ওঠেননি। আমাদের এই বারান্দায় মাসে ১৫ দিন গানের আয়োজনই থাকত। ওয়াহিদুল হক, আনিসুর রহমান, জাহিদুর রহিম, সান্জীদা খাতুন, ইফফাত আরা দেওয়ান প্রমুখ নিয়মিত এসে গাইতেন।
একবার শৈলজানন্দ মজুমদার এসে ছায়ানটের তিন দিনের গানের কর্মশালা করেছিলেন এই বারান্দায়। এই বারান্দায় এসেছেন কনিকা বন্দোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, অম্লান দত্ত, দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় আর পুর্ণেন্দু পুত্রী তো থেকেই গেছেন।
‘একবার আইকে গুজরালের পক্ষ থেকে দূত এসে এই বারান্দায় মাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা এই বারান্দায় এসে মাকে পদক দিয়ে গেছেন। তবে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা এমনিতেও অনেকবার এসেছেন।’ সুলতানা কামাল বললেন, ‘একবার এক পয়লা বৈশাখে শেখ হাসিনা মায়ের জন্য ফুল-মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন মনে আছে।’
সত্যি বলতে, এই বারান্দায় আসেননি বাংলাদেশের এমন প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ কমই আছেন। কাকে রেখে কার নাম বলব? সবাই ছিলেন সুফিয়া কামালের আপনজন। তাই তো ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর হাসপাতাল থেকে ফিরে গোসল করে অন্য রকম শুভ্রবসনে তিনি যখন শেষবার তাঁর প্রিয় সাঁঝের মায়ার বারান্দায় এলেন, তখন মানুষের আর ঠাঁই হয় না। অতঃপর সবুজ ঘাসের লনে তিনি ছিলেন সবার মাঝে। সুলতানা কামাল বললেন, ‘মাকে শেষবার দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন আহমদ আসার আগে নিরাপত্তাকর্মীরা আমাদের বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট আসবেন, আপনাদের আত্মীয় ছাড়া অন্যদের চলে যেতে বলুন। আমরা বলেছিলাম, এখানে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা সবাই মায়ের আত্মীয়, অনাত্মীয় কেউ নেই।’