বাংলাদেশি পাঠকের মন
মার্কিন কার্টুনিস্ট গ্র্যান্ট স্নাইডারের আঁকা একটা ছবি প্রায়ই ঘুরে বেড়াতে দেখি অনলাইনে। পাঠকজীবনের অনেকগুলো পর্যায় আঁকা সেই কার্টুনের শুরুতে দেখি শৈশবে এক পাঠক প্রেমে পড়ছে বইয়ের, আর একদম শেষ প্যানেলে দেখা যায় বৃদ্ধ বয়সে সেই পাঠকই পরের প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছে তার ভালোবাসার বইগুলো। পড়ুয়ামাত্রই জানেন, স্নাইডারের এই পর্যবেক্ষণ নিখুঁত, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের প্রতি মানুষের মনোভাব বদলায়।
কথাটা সমষ্টির ক্ষেত্রেও সত্য। যেকোনো ভূগোলেই জনগোষ্ঠীর পাঠরুচিতে অবিরাম বদল ঘটে। সামাজিক প্রথার বিবর্তন, রাজনৈতিক পটবদল, নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব, বৈশ্বিক কোনো আলোড়ন তোলা ঘটনা—বাহ্যিক এই চলকগুলো পাঠকদের মধ্যে তৈরি করে নতুন ধরনের লেখা পড়ার আকাঙ্ক্ষা। অন্যভাবে বললে, যুগের প্রতিফলন দুনিয়ার সঙ্গে পাঠকের মনও বদলে দেয়।
তাই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশি পাঠকের মন নতুন সহস্রাব্দে কী ধারায় পরিবর্তিত হচ্ছে? গত সিকি শতাব্দীতে কেমন বদল এসেছে তাদের পাঠরুচিতে?
নব্বইয়ের দশক
প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য আলাপটা বোধ করি শুরু করা দরকার গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে। সত্যি বলতে, আশির দশকের শেষভাগ থেকে হুমায়ূন আহমেদ আর ইমদাদুল হক মিলনের লেখার প্রতি বাংলাদেশি পাঠকের যে ভালোবাসা জন্মায়, নব্বইয়ের দশকে তা পরিণত হয় রীতিমতো উন্মাদনায়। সহজ গদ্যভাষায় একের পর এক গল্প-উপন্যাস রচনা করে এই দুই লেখক মন কেড়ে নেন পাঠকের; সঙ্গে থাকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁদের রচিত টিভি নাটক। দুইয়ের যোগফলে নব্বইয়ের দশকে তাই গড় বাংলাদেশি পাঠকের পাঠতালিকায় সবচেয়ে বেশি থাকেন হুমায়ূন-মিলন। মনোযোগী পাঠকদের মধ্যে ‘মূলধারা’র অন্য লেখকদের সমাদর ঠিকই ছিল, তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে অ্যাকটিভিজম আর রাজনৈতিক অবস্থান বা বক্তব্য ছাড়া প্রান্তিক মানুষের কাছে অতটা পরিচিত তাঁরা হয়ে ওঠেননি। কবিতাপ্রেমীদের পছন্দের শীর্ষে ছিলেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, হেলাল হাফিজ ও রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
মূলধারার বাইরের আরও একটি স্রোতের কথা এখানে বলতেই হয়। তুমুল জনপ্রিয় এই ধারার পুরোধা ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে রচিত তাঁর ‘মাসুদ রানা’ (এবং সেবা প্রকাশনীর আরও সব রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ) নব্বইয়ের দশকে অবধারিতভাবেই থাকত বাংলাদেশি পড়ুয়াদের ঘরে। কাজী আনোয়ার হোসেনের একটা বিশেষ কৃতিত্ব এই যে শহর থেকে প্রত্যন্ত মফস্সলের পাঠকও প্রথমবারের মতো বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদি সব বইয়ের স্বাদ সংক্ষিপ্ত সংস্করণে হলেও পেয়েছিল তাঁর সম্পাদনাতেই। সেই সঙ্গে মেদবর্জিত, টান টান বিশেষ যে ভাষারীতি সেবা প্রকাশনীর হাতে প্রচলিত হয়, জনরা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তা আজও অদ্বিতীয়। সেবা প্রকাশনীর বাইরে নব্বইয়ে আরও একটি ধারা জনপ্রিয়তা পায়। কাশেম বিন আবুবাকার বা এম ডি মুরাদের মতো লেখকেরা প্রেম ও চটুলতাকে উপজীব্য করে গ্রামের বেশ বড় একটা পাঠকগোষ্ঠীর কাছে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন।
নব্বইয়ের দশকে সক্রিয় ছিলেন ছোট কাগজের কর্মীরা। রাজধানী ঢাকার পাঠকেরা তখন নিউমার্কেটের ইংরেজি বইয়ের দোকানগুলো ছাড়াও ভারী বই খুঁজতে যেতেন আহমদ ছফার আড্ডাস্থল আজিজ মার্কেটে। নীলক্ষেত থেকে বহু পাঠক নিয়মিত কিনতেন সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দুদের পাইরেটেড বইগুলো। ছিল দেশ, পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা পত্রিকাগুলোর নিজস্ব কিছু পাঠকগোষ্ঠী। তার বাইরে বইয়ের দোকানে চোখ রাখলেই দেখা যেত ধর্মীয় বই, ভবেশ রায়ের তথ্য-ভারাক্রান্ত বইগুলো, প্রগতি আর রাদুগা প্রকাশনীর রুশ বইপত্রের অনুবাদ, শত মনীষীর কথা ঘরানার জীবনী, বিবিধ বিশ্বকোষ।
পাড়া সংস্কৃতি তখনো টিকে ছিল বলে নব্বইয়ের দশকে সাধারণ পাঠক বইয়ের খোঁজ পেত পরিচিত পাঠকের মুখ থেকেই। বইমেলা এলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপা হতো নতুন বইয়ের। মেলা চত্বরে ঘুরে ঘুরে অচেনা লেখক আবিষ্কারের ধৈর্যও তখন পাঠকের ছিল।
এল নতুন শতাব্দী
নতুন সহস্রাব্দের প্রথম কয়েক বছরেও বাংলাদেশি পাঠকের পাঠরুচি মোটাদাগে অনুসরণ করেছিল নব্বইয়ের দশককে। নতুন বলতে, মূলধারার লেখকদের মধ্যে এ সময় আনিসুল হকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হয় পাঠকের, একুশে টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর বিভিন্ন নাটক এ ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া নীলক্ষেতে ঠিক এ সময়টাতেই সহজলভ্য হয়ে ওঠে ফেলুদা-টেনিদা-ঘনাদা-কাকাবাবু আর ব্যোমকেশের ‘সমগ্র’ ঘরানার পাইরেটেড বইগুলো।
পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। মূলধারার লেখকদের মধ্যে অকালপ্রয়াত শহীদুল জহিরের প্রতি এ সময় তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয় বাংলাদেশি পাঠক। সঙ্গে সঙ্গে রোমাঞ্চ-সাহিত্যে শুরুতে অনুবাদ ও পরে মৌলিক রচনার মাধ্যমে পাঠকের দৃষ্টি কাড়েন মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন।
ঠিক এ সময়টাতেই, অভ্র সফটওয়্যারে বাংলা লেখার সুবিধা পেয়ে নানা বয়সের বাংলাভাষী মানুষ অনলাইনে লিখতে শুরু করেন অভূতপূর্ব সব বিষয়ে। কমিউনিটি-ব্লগভিত্তিক কিছু লেখক সমাবেশ গড়ে ওঠে, সঙ্গে থাকে ফেসবুক। দুইয়ে মিলে প্রযুক্তি-শিক্ষিত বাংলাদেশি পাঠকদের একটা বড় অংশকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হন অনলাইনের এই লেখকেরা। দশকের শেষ দিকে এসে দেখা যায়, এই লেখকদের মধ্যে শক্তিশালী অনেকেই আলোচিত হয়ে উঠছেন একুশে বইমেলায়ও। তা ছাড়া অনলাইনের নানা আলাপ সচেতন পাঠকের সামনে আনতে থাকে এমন কিছু লেখককে, প্রথাগত উপায়ে পাঠকের সামনে যাঁরা এত দিন পৌঁছাতে পারেননি।
সংক্ষেপে বললে, নিজের পাড়া বা গণ্ডির বাইরেও পড়ুয়াদের যে বিপুল বিশ্ব, সাইবার মাধ্যমের হাত ধরে সেই দুনিয়ায় এবার প্রবেশ ঘটে বাংলাদেশি পাঠকের। ‘ওল্ড মিডিয়া’র সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে ‘নিউ মিডিয়া’র পাঠক ও লেখকেরা বাংলাদেশের প্রকাশনাজগতে নিয়ে আসেন একটা নতুন স্রোত। আর পরের দশকে, নিউ মিডিয়ার এই স্রোতটি হয়ে ওঠে দারুণ শক্তিশালী।
নিউ মিডিয়ার দ্বিতীয় দশক
অচিরেই দেখা যায়, নিউ মিডিয়ার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। কেবল অক্ষরের মধ্য দিয়ে পরিচয়ের বদলে লেখকের আচরণ, ব্যক্তিগত মতাদর্শও সেখানে পাঠকের সামনে দৃশ্যমান হয়। ফলে দ্বিতীয় দশক শুরু হতে না হতেই, বিশ্বাস বা ইতিহাসের মতো বিষয়কে কেন্দ্রে রেখে মতাদর্শভিত্তিক অনেকগুলো নতুন পাঠকগোষ্ঠীর জন্ম হয় অনলাইনে। অচিরেই দেখা যায়, নতুন এই পাঠকদের কথা মাথায় রেখে বহু লেখক গল্প-উপন্যাস বা প্রবন্ধকেও করে তুলেছেন নিজ মতাদর্শের প্রচারমাধ্যম। সৃজনশীলতা বা মননশীলতার বিচারে উৎকর্ষের পরিচয় দিতে না পারলেও এ ধরনের রচনার দারুণ চাহিদা তৈরি হয় গড় পাঠকের কাছে। ফ্যালাসি-ভরপুর কিছু নন-ফিকশন এ সময় অভাবনীয় জনপ্রিয়তা পায়। ফিকশনের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক ও জীবনীনির্ভর উপন্যাস। তার বাইরে ইউটিউব-কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাণ, পেশাগত জীবনের সাফল্য কিংবা অনলাইন অ্যাকটিভিজম দিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পরিচিতি লাভ করা ‘সেলিব্রিটি’দের রচনাও কমবেশি পাঠকের আলোচনায় থাকে এ দশকে—বিশেষত দ্বিতীয়ার্ধে।
বস্তুত একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক ছিল আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশি সাহিত্যের পালাবদলের সময়। সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদসহ মহারথী কিছু লেখকের জীবনাবসানও ঘটে এই দশকে। মননশীল ফিকশন-লিখিয়েদের মধ্যে সচেতন পাঠকের নজর কাড়েন ওয়াসি আহমেদ, শাহীন আখতার ও শাহাদুজ্জামান। নন-ফিকশনের জগতে আকবর আলি খানের সঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিন আহমদ, আলতাফ পারভেজও। এ সময় অনুবাদের মধ্যে উর্দু সাহিত্যের প্রতি পাঠকের বিশেষ আগ্রহ লক্ষণীয়। এ বাস্তবতায় মওলানা রুমি ও মির্জা গালিবের অনুবাদক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন জাভেদ হুসেন। আর কবিতার কথা বললে বলতে হয়, কবিতাপ্রেমীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা পান মারজুক রাসেল, ইমতিয়াজ মাহমুদ ও প্রবর রিপন। তাঁদের জনপ্রিয়তার পেছনে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
রোমাঞ্চ সাহিত্যে সেবা প্রকাশনী ঘরানার আধিপত্য ভেঙে এই দশকেই আবির্ভাব ঘটে একঝাঁক তরুণ থ্রিলার-লিখিয়ের। সঙ্গে মূলধারার সাহিত্যেও প্রবেশ করে বেশ কিছু নতুন মুখ, যাঁদের অনেকেই হাত পাকিয়েছেন অনলাইনে লেখালেখি করে। কিন্তু জনরা হোক আর লিটারারি ফিকশন—উভয় ধারাতেই নতুন লেখকদের মধ্যে দেখা যায় আগের তুলনায় অনেক বেশি বৈচিত্র্য, চোখে পড়ার মতো আত্মবিশ্বাস। বিশ্বায়নের হাত ধরে মার্গারেট অ্যাটউডের ডিস্টোপিয়া, মার্কেসের জাদুবাস্তবতা, ডেভিড লিঞ্চের হরর—সবই তত দিনে ঢুকে গেছে বাংলাদেশের আঙিনায়, ফিকশনের জগতেও তার প্রতিফলন শুরু হয় এবার। এমনকি কবিতার ক্ষেত্রে বিচিত্র এবং নিরীক্ষামূলক সব লেখা দেখা যায় এই সময়ে। সেসব গল্প-কবিতার সবই যে খুব শিল্পসচেতন, তা নয়—কিন্তু বাঁকবদলের কালে এমনটা খুবই স্বাভাবিক।
বই কেনার ধরনেও বদল লক্ষ করা যায় এই দ্বিতীয় দশকে। যাত্রাপথে বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ায় স্টেশন-টার্মিনালের ছোট বইবিপণিগুলো এই দশকে উঠে যায় বহুলাংশে, খোদ রাজধানীতেই অনেক দোকান বন্ধ হয় ক্রেতার অভাবে। অথচ দশকের শেষ দিকে দেখা যায়, ঢাকাসহ আরও কিছু শহরে চালু হচ্ছে বুক ক্যাফে ঘরানার কিছু বিপণি। বিশ্বায়নের কালে কেবল হাত বোলানোর বদলে পাঠক এখন দোকানে বসে কয়েক পৃষ্ঠা উল্টে দেখতে চান বইয়ের, চান সহ-পাঠকদের সঙ্গে দু-চারটা কথার বিনিময়। বাংলাদেশের বুক ক্যাফেগুলো আপাতত সীমিত আকারে শহুরে পাঠকদের সেই চাহিদা মেটাচ্ছে।
অন্যদিকে ব্যস্ত জীবনে বইয়ের দোকানে যেতে না-পারা পাঠকের জন্য এ সময় গড়ে ওঠে কিছু বিশেষায়িত ওয়েবসাইট। রকমারি, বাতিঘর, প্রথমার মতো এই সাইটগুলো অনলাইনেই বই কেনার সুবিধা এনে দেয়। দশকের শেষ দিকে জন্ম হয় ফেসবুক পেজভিত্তিক বহু ক্ষুদ্রায়তনের বইবিপণির। ছাড়ও সেখানে কিছু বেশি মেলে বলে, সারা বছর যাঁরা বই কেনেন, তাঁরা বেশ নিয়মিত ক্রেতা এসব অনলাইন পেজের। বাংলাদেশের মফস্সল অঞ্চলগুলো, যেখানে বইবিপণি বলতে মূলত বোঝায় স্টেশনারি দোকান—সেসব জায়গার পাঠকদের জন্য এই অনলাইন দোকানগুলো সুযোগ করে দিচ্ছে সদ্য প্রকাশিত বইয়ের সঙ্গে থাকার।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য বাংলাদেশি পাঠকের কাছে নীলক্ষেতসহ পাইরেটেড বইয়ের অন্য কেন্দ্রগুলোর প্রাসঙ্গিকতা বদলায়নি। তবে ওসব দোকানে আজকাল পুরোনো বইয়ের সন্ধান মেলে কম, তার চেয়ে অনেক বেশি মেলে বিশ্বসাহিত্যে সম্প্রতি আলোড়ন তোলা বইগুলোর স্থানীয় ফটোকপি। তরুণ পাঠকদের একটা বড় অংশ আজকাল ইংরেজিমাধ্যম পড়ুয়া, ফলে নীলক্ষেতে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইংরেজি ইয়ং-অ্যাডাল্ট ঘরানার বইগুলো।
পাইরেটেড বইয়ের বাজারে কিছুটা হলেও জৌলুশ হারিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বই। পাঠকের কাছে সেই ঘরানায় জনপ্রিয়তায় এখনো এগিয়ে আছেন সুনীল-সমরেশ। নতুন যে বইগুলোর চাহিদা তৈরি হয়েছে, তাদের প্রায় সব কটিই রহস্য-রোমাঞ্চ ঘরানার। তার বাইরে দ্বিতীয় দশকজুড়ে নীলক্ষেতে রাজত্ব করেছে গেম অব থ্রোনস ঘরানার বহুবিধ ফ্যান্টাসি সিরিজ, নানা রকম আত্মোন্নয়নের বই; সঙ্গে ইউভাল হারারি, ট্রেভর নোয়াহ, নাসিম নিকোলাস তালেবরা। ইদানীং আবার অনলাইনের সুবিধা নিয়ে পছন্দের বই প্রিন্ট করিয়ে নেওয়া যায় বলে অনেকেই পছন্দের বইটা প্রিন্টও করিয়ে নিচ্ছেন নীলক্ষেত থেকে।
ইন্টারনেটের জোয়ারে দ্বিতীয় দশকে অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে ছোট কাগজের আন্দোলন। তবে তাদের বিষয়ভিত্তিক কিছু সংখ্যা সাহিত্যামোদী পাঠকের মধ্যে এখনো আগ্রহ জাগায়।
বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে এই দশকের একেবারে শেষে বাংলাভাষী একাধিক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে ওঠে, সেসব প্ল্যাটফর্মও কনটেন্টের জন্য প্রায়ই হাত পেতেছে সাহিত্যের কাছেও। ফলে দর্শক-পাঠকও তখন সেই সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি কিংবা শিবব্রত বর্মনের বানিয়ালুলুর কথা।
চলতি দশক
কিন্তু শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি এসে তাই নিশ্চিত করেই বলা যাচ্ছে, দুনিয়ার বাকি অংশের মতো বাংলাদেশি পাঠকের বই নির্বাচনের রুচি আর অভ্যাসও এখন বহুলাংশে ভার্চ্যুয়াল জগৎকেন্দ্রিক। মোটাদাগে ভার্চ্যুয়াল জগতের আলোচিত সংবাদ বা ঘটনাই পাঠককে এখন টেনে নেয় নতুন কোনো লেখক কিংবা বইয়ের দিকে। সদ্য ঘটে যাওয়া জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান যেমন পাঠকদের ইদানীং আকৃষ্ট করে রেখেছে ইতিহাস ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ঘরানার প্রতি।
চলতি দশকের আরেক বৈশিষ্ট্য, নিউ মিডিয়ার সুবিধা নিয়ে লেখক বা প্রকাশকের মতোই পাঠকও এখন গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের জগতে। দেশ-বিদেশের পছন্দের লেখকের প্রোফাইল/ওয়েবসাইটে নতুন বইয়ের খবর নেওয়া থেকে শুরু করে বই নিয়ে ইনস্টাগ্রাম বা ইউটিউবে আলাপ, সরব পাঠকমাত্রই এখন ঠিক করে দিচ্ছেন অন্য কোনো পড়ুয়ার পাঠসূচি। পাঠক আজ আর ঠিক একা বই পড়ছেন না, সাইবার-বন্ধুত্বের সুবাদে তাঁদের পাঠের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে অনেকটা গোষ্ঠীগত।
আশায় আছি, বাংলাদেশি পাঠকের এই বিবর্তনও কালক্রমে জায়গা পাবে মন ভালো করে দেওয়া কোনো কার্টুন প্যানেলে।