নিরুপমা
প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে হাতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি। বাঁ হাত। ডাক্তারের কাছে যাইনি। ইদানীং ডাক্তারের কাছে যেতে ভয় লাগে—কোন কেঁচো খুঁড়তে কী সাপ বেরিয়ে আসে! ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে বিভিন্ন রোগবালাই সম্পর্কে এটা-সেটা পড়ি।
‘হাউ ডু আই নো ইফ মাই লেফট আর্ম পেইন ইজ হার্ট রিলেটেড?’ প্রশ্নটা গুগল সার্চ ইঞ্জিনে মাত্র লিখেছি, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল বাল্যবন্ধু আবদুল গফুরের নাম।
‘গফুর, কেমন আছিস দোস্ত?’
‘দোস্ত, একটা খারাপ খবর আছে।’
বুকটা ধক করে উঠল। আজকাল খারাপ খবরের হিড়িক লেগেছে। একের পর এক মারা যাচ্ছে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী। গত মাসেই মারা গেল আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু রানা। সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক। বেচারা বাড়িতে একা ছিল। পরে বন্ধু রাজুর কাছে শুনি, ওর মুঠোফোনে রানার নম্বর থেকে ১১টা মিসড কল। রাজু তখন ওর গ্যারেজে কাস্টমারদের গাড়ি মেরামতের কাজে ভীষণ ব্যস্ত ছিল; ফোন সাইলেন্ট করা ছিল বলে রানার কল শুনতে পায়নি। পরে যখন শুনতে পেল যে রানা মারা গেছে, তখন তার নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়েছিল। রাজু কাঁদতে কাঁদতে আমাকে এসব কথা বলেছিল।
‘আবার কে মারা গেল?’ আমি গফুরকে বললাম।
‘তোর নিরু।’ গফুর বলল। আমি নিরুর নামটা স্পষ্টই শুনতে পেলাম। তবু মনে হলো শুনতে পাইনি।
গফুর আর কিছু বলছে না। একদম চুপ করে আছে। আমার কানে শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ।
‘কী বললি?’
‘হয়, দোস্ত। নিরু এইমাত্র মারা গেল।’
‘বলিস কী রে! কীভাবে?’
গফুর বলল, নিরু সকালে রিকশায় করে ওর স্কুলে যাচ্ছিল (সে রূপনগর টাউন থেকে মাইল দুয়েক দূরের এক সরকারি প্রাইমারি স্কুলের হেডমিস্ট্রেস ছিল), মালবোঝাই একটা ট্রাক রিকশাটাকে চাপা দিয়ে চলে গেছে। রিকশাচালক স্পটডেড, নিরু গুরুতর আহত। গফুরও ওই পথে রিকশায় ওর কলেজে যাচ্ছিল (রূপনগরের এক বেসরকারি কলেজের শিক্ষক সে)। আহত নিরুকে গফুরই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। নিরু তখনো সংজ্ঞা হারায়নি, সে নাকি গফুরের হাত ধরে বলেছিল, তার মনে হচ্ছে, সে বাঁচবে না, মারা গেলে আমি যেন তাকে দেখতে যাই।
গফুরের এই কথা আমার বিশ্বাস হলো না। নিরু কেন বলবে, আমি যেন তার মরা মুখ দেখতে যাই? এতে ওর কী লাভ হবে?
কিন্তু এ নিয়ে গফুরকে কিছু বললাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘নিরু কি চিকিৎসা ঠিকমতো পাইছিল? ওকে বাঁচানো কি একেবারেই সম্ভব ছিল না?’
গফুর বলল, ‘আমি নিরুক লিয়ে হসপিটালে পৌঁছার আগেই রব্বানিক ফোন দিয়ে সব কলাম। হসপিটালে পৌঁছে দেখি, রব্বানি গেটত খাড়ায়া আছে। নিরুক সাথে সাথে ইমারজেন্সিত লিয়ে গেল।’
রূপনগর জেলা হাসপাতালের রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার ডা. গোলাম রাব্বানি আমাদের ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধুদের একজন। খুব দরদি ও দায়িত্ববান ডাক্তার হিসেবে তার খ্যাতি আছে। নিরুর দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে যে তার হাসপাতালে ছুটে যাবে এবং নিরুকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। তার মানে নিরুর চিকিৎসায় যে কোনো ঘাটতি ছিল না, এ নিয়ে আমার আর কোনো সংশয় থাকল না।
‘আধঘণ্টাও পার হয়নি,’ গফুরের কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘রব্বানি ইমারজেন্সিত থে বারায়া অ্যাসে কলো, না রে, নিরুক বাঁচান গেল না।’
‘নিরুর বাড়ির লোকজন আসেনি? তুই বিশ্বনাথদাকে খবর দেসনি?’
‘নিরুক লিয়ে হসপিটালে যাওয়ার রাস্তা থ্যাকেই বিশ্বদাক ফোন দিয়ে ঘটনা বলছিলাম। বিশ্বদা সাথে সাথে মোটরসাইকেল লিয়ে চলে আসছিল। আমরা একসাথেই নিরুক হসপিটালে লিয়ে গেছিলাম।’
নিরুর স্বামী বিশ্বনাথ নন্দীকে আমরা বিশ্বদা বলে ডাকি। সেও রূপনগরেরই ছেলে। আমাদের চেয়ে সম্ভবত বছর তিনেকের বড়। আমরা যখন রূপনগর কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে, বিশ্বদা তখন সেখানে বিকম পড়ছিল। নিরুর সঙ্গে তখন আমার ভীষণ প্রেম। ও তখন গার্লস স্কুলে ক্লাস টেনে। আমরা জানতাম যে আমাদের কপালে দুঃখ আছে; কারণ, আমি মুসলমান আর নিরু হিন্দু। কিন্তু আমরা সেই দুঃখ মেনে নিতে রাজি ছিলাম না। নিরু আমাকে বলত, ‘পালাতে হবে। অনেক অনেক দূরে চলে যেতে হবে, যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না, জানতেই পারবে না আমরা কে কী।’
কিন্তু আমরা পালিয়ে যাওয়ার জায়গা খুঁজে পাইনি। আমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করে সোভিয়েত সরকারের বৃত্তি পেয়ে মস্কোয় চলে গেলাম। নিরু তখন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে। আমাকে বলল, ‘তুমি যাও। তারপর আমি পাস করলে আমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কইরো। মস্কোয় তো হিন্দু-মুসলমান নাই। এইটাই আমাদের একমাত্র রাস্তা।’
নিরুর প্রত্যাশাটা অবাস্তব ছিল না। আমরা ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে খেলাঘর করতাম, তারপর ছাত্র ইউনিয়ন। আমি সোভিয়েতের বৃত্তি পেয়েছিলাম ছাত্র ইউনিয়ন করার কারণেই। নিরুরও সে যোগ্যতা ছিল। আমি মস্কো থেকে সিপিবির রূপনগর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদককে চিঠি লিখে নিরুকে মস্কোয় পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমার অনুরোধ রাখেননি। কেন রাখেননি, তা তখন জানতে পারিনি। পরে জেনেছি, নিরুর মস্কোয় যাওয়া ঠেকিয়েছিল বিশ্বনাথ দাদা, সে–ও ছাত্র ইউনিয়ন করত, পরে সিপিবির মেম্বার হয়েছিল। ধনী পরিবারের ছেলে, তিন পুরুষ ধরে সোনা–রুপার ব্যবসায়ী, পার্টিকে নিয়মিত চাঁদা দিত। নিরুকে মস্কোয় পাঠানোর ব্যাপারে তার আপত্তি পার্টির নেতারা কী করে অগ্রাহ্য করবে?
‘তুই রওনা দে।’ গফুরের কণ্ঠ শুনে সংবিৎ ফিরে পেলাম। ‘বিকালে নিরুর দাহ হোবে। এখনই রওনা না দিলে তোর আর অর মুখ দেখা হোবে না।’
আমার বুকের ভেতর হু হু করে উঠল। মন বলল, তুই ওদের থামা, আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না রূপনগরে পৌঁছাচ্ছি, ততক্ষণ যেন ওরা নিরুর মুখাগ্নি না করে।
কিন্তু মুখে কোনো কথা ফুটল না।
গফুর বলল, ‘কী রে? তুই আসবু না?’
‘সুমনা!’ বলে ডেকে উঠল গফুরের বাল্যবন্ধু হাবিব। সে যেন আমি নই, অন্য কেউ। না, অন্য কেউ নয়, সে নিরুপমা রায়ের জন্ম-জন্মান্তরের সখা হাবিবুর রহমান।
‘কী হলো?’ আর্তনাদ করে ছুটে এল সুমনা, ‘এভাবে চিৎকার করে কেউ ডাকে? কী হয়েছে?’
‘জানো, নিরু মারা গেছে!’
‘আঁ?’
আমার চিৎকার শুনে সুমনা যে শাসানির ভঙ্গি নিয়ে ছুটে এসেছিল, তা একমুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। ওর ক্রুদ্ধ মুখটা করুণ হয়ে উঠল।
সুমনা সব জানে। আমি ওকে নিরুর সব কথা বলেছি। বলতে বাধ্য হয়েছি; কারণ, সুমনা শুনেছে ঘুমন্ত অবস্থায় আমার মুখে নিরুর নাম উচ্চারিত হয়। বিয়ের পরদিন সকালেই আমাকে জবাবদিহি করতে হয়েছিল, ‘ঘুমের মধ্যে নিরু নিরু করছিলে কেন? নিরু কে?’
আমি ভালো ছেলের মতো সব বলে দিয়েছি। সুমনা বুদ্ধিমতী; তার মনে অশান্তি হয়েছে, কিন্তু সে আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি।
নিরুর দুর্ঘটনা ও মৃত্যু সম্পর্কে গফুর আমাকে যা যা বলেছে, আমি সুমনাকে তার সবই বললাম। শুধু বললাম না যে নিরু মৃত্যুর আগে গফুরকে বলে গেছে, আমি যেন তাকে দেখতে যাই। ইতিমধ্যে প্রায় ১১টা বেজে গেছে। সুমনাকে বললাম, আমি নিরুর দাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রূপনগরে যেতে চাই; এখনই রওনা না দিলে হয়তো অনুষ্ঠানটা ধরা যাবে না। শুনে সুমনা শুধু একটা কথা উচ্চরণ করল, ‘যাও।’ কথাটা সে রাগ করে বলল, না স্বাভাবিক মনেই বলল, তা বুঝতে পারলাম না। ওই মুহূর্তে বোঝার তাগিদও খুব একটা বোধ হলো না; দ্রুত কাপড় পরে রূপনগরের বাস ধরার জন্য বাসা থেকে বের হলাম।
ঢাকার কল্যাণপুর থেকে হানিফ পরিবহনের একটা বাস আমাকে নিয়ে চলল রূপনগরের পথে, আমার কৈশোরে যেটা ছিল এক ছোট্ট মহকুমা শহর। ফুলের গন্ধে ভরা সেই রূপনগরে নিরু ছিল, তাদের বাড়ির পাশে একটা গোলগাল পুকুর ছিল, সেই পুকুরের পাড়ে ছিল একটা ঝোপালো শিউলিগাছ। আশ্বিন-কার্তিকে সেই গাছ ফুলে ফুলে ভরে উঠত। সারা রাত ধরে ঝরত সেই সব সুগন্ধি ফুল। আমি খুব ভোরে ছুটে গিয়ে দাঁড়াতাম সেই গাছের তলায়; অজস্র ফুলে ঢাকা পড়ে যেত গাছতলার মাটি। আমি দুহাতের অঞ্জলি ভরে ফুল কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াতাম নিরুর ঘরের জানালায়; নিরু তার আগেই উঠে পড়ত, জানালাটা হাট করে খুলে দিয়ে বসে থাকত আমার অপেক্ষায়। আমি অঞ্জলিভরা শিউলি ফুল নিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে প্রফুল্ল হাসিতে ঝলমল করে উঠত ওর সুন্দর মুখটা।
রূপনগরে পৌঁছাতে সন্ধ্যা নেমে এল। বাস থেকে বাড়িতে না গিয়ে সোজা চললাম শ্মশানঘাটের দিকে। তুলসীগঙ্গা কবেই মরে গেছে, কিন্তু তার পাড়ে প্রাচীন শ্মশানঘাটটাতে এখনো চিতা জ্বলে। আমি যখন সেখানে পৌঁছালাম, ততক্ষণে নিরুর চিতার আগুন আকাশ ছুঁয়েছে। গফুর আগেই ফোনে বলেছিল, ‘তোর আর নিরুক দেখা হলো না রে। এরা চিতা জ্বালায়ে দিল।’
শ্মশানঘাটে গফুর ছিল। আর যেসব বন্ধু সেখানে গিয়েছিল, চিতা জ্বালানোর পর তারা যে যার কাজে ফিরে গেছে। শুধু গফুর থেকে গিয়েছিল। ও আমাকে তখনই বলেছিল, ‘বাস থ্যাকে নামে সোজা শ্মশানত চলে আসবু। আমি এটে আছি, আয়।’
আমি গিয়ে দাঁড়াতেই লোকজনের ভিড়ের মধ্যে থেকে গফুর বেরিয়ে এসে আমার একটা হাত ধরল। কিছু বলল না। চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে রইল। আমি জ্বলন্ত চিতার ভেতর নিরুর মুখ খুঁজতে লাগলাম। একটু পর কেউ পেছন থেকে আমার ডান কাঁধটা চেপে ধরল; ঘাড় ফিরিয়ে দেখি বিশ্বনাথ দাদা। হু হু করে কেঁদে উঠে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি জানতাম ছোট ভাই, তুমি আসবা।’
আমি কিছু বলতে পারলাম না। একটা কথাও আমার মুখে জুটল না। বিশ্বদা আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। আমাদের চোখ জ্বলন্ত চিতার দিকে। একটু পর কেউ তার নাম ধরে ডেকে উঠল, সে সেই দিকে এগিয়ে গেল।
মিনিট পনেরো নীরবে কাটল। তারপর গফুর আমাকে বলল, ‘কতক্ষণ থাকবু?’
আমি বললাম, ‘এই সব শেষ হতে কতক্ষণ লাগে?’ মানে, কতক্ষণে চিতা নিভবে, যেন আগুন নিভে গেলেই আমি নিরুকে দেখতে পাব।
‘ঘণ্টা পাঁচ-ছয়েক তো লাগবেই।’
‘তাহলে তুই চলে যা। আমি আর কিছুক্ষণ থাকি।’
‘আচ্ছা থাক। আমার এখন বাড়িত যাওয়া দরকার।’
গফুর চলে গেল। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম। স্মৃতির তোড়ে ভেসে যেতে লাগলাম, কিন্তু নিরুর মুখটা কিছুতেই মনে পড়ল না। সব স্মৃতি জ্বলজ্বলে, শুধু ওর মুখের ছবিটাই ধরা দিচ্ছে না।
একটু পর এক তরুণী এসে দাঁড়াল আমার সামনে। নরম কণ্ঠে বলল, ‘আঙ্কেল, আমি অনু।’
ওর করুণ বেদনার্ত মুখটা চিতার আগুনের আলোয় জ্বলজ্বল করছে।
‘মার কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি।’
‘তাই!’
‘আমি আপনার সব বই পড়েছি। প্রথম আলোয় আপনার যত লেখা ছাপা হয়েছে, সব পড়েছি। আমরা তো বাসায় প্রথম আলো রাখি আপনার জন্যই।’ কথা বলতে বলতে অনুর কণ্ঠস্বর থেকে বেদনার আড়ষ্টতা কেটে যেতে লাগল। ‘আঙ্কেল, আপনি এতগুলো গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, কিন্তু কোথাও মায়ের কথা নাই কেন?’
‘নাই?’
‘না তো। আমি তো পাইনি। কেন লেখেননি, আঙ্কেল?’
‘বউয়ের ভয়ে।’
অনু হেসে উঠল, হঠাৎ চিতার দিকে ফিরে তাকাল, ওর মুখটা দপ করে নিভে গেল।
একটু পর বলল, ‘মায়ের উপরে আপনার খুব রাগ, তা–ই না?’
‘না তো।’
‘আমি জানি, আঙ্কেল। ফেসবুকেও আপনারা কেউ কারও ফ্রেন্ডলিস্টে নাই। আর রাগ করে থাকবেন না, আঙ্কেল।’
‘রাগ করে থাকলে কি আজ আসতাম?’ মিথ্যা করে বললাম আমি। নিরুর ওপরে সত্যিই আমার ভীষণ রাগ।
চিতা নিভতে নিভতে রাত ১১টা বেজে গেল। ওরা একটা কাঁসার ঘড়া ভর্তি করে নিরুর চিতাভস্ম তুলে নিল। কী করবে ছাইগুলো দিয়ে, কে জানে। মরা তুলসীগঙ্গার তীরে হু হু করে বইতে লাগল হেমন্তের রাতের হিমেল বাতাস। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল; শীতে না অন্য কিছুতে, কে জানে!
(গ্যাপ হবে)
খুব ভোরে ঢাকায় ফেরার জন্য বাসস্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে যেতে যেতে গিয়ে দাঁড়ালাম নিরুদের বাড়ির সামনে। আমার দুচোখ খুঁজতে লাগল সেই গোল পুকুর, তার পাড়ের শিউলিগাছটাকে। কিন্তু কোথায় পুকুর, কোথায় গাছ! নিরুদের বাড়ির ডানে-বাঁয়ে শুধু বাড়ি আর বাড়ি। চারদিকটা এমন ঘিঞ্জি যে আমার দম বন্ধ হয়ে এল; দ্রুত পা চালিয়ে ছুটলাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। রূপনগর ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই জঘন্য শহরে আমি আর কোনো দিন আসব না।
হানিফ পরিবহনের কাউন্টারে ঢুকে জানতে চাইলাম, ঢাকার টিকিট আছে কি না। বলা হলো, একটামাত্র টিকিট আছে, সিট একদম পেছনের সারিতে।
‘ওইটাই দেন।’
‘১ হাজার ২০০ টাকা।’
টিকিট নিয়ে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে ফুটপাতে এসে দাঁড়াতেই দেখি, দুই অঞ্জলিভর্তি শিউলি ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনু, ভোরের আভায় উদ্ভাসিত মুখে অনাবিল হাসি। ফুলগুলো আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘ফিরে গিয়ে একটা উপন্যাস লিখবেন। নাম দিবেন নিরুপমা।’
বাসে বসে ঝিমাতে ঝিমাতে স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নে এমন এক দশায় পৌঁছে গেলাম যে জগৎটাকে মিথ্যা বলে মনে হতে লাগল। আমি যেন এক অলীক জগতে ঢুকে পড়েছি; চারদিকে যা দেখছি, শুনছি তার কিছুই সত্য নয়। এই মিথ্যা জগতের ওপারে একটা সত্য জগৎ আছে; আমাকে এখান থেকে বেরিয়ে ওই জগতে ফিরে যেতে হবে।
বিকেল সোয়া চারটায় বাসার দরজায় কলবেল চাপলাম। একটু পর দরজা খুলে গেল। দেখলাম, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিরুপমা রায়। অবাক হলাম না; কারণ, আমি জানি এটা সত্য নয়; চারপাশে যা কিছু ঘটছে, তার কিছুই সত্য নয়।
‘তুমি কখন এলে? সুমনা কই?’
‘মানে? মাথাটা নষ্ট করে ফিরলা নাকি?’
আমি কিছু বলতে যাব, তার আগেই পকেটে ফোন বেজে উঠল। ফোনসেট বের করে দেখি নম্বরটা অচেনা। তবু রিসিভ করলাম। আমি ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশে একটা মেয়ের কণ্ঠ বেজে উঠল, ‘আঙ্কেল, আপনি কি এখনো রূপনগরে আছেন?’
‘কে?’
‘আমি আঙ্কেল, অনুপমা। আপনি ঢাকায় চলে যাননি তো?’
‘কেন, বলো তো?’
‘একটু দেখা করতাম...।’