একটি শহুরে এওয়াজের ঘটনা

ফল্যা্ল্যাটে কোনোভাবে একটা ব্যাঙ ঢুকেছে। পরপর কয়েকবার মৃদুস্বরে ডাকল। অবাক হলাম না। কদিন ধরে যেমন বৃষ্টি হচ্ছে, ব্যাঙ বাইরে থেকে চলে আসতে পারে। তবে আমার এই ফ্ল্যাট পাঁচতলায় এবং ওপরে ওঠার জন্য সিঁড়িই ভরসা, লিফট নেই।

অফিস থেকে ফিরে একেক দিন ফ্রেশ হতে ইচ্ছা করে না। আজও করছিল না। সোফায় অযথা বসে ছিলাম চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর মানজুর ভাই কল দিলেন।

‘জুয়েল ভাই, কচ্ছপ কিনবেন নাকি? ভালো কিছু কচ্ছপের সন্ধান পাইছি।’

‘কচ্ছপ কেন ভাই? কচ্ছপ দিয়ে কী করব আমরা?’

‘পুষবেন। বাসায় কাচের জার আছে না?’

‘না ভাই, জার তো নাই।’

‘জার কোনো ব্যাপার না। আমার বাসায় দুইটা আছে, একটা আপনাকে দিয়ে দেব।’

‘ভাই, কচ্ছপ পুষে কী লাভ? কচ্ছপের মাংস, ডিম—কিছুই তো খাইতে পারব না।’

‘আপনার যত স্থূল চিন্তা। অল্প দামে এক ডজন কচ্ছপ পাইছিলাম। আপনি অর্ধেক নিলে অর্ধেক আমি নিতাম, নেবেন না?’

‘না ভাই। রাখার জায়গা নাই। এতগুলা
কচ্ছপ।’

‘ধুর মিয়া, কোনো কিছুতে আপনার আগ্রহ নাই।’

আমি কিছু বলার আগে উনি ফোন রেখে দিলেন। আমার ধারণা, এখন মার্কেটিংয়ের নিলয়কে ফোন দেবেন এবং এক ডজন কচ্ছপের অর্ধেকটা নিতে নিলয় রাজি হয়ে যাবে। মানজুর ভাইয়ের কথা সে ফেলতে পারবে না।

আমার স্ত্রী ত্রয়িতা একজন চিকিৎসক। যে রাতে হাসপাতালে ডিউটি থাকে ওর, বাসায় ফেরার খুব তাড়া থাকে না আমার। সেই সব সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে সহকর্মী মানজুর ভাইয়ের সঙ্গে বিস্তর আলাপ হয়। অধিকাংশ আলাপেরই কোনো দিকচিহ্ন থাকে না। এই একটু আগেও আমরা সময়হীন বিশ্ব নিয়ে আলাপ করে এসেছি। আমি তেমন কিছু না বুঝলেও উনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। সময়হীন বিশ্বে সবাই একই সাথে পৃথিবীর সবখানে অবস্থান করছে, এ রকমের কোনো একটা ব্যাপার।

কিন্তু সেই ভিন্ন ডাইমেনশনের আলাপ থেকে কচ্ছপে কীভাবে এলেন, আমি বুঝলাম না। ফোনটা রেখে পোশাক বদলে সুতি একটা ট্রাউজার আর টি–শার্ট পরলাম। পানি খাওয়ার জন্য রান্নাঘরে ঢুকেছি। শব্দটা কানে এল তখন। একটা ব্যাঙ ডাকছে থেমে থেমে, নিচু স্বরে।

গ্লাসভরা পানি শেষ করলাম। সিঁড়ি বেয়ে এত ওপরে একটা ব্যাঙ উঠে এল কীভাবে, এটা ভাবতে ভাবতেই ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসলাম আবার। ব্যাঙের ডাকটা আচমকা বাড়ল এবং রান্নাঘরের প্রবেশমুখের মেঝেতে ওকে বসে থাকতে দেখলাম আমি। ধূসর রঙের একটা কোলা ব্যাঙ। আকারে একটা এক দিনের মুরগির বাচ্চার সমান হবে। এক জায়গায় বসে থাকল না। কয়েক লাফে এগিয়ে এল। থামল আমার হাত পাঁচেক দূরত্বে। ব্যাঙের চেহারায় এক রকমের বিষণ্নতা।

‘জীবনটা ইটচাপা দূর্বাঘাস হয়ে গেল, বুঝলে?’

কথাটা বলল কি ওই ব্যাঙ? কিছুটা ভয় পেয়েই হয়তো চুপ করে রইলাম। ফাঁকা ঘরে এমন ডিলুশন মানুষের হতে পারে।

ব্যাঙটা তখন আবার কথা বলে উঠল। একটু নিচু লয়ের ফ্যাসফেসে কণ্ঠস্বর।

‘তোমাকে খুঁজে পেতে ভালোই বেগ পেতে হয়েছে। সহজ ছিল না কাজটা।’

পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম যে আমার ভ্রম হচ্ছে। ব্যাঙ কথা বলছে না, আমিই ভুল শুনেছি। জিনিসটাকে ঘর থেকে বের করা দরকার। কত দুনিয়ার নোংরা ঘেঁটে ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে কে জানে। তবে আপাতত থাকুক, আমি এই ফাঁকে কিছু কাজ সেরে নিতে পারি।

বারান্দায় মেলে রাখা কাপড়গুলো উঠিয়ে ভেতরে এনে রাখলাম চেয়ারের ওপর। টবের ক্যাকটাসগুলোয় পানি ঢাললাম। ব্যালকনিতে রাজ্যের ধুলা জমেছে এক দিনেই। ঢাকা শহর এখন ধুলার রাজ্য। ফ্লোর মপ এনে পানি ঢেলে ব্যালকনিটা পরিষ্কার করলাম। কেমন ভেজা বাতাস। মনে হয় আবার বৃষ্টি হবে। তখন দেখলাম বেডরুমে চলে এসেছে ব্যাঙটা।

‘তুমি ঠিক আমাকে পাত্তা দিলে না। ভাবছ আমি তোমার মনের ভুল। তা তো না।’

‘ব্যাঙদের বিষয়ে আমার ধারণা নেই। তুমি আমার সঙ্গে কথাই–বা বলতে চাইছ কেন?’

‘চাইছি। কারণ, আমার ধারণা তুমি একটা ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছ এবং কাউকে সেটা বলতে পারছ না।’

ঝামেলার মধ্য দিয়ে আমি আসলেই যাচ্ছিলাম কদিন ধরে। বলা যেতে পারে কয়েক মাস। ঝামেলাটা লাগিয়েছিল তৈয়ব।

আরও অনেক ছুটির দিনের মতো সেদিনও সন্ধ্যায় কাঁচাবাজার সেরে হেঁটে ফিরছিলাম বাসায়। তখন আবু তৈয়বের সঙ্গে দেখা। তৈয়ব আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। শেষ দেখা হয়েছিল কবে ভুলে গেছি। কিন্তু আমরা একে অন্যকে চিনে ফেললাম। আলাপের একপর্যায়ে তৈয়ব বলল, ‘তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো হইছে। কী এক ঝামেলায় যে আছি।’

তৈয়বের সঙ্গে এতকাল পর দেখা হয়ে আমি খুশিই হয়েছিলাম। কৈশোরের পাগলাটে দিনগুলোর মিঠে আমেজ যেনবা টের পাচ্ছিলাম আমার জিবে।

‘দোস্ত, কী ঝামেলা, বলে ফেলো দেখি।’

‘কেমনে যে বলি। কিছুদিন ধরে বেশ কষ্টে আছি এই নিয়া। তোমার ভাবির লগে, মানে আমার বউয়ের লগে তো বন্ধু ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছে। কাগজপত্র এখনো ফাইনাল হয় নাই। কিন্তু ডিভোর্স হয়ে যাবে।’

হুট করে ও এমন একটা প্রসঙ্গ আনবে ভাবিনি। অস্বস্তি নিয়ে চেয়ে রইলাম। ভেবে পেলাম না কী বলব। হয়তো সে বুঝল। নিজে থেকেই জানাল, ‘মিলতেছিল না আমগো, নানান ঝগড়াঝাঁটি। বিয়ার আগে বুঝি নাই দুইজন এমন দুই পদের মানুষ। তো ডিভোর্সে আমার সমস্যাও আছিল না। তোমার ভাবি কথাটা উঠাই তো কিছু হইলেই, আমিও একদিন রাজি হইয়া গেলাম।’

‘তারপর?’

‘দিন ভালোই কাটতেছিল। চিল মুডে আড্ডা-উড্ডা পিটাই। জবও ভালো যাইতাছে। নিজেরে স্বাধীন লাগে। মনে মনে কই যে মাইয়া মানুষের ঝামেলা আর লমু না, ধুর। ঝামেলাটা বাধল এক রাইতে। শুইয়া আছি। আচানক মনে হইল, আমাদের তো ডিভোর্স হইয়া যাবে। এখন আমি জোয়ান মানুষ। একদিন বুড়া হমু। আমার বউও বুড়া হইব। হেয় যদি মইরা যায়, আমি জানুম কেমনে? মানে বুঝুম কেমনে জিনিসটা। একদিন একটা মাইয়ারে এত ভালোবাসছি। একলগে সংসার করছি। বুড়া বয়সে সে মইরা গেল নাকি বাইচা থাকল, এইটা যদি আমি না জানি, কী ভয়ানক লোনলি একটা ঘটনা হইব!’

আমি চুপ করে রইলাম। তৈয়ব অস্থির কণ্ঠে বলে চলল, ‘এরপরেই ধরো, আমার শান্তি লোপাট হইল। খালি মনে হয়, বুড়া বয়সে যেন অন্তত তার সন্ধানটা পাই, এই জন্যও তারে আমার দরকার। এভাবে একলা ছাইড়া দেওন তো ঠিক না।’

‘ভালো তো। বউকে নিয়ে আসো বাসায়। মাফটাফ চেয়ে নাও। সমস্যা তো মিটেই গেল।’

‘না বন্ধু, সমস্যা মিটে নাই।’

‘কেন?’

‘তোমার ভাবি আমার কাছে ফিইরা আসতে রাজি না। আমার লগে সংসার হে আর করব না। ওরে আসলে দোষও দেই না। তয় মনে একটা শখ জাগে আজকাল বুঝচ্ছ।’

তৈয়ব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমাকে তার শখের কথা বলে। তা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। কিছুটা মন খারাপও লাগে। বেচারা এখনো বউয়ের প্রেমে অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু হয়তো সত্যিই ওদের সংসারটা টিকবে না, কে জানে।

তবে সে রাতের পর তৈয়বের ওই শখের পোকাটা আমার মাথায় অতিগোপনে ঢুকে পড়ল। রাতে ঘুমাতে পারি না ঠিকমতো। জটিল সব অপারেশন আর দীর্ঘ অ্যাডমিশনের দিনগুলো শেষে ঘরে ফিরে ক্লান্ত ত্রয়িতা আমাকে তার হাসপাতালের গল্প শোনায়। আমি ভাবি যে ওকে কথাটা বলব, কিন্তু বলা হয় না। এত নৈকট্যের পরও আমাদের মাঝে কোনো দূরত্ব নেই, তা তো নয়। সেই দূরত্ব যদি হঠাৎ বাড়তে শুরু করে? শেষ বয়সে কি একে অন্যের খোঁজ নেওয়ার মতো অবস্থায় থাকব আমরা, নাকি সেটা আর আজকের মতো এমন গুরুত্ববহ কিছু মনে হবে না তখন?

ব্যাঙটা আমাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে, তার কণ্ঠ ফ্যাসফেসে শোনায়।

‘শোনো জুয়েল, তোমার সংকটের সমাধান আমার কাছে আছে। অর্থাৎ তোমার শখটা পূরণ করা অসম্ভব কিছু না।’

‘কীভাবে? তুমি কি চেরাগের দৈত্য যে শখ পূরণ করবে?’

‘না, আমি এক শহুরে ব্যাঙ। কিন্তু মানুষের প্রতি ব্যাঙেরা কেমন সহমর্মী জানো না তোমরা।’

‘বলো তোমার সমাধান, শুনতে দোষ কী?’

‘আমাকে তুমি খুন করো। ব্যাঙের একটা স্পেশাল ডিশের রেসিপি আমি তোমাকে বলে দেব। সেভাবে রাঁধবে। তুমিও টানা চার দিন রোজ ঠিক এই সময়ে একটু একটু করে খাবে। পঞ্চম দিনেই তোমার ইচ্ছেপূরণ হবে।’

‘আমার ইচ্ছেপূরণে আত্মাহুতি দেবে তুমি? মজা মারছ নাকি?’

‘মজা মারছি না। কারণ, এর বিনিময়মূল্য নেব আমি।’

কেউ কিছু বলি না আমরা আর। তারপর চারদিকে কেমন এক নীরবতা নামে।

ত্রয়িতার ড্রয়ার থেকে সার্জিক্যাল নাইফ বের করে ব্যাঙটাকে কেটেকুটে নিতে সমস্যা হয় না আমার। প্রথমে একটু বমি পাচ্ছিল এই যা। কিচেন ক্যাবিনেট থেকে সয়া সস, ভিনেগার, গোলমরিচ আর লবণ নিলাম। রসুন ছিলে ভিনেগারে চুবিয়ে রেখেছিলাম। হালকা আঁচে ভিনেগারে সটে করা রসুন চড়িয়ে দিলাম কড়াইয়ে। তার ওপর সয়া সস, পানি, চিনি আর লবণ দিলাম স্বাদমতো। কিছুক্ষণ পর ব্যাঙের মাংসগুলো ছড়িয়ে মিশিয়ে দিলাম। আধা ঘণ্টার মধ্যে মাখো মাখো হয়ে এল জিনিসটা। সুন্দর ঘ্রাণ ছেড়েছে।

প্রতিদিন গোপনে ‘আদোবোং পালাকা’ নামের এই ডিশ একটু একটু করে খেয়ে গেলাম। ব্যাঙের মাংস সুস্বাদু। চতুর্থ দিন রাতে যখন পুরো বিষয়টা শেষ হবে, ত্রয়িতা তখন হাসপাতালে। খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ বসে রইলাম ড্রয়িংরুমের সোফায়। যা ঘটছে, সবটাই হয়তো স্বপ্ন নাকি স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝামাঝি কোনো অবস্থায় আমি আছি? এসব ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ালাম। কথা বলা ব্যাঙটার নির্দেশ অনুযায়ী একটা আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে এখন। আমাদের বেডরুমের এক কোনায় লম্বা একটা আয়না ছিল। সেটা খুঁজে পেলাম না। বাধ্য হয়ে খুব ধীর পায়ে টয়লেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। আলো জ্বেলে আয়নায় তাকিয়ে দেখতে পেলাম, আমার চোখ দুটি কেমন ঘোলাটে, গর্তে ঢুকে গেছে। কুঁচকে গেছে মুখের চামড়া। মাথার চুলে পাক ধরেছে, আর সামনের দিকে বলতে গেলে চুলই নেই।

তখন কলবেল বেজে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতে বেশ কষ্ট হলো আমার। হাঁটু আর কোমর মটমট করে আপত্তি জানাচ্ছে। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ যুবক। আগে কখনো না দেখলেও ওকে চিনে নিতে ভুল হলো না আমার।

পরদিন ভোরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য দক্ষিণবঙ্গের শহর নিদাঘ। ত্রয়িতা কেমন আছে, জানি না। কিন্তু তার সন্ধান মিলবে নিদাঘে গেলে।

ট্রেনের কেবিনে শুধু সেই আগন্তুক যুবক আর আমি। যুবকের ঠোঁটে মৃদু হাসি। কিছুটা ক্লান্ত কণ্ঠে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন লাগছে তোমার এই জীবন? এখন কি মানুষের বদলে ব্যাঙদের প্রতি সহমর্মিতা জাগে?’

যুবক পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তার চেয়ে বলো, এই যে শখ পূরণের নেশায় গোটা জীবনটা একমুহূর্তে ফুরিয়ে গেল, এত এত ভবিষ্যতে চলে এলে, কেমন লাগছে তোমার?’

জবাব দিলাম না আমি। মনে মনে বললাম, ‘যে জীবন আমরা পার করি, সে একমুহূর্তের হোক কিংবা দীর্ঘতর—সকলই ফুরায়ে যায়। আমরা তাকে ধরতে পারি না। সময় আমাদের আবিষ্কৃত এক ভ্রান্ত ধারণামাত্র।’

সব ছাপিয়ে আমাদের ট্রেন সামনে এগিয়ে চলল ঝড়ের বেগে।