ভেতো বাঙালির ভাত খাওয়ার ইতিহাস

বাঙালির খাদ্যতালিকায় কবে থেকে ভাত? প্রাচীন বইপত্র ও নথি ঘেঁটে তার তত্ত্বতালাশ

কোলাজ: সৈয়দ লতিফ হোসাইন

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমান বিশ্বে মাথাপিছু হিসাবে বাঙালি পৃথিবীর ১ নম্বর ভাতখেকো জাতি (সূত্র: ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ)। বছরে মাথাপিছু ২৫৭ কেজি ভাত খায় প্রতে৵ক বাংলাদেশি। আবার ইউরোপভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থার মতে, ভাতখেকো হিসেবে বাঙালির পয়লা নম্বর আসন হারিয়েছে গাম্বিয়ার কাছে। বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৪ নম্বরে। তাতে মনে করা যেতে পারে, ভাতের ওপর চাপ কমিয়ে বাঙালি অন্যান্য খাবারও খেতে শুরু করেছে বলে আফ্রিকার কাছে প্রথম স্থান হারিয়েছে।

পরিসংখ্যান যা–ই বলুক, বাঙালির ভাত খাওয়ার ইতিহাস যে আফ্রিকার চেয়ে পুরোনো, তাতে সন্দেহ নেই। ভাতের উৎপত্তি হয়েছিল এশিয়া অঞ্চলেই। হাজার হাজার বছর ধরে বিস্তর অন্ন ধ্বংস করে এই গাঙ্গেয় ভূখণ্ডে টিকে আছে বাঙালি জাতি। ভাতের সঙ্গে ডাল-সবজি-মাছ-মাংসও কম ধ্বংস হয়নি। এ খাবারগুলো এই ভূখণ্ডে হাজার হাজার বছর ধরে একই ধারাবাহিকতা নিয়ে বহাল। এক থালা পান্তার সঙ্গে একটি পোড়ামরিচ বা পেঁয়াজ এখনো অনেক মানুষের খাবার। বিশেষ দিনগুলোতে দই-চিড়া বা দুধ-খই-মুড়কি, পিঠা-পায়েস-পুলি ইত্যাদি যত ধরনের খাদ্যসামগ্রী তৈরি হয়, তারও প্রধান উপাদান চাল কিংবা ভাত। ভেতো বাঙালি কত হাজার বছর ধরে ভাতের সঙ্গে যুক্ত?

  বাঙালির ভাতের ইতিকথা

প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের গোড়া থেকেই খাদ্য হিসেবে ভাতের উল্লেখ দেখা যায়। সাধারণ খাবার ছাড়াও ঔষধি হিসেবেও ধান–চালের ব্যবহার ছিল। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভগবান ইন্দ্র ও বিষ্ণু ধান ও দুধ দিয়ে তৈরি একপ্রকার সুরা পান করতেন। আবার রামায়ণ–এও সেদ্ধ ভাতের উল্লেখ আছে। সেই সঙ্গে মুড়িও খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় ছিল।

মহাভারত–এ উল্লেখ আছে, ঋণ থেকে মুক্তি পেতে, ব্রাহ্মণদের খুশি করতে হরিণের মাংসের সঙ্গে ভাত, ঘি, দুধসহ পানীয় দেওয়া হতো। মহাভারত–এর সময়ে ধনী-গরিব সবার জন্য ভাতই ছিল সহজলভ্য খাবার। প্রাচীন ভারতীয় প্রায় সব সাহিত্যিক বয়ানেই ভাতের বহুল ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়। রাজকীয়, ধর্মীয় পার্বণ, দৈনন্দিন জীবনের নানা উপলক্ষ—জন্ম, মৃত্যু বা বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাতের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার ছিল। মনুসংহিতা থেকে জানা যায়, শিশুদের প্রথম ভাত খাওয়া উপলক্ষে ‘অন্নপ্রাশন’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এ ধরনের অনুষ্ঠান বাংলাদেশে এখনো প্রচলিত।

ইতিহাসে বহুকাল আগেই ভাতের কথা পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে তার প্রত্নতাত্ত্বিক নজির মিলেছে অল্পকাল আগে। সাম্প্রতিককালে উয়ারী–বটেশ্বরে খনন করে গবেষকেরা পোড়া চালের নিদর্শন পেয়েছেন। বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের যে নমুনা পাওয়া যায়, সেখানেও আছে পোড়া চালের অস্তিত্ব। মহাস্থানগড়ের ব্রাহ্মীলিপি থেকে জানা যায়, সে সময় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। ফলে স্থানীয় শাসককে জনগণের মধ্যে ধান বিতরণের নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৯৬৭ সালে শালবন বিহার খনন করে খ্রিষ্টীয় দশম শতকের অঙ্গারীভূত চালের অবশেষ পাওয়া গেছে। তাতে মনে হয়, বর্তমানে যে ধরনের খাবারে বাঙালি অভ্যস্ত, সেটা কয়েক হাজার বছরের পুরোনো।

বাঙালির ভাত খাওয়ার ইতিহাস যে আফ্রিকার চেয়ে পুরোনো, তাতে সন্দেহ নেই। ভাতের উৎপত্তি হয়েছিল এশিয়া অঞ্চলেই।

বাঙালির ডাল-ভাত

বাঙালির খাদ্যতালিকায় ভাতের পরেই ডালের অবস্থান। ডালের সঙ্গে ভাতের সম্পর্কটাও আজকের নয়। গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে মানববসতির আদিযুগ থেকে চালের সঙ্গে ডালের নমুনাও মিলেছে। উয়ারী–বটেশ্বরে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের স্তরে মসুর, খেসারি, মাষকলাই ও মুগডালের নমুনা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মসুর ও খেসারির জন্ম দক্ষিণ–পশ্চিম এশিয়ায় এবং মাষকলাই ও মুগডালের উৎপত্তি দক্ষিণ ভারতে। ছোলা, খেসারি ইত্যাদি পশ্চিম এশিয়ার ডাল। এগুলো ওই অঞ্চলের আরও দুটি প্রধান ফসল যব ও গমের সঙ্গে ইরান ও পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া হয়ে বঙ্গদেশে প্রবেশ করেছিল। সুতরাং ডাল–ভাতের সম্পর্কের ইতিহাসও কয়েক হাজার বছরের পুরোনো।

ডাল–ভাতের পাশাপাশি শাকসবজিও বাঙালির খাদ্যের অন্যতম উপাদান। প্রাচীন সাহিত্য ও পুঁথিপত্রের সূত্র ধরে অনুমান করা যায়, এ যুগে আমরা যেসব তরকারি খেয়ে থাকি, তার অধিকাংশ প্রাচীনকালেও ছিল। যেমন বেগুন, লাউ, কুমড়া, ঝিঙে, কাঁকরোল, কচু প্রভৃতি অতি প্রাচীনকালের খাদ্যতালিকাতেও পাওয়া যায়। তবে এখনকার জনপ্রিয় সবজি আলুর ব্যবহার বাংলায় পর্তুগিজ আগমনের পর থেকে শুরু হয়েছিল। মধ্যযুগে মুসলমানদের আসার পরে নতুন করে যুক্ত হয় বরবটি। উয়ারী-বটেশ্বর ও বিক্রমপুর থেকে পাওয়া গেছে বেশ কিছু শাকসবজি—লালশাক ও ডাঁটা–জাতীয় শাকের পোড়া অবশেষ।

মাছে–ভাতে বাঙালি

পাতের মধ্যে একটুকরা মাছ ছাড়া বাঙালির ভোজ কি কল্পনা করা যায়? এ দেশে পুকুরভরা মাছ ছাড়াও খাল–বিলে হরেক জাতের মিঠাপানির মাছ পাওয়া যায়। হিমালয় পর্বত থেকে নেমে আসা দুই শতাধিক নদী বঙ্গদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। তাদের এই দীর্ঘ যাত্রাপথে যে বিপুল জলাভূমি অতিক্রম করতে হয়েছে, তার বেশির ভাগই বাংলাদেশে। সেসব এলাকায় আছে অসংখ্য মাছের বাসস্থান। পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় মৎস্যসম্পদের দেখা মেলে এই অঞ্চলেই। অতএব এখানকার মানুষ ভাতের সঙ্গে মাছও খাবে, এটাই স্বাভাবিক। গল্পগাথা ছাড়াও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায়ও এর প্রমাণ মিলেছে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন জনপদ হিসেবে উয়ারী–বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য আছে। আমরা সেখান থেকেও বেশ কিছু নজির পেয়ে যাই।

উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে প্রথম শতকের রৌপ্যমুদ্রায় বিভিন্ন জাতের মাছের প্রতীকের ছাপ আছে। এ ছাড়া বগুড়ার মহাস্থানগড় ও রাজশাহীর বাইগাছায় পাওয়া রৌপ্যমুদ্রায় বিভিন্ন ফর্মে মাছের প্রতীক দেখা যায়। সোমপুর মহাবিহার ও ময়নামতির পোড়ামাটির ফলকে মাছের উপস্থাপন প্রায় সাধারণ ঘটনা। প্রাচীন বাংলার জাতিবিন্যাসের সবচেয়ে পুরোনো নথি বৃহর্দ্ধমপুরাণ অনুযায়ী, রোহিত (রুই), শফর (পুঁটি), সকুল (শোল) ও শ্বেতবর্ণ আঁশযুক্ত অন্যান্য মাছ ছিল ব্রাহ্মণদের উপযোগী খাবার। যেসব মাছ গর্তে কিংবা কাদায় বাস করে, যেগুলোর মুখ সাপের মতো এবং আঁশ নেই, এমন মাছ ব্রাহ্মণদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ। একই বইয়ে প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ তেলের তালিকা দিতে গিয়ে খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে ইলিশ মাছের তেলের বহুল ব্যবহারের কথা বলেছেন। এসব তথ্যের সাক্ষ্য থেকে নিশ্চিত বলা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব সময়কাল থেকে বাঙালির পাতে ভাতের সঙ্গে অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে উপস্থিত ছিল মাছ। আবহমান বাংলার ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটির উৎপত্তি এখান থেকেই। 

ভাতের দেবী শ্রীদেবী  

ভাতের ইতিহাসের সর্বশেষ পর্বে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জের মজার এক উপাখ্যানের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। ওই দ্বীপগুলোতে হাজার হাজার বছর ধরে ফসল উৎপাদন এবং উর্বরতা শক্তির প্রতীক হিসেবে দেবী শ্রী বা শ্রীদেবী বিশেষ এক দেবীর পূজা করা হয়ে আসছে। ভারতবর্ষে যেভাবে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে লক্ষ্মীর পূজা করা হয়, ইন্দোনেশিয়ায় একইভাবে শ্রীদেবীর পূজা চলে। কোনো কোনো গবেষকের অনুমান, সুপ্রাচীনকালে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সেই পূজার রীতি ভারতবর্ষ কিংবা বঙ্গদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপাঞ্চলে।

আবার অনেক গবেষক মনে করেন, জাভা দ্বীপে শ্রীদেবীকে পূজা করার ইতিহাস আরও প্রাচীন। এ নিয়ে বালি ও জাভা দ্বীপে একটা কিংবদন্তির গল্প চালু আছে।

বহুযুগ আগে স্বর্গের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর দেবতা ‘বাতারা গুরু’ নতুন প্রাসাদ নির্মাণের জন্য সব দেব-দেবীকে তাদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, কেউ এই আদেশ অমান্য করলে তার হাত–পা কেটে ফেলা হবে। বাতারা গুরুর আদেশ শুনে ঘাবড়ে গেল সাপের দেবতা অন্তবোগা। কারণ তাঁর হাত-পা কিছু নেই। সে তো চাইলেও এই আদেশ পালন করতে পারবে না। নিরুপায় হয়ে সে পরামর্শের জন্য গেল বাতারা গুরুর ছোট ভাই বাতারা নারদের কাছে; কিন্তু বাতারা নারদও কোনো উপায় করতে পারলেন না। নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে অন্তবোগা তার সামনে বসে কাঁদতে শুরু করল। সে যখন কাঁদছিল, তখন তার চোখ থেকে তিনটা অশ্রুবিন্দু মাটিতে পড়ল। মাটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে অশ্রুবিন্দুগুলো মুক্তার মতো সুন্দর চকচকে ডিমে পরিণত হলো। বাতারা নারদ এই ‘রত্নগুলো’ বাতারা গুরুকে উপহার দেওয়ার পরামর্শ দিলেন এই ভেবে যে এগুলো উপহার পেলে খুশি হয়ে বাতারা হয়তো তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন।

ধানখেতে শ্রীদেবীর পূজা

পরামর্শ শুনে অন্তবোগা ডিম তিনটি মুখে নিয়ে বাতারা গুরুর প্রাসাদের উদ্দেশে রওনা হলো। পথে তার দেখা হলো একটা ইগলের সঙ্গে। ইগলটা তার সঙ্গে আলাপ জুড়তে চাইল; কিন্তু মুখে ডিম নিয়ে কোনো কথা বলতে পারছিল না অন্তবোগা। ইগল ভাবল, অন্তবোগা দেমাগ দেখাচ্ছে। খেপে গিয়ে সে অন্তবোগাকে আক্রমণ করে বসল। ফলে একটি ডিম মাটিতে পড়ে গেল ভেঙে। এতে অন্তবোগা তাড়াতাড়ি ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে গেল; কিন্তু ইগল আবারও আক্রমণ করলে আরেকটি ডিমও ভেঙে যায়। ভয়ে অন্তবোগা এবার একটি গর্তে ঢুকে পড়ল। তারপর কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে যখন বাতারা গুরুর প্রাসাদে পৌঁছাল, তখন তার মুখে মাত্র একটি ডিম।

সেই একটি ডিম উপহার পেয়েই বাতারা গুরু তাকে ক্ষমা করে দিলেন। বললেন, একটি বাসা তৈরি করে ডিম ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। অলৌকিকভাবে সেই ডিম ফুটে বের হলো অপূর্ব সুন্দর এক দেবশিশু। সেই শিশুকে বাতারা গুরু ও তাঁর স্ত্রীকে উপহার দিল অন্তবোগা।

ওই শিশুর নাম ছিল শ্রী পোহাসি। বড় হওয়ার পর সে একটি রূপবতী রাজকন্যায় পরিণত হলো। তার সৌন্দর্যে সবাই মুগ্ধ। স্বর্গের সব দেবতা তার ভক্তে পরিণত হলো; কিন্তু এই সৌন্দর্য তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াল অচিরেই। কারণ তার পালকপিতা বাতারা গুরু তার প্রতি আকৃষ্ট হলো। নিজের পালিত কন্যার জন্য বাতারা গুরুর এই আকাঙ্ক্ষা দেখে দেবতারা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। তারা আশঙ্কা করল, এই কেলেঙ্কারি স্বর্গের সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে। অতএব সব দেবতা ষড়যন্ত্র করে শ্রী পোহাসিকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করল। তারপর দেহটা পৃথিবীর একটি গোপন জায়গায় সমাহিত করল।

জাভা দ্বীপে প্রাচীন যুগের শ্রীদেবীর প্রস্তরমূর্তি

কিছুদিন পর শ্রী পোহাসির দেহ থেকে জন্ম নিতে থাকে এমন কিছু উদ্ভিদ, যা মানবজাতির জন্য বিশেষ দরকারি। তার মাথা থেকে জন্ম নিল নারকেলগাছ; নাক, ঠোঁট আর কান থেকে জন্মাল শাকসবজি ও বিভিন্ন ধরনের মসলা; তার চুল থেকে বিভিন্ন ফুলের গাছ ও ঘাস; স্তন থেকে বিভিন্ন ফলের গাছ; বাহু ও হাত থেকে সেগুনসহ বিভিন্ন বৃক্ষ; ঊরু থেকে জন্ম নিল নানা ধরনের বাঁশ; পা থেকে কন্দজাতীয় নানান গাছ।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদের জন্ম হলো তার নাভিমূল থেকে—সেটি হলো ধান। মানবজাতির প্রধান খাদ্য। সে কারণে পরবর্তী যুগে ওই অঞ্চলের লোকেরা শ্রী পোহাসির পূজা করতে শুরু করে। এই শ্রী পোহাসি পরে দেবী শ্রী বা শ্রীদেবী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। জাভা দ্বীপের লোকেরা এখনো তাকে পরোপকারী ধানের দেবী ও উর্বরতা শক্তির প্রতীক হিসেবে পূজা করে।

পশ্চিম জাভা দ্বীপের সুন্দা জাতির লোকেরা শ্রীদেবীকে উৎসর্গ করে ‘সেরেন তাউন’ নামে এক চমকপ্রদ উৎসবের আয়োজন করে। প্রাচীন যুগের সুন্দা রাজত্বের সময়কাল থেকে এটি হয়ে আসছে। ইন্দোনেশিয়ার কিছু টাকার মধ্যেও শ্রীদেবীর ছবি দেখা যায়।

বালি দ্বীপের লোকেরা ধানখেতেই শ্রীদেবীর পূজা করে থাকে। কচি নারকেলপাতা দিয়ে শ্রীদেবীর উদ্দেশে একটা পূজাবেদি তৈরি করে স্থাপন করা হয় ধানখেতের মধ্যে। তারপর ফসল তোলার সময় দেবীর উদ্দেশে নিবেদন করা হয় অর্ঘ্য। জাভা ও সুন্দা জাতির মধ্যে মাপাগ শ্রী নামের একটা স্থানীয় উৎসব আছে, যা ফসল তোলার আগে উদ্‌যাপিত হয়। ‘মাপাগ শ্রী’র আক্ষরিক অর্থ হলো শ্রীদেবীকে নিমন্ত্রণ করা। ফসল তোলার আগে গ্রামের মধ্যে শ্রীদেবীর আগমন ঘটানোর জন্যই এই আয়োজন। সেই সময় কোনো বাড়িতে যদি সাপের অনুপ্রবেশ ঘটে, তারা তাকে তাড়িয়ে দেয় না; বরং তার উদ্দেশে অর্ঘ্য দেয় ভালো ফসল উৎপাদনের জন্য।

এশিয়ার দেশে দেশে ভাতের প্রচলন থাকলেও প্রত্যেকে দেশের ভাত খাওয়ার রীতি স্বতন্ত্র। চীন, জাপান, কোরিয়াসহ দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যে পদ্ধতিতে ভাত খাওয়া হয়, তার সঙ্গে ভারতবর্ষের ভাত খাওয়ার রীতিতে পার্থক্য আছে। বাঙালির ভাত খাওয়ার মধ্যে যে পরিমাণ রসনাতৃপ্তির জোগান ও বৈচিত্র্য আছে, পৃথিবীর খুব কম জাতির মধ্যেই সেটি লক্ষ করা যায়। বিশেষত ভাতের সঙ্গে যেসব খাদ্য উপাদান যুক্ত এবং যে পদ্ধতিতে সেগুলো তৈরি করা হয়, তার পুরোটাই একটি শিল্পকর্ম। আর সেই রন্ধনশিল্প যুগ যুগ ধরে বাঙালির রসনাকে এমনভাবে দখল করে রেখেছে যে পৃথিবীর যেকোনো দেশে গিয়ে সুযোগ পেলেই বাঙালিরা স্বদেশি রসুইঘর খুঁজে বেড়ায়।