বেলা শেষ তবে, দূরে যেতে হবে
সিনেমার শুটিংয়ে পাখি দরকার। পাখির সঙ্গে খাঁচাও। আমার সহকারী হৃদয় খাঁচা আর পাখি কিনে আনল। শুটিং শেষে সেই পাখি কী করব? আমার পোষা পাখি দেখতে ভাল্লাগে না। হৃদয়কে বললাম পাখি ছেড়ে দিতে।
হৃদয় দাঁত বের করে বলল, ‘এই পাখি তো খাঁচার বাইরে বাঁচব না’।
‘বাঁচব না কেন?’
‘এরা তো উড়তে পারে না’।
‘উড়তে পারে না মানে? পাখি আবার উড়তে পারবে না কেন?’
হৃদয় বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাসল। আমাকে বোকা বানাতে পারলে তার আনন্দের সীমা থাকে না। সে আকর্ণবিস্তৃত হাসিতে বলল, ‘এই কাহিনি আপনে জানেন না?’
‘কী কাহিনি?’
‘এই পাখির জন্ম তো গাছের ডালে না। এর জন্ম খাঁচায়। খাঁচা থেকে কখনো বাইরও হয় নাই। উড়তে শিখবে কেমনে? এর জন্মও খাঁচায়, মৃত্যুও খাঁচায়।’
আমি হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে খানিক দ্বিধান্বিত হয়ে গেলাম। হৃদয়ের কথার সত্য-মিথ্যা জানি না। কিন্তু তার কথায় যুক্তি আছে। কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষ তো বলেই গেছেন, ‘জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার, হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়!’
যে পাখির ওড়ার জন্য আকাশ নেই, তার উড়তে শেখারও কারণ নেই। আমি মন খারাপ করে পাখির দিকে তাকিয়ে রইলাম। খাঁচার ভেতরে পাখি বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তার চোখভর্তি এক আকাশ শূন্যতা। অথচ এ পাখি আকাশ চেনে না। নাকি তার চোখের শূন্যতা আসলে আমার নিজের বানানো? আমার নিজের ভাবনা? আচ্ছা, মানুষ কি পাখির ভাবনা বুঝতে পারে? খাঁচার পাখি কিংবা মুক্ত পাখির? অথবা পাখি কি মানুষের ভাবনা বুঝতে পারে? খাঁচার মানুষ কিংবা মুক্ত মানুষের?
২
করোনা অফুরন্ত অবসরের সময়। আমার ধারণা ছিল এই সময়ে আমি প্রচুর লিখতে পারব। পড়তে পারব, সিনেমা দেখতে পারব। অন্যান্য কাজকর্ম করতে পারব। কিন্তু বাস্তবে আসলে তার কিছুই করতে পারছি না। সারাক্ষণ একধরনের অস্থিরতা। দুশ্চিন্তা। সেই দুশ্চিন্তায় এই পাখিসংক্রান্ত চিন্তা এসেও যুক্ত হলো। আমি হৃদয়কে বললাম, ‘তুই পাখি ছেড়ে দে।’
সে মোটামুটি বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘কিছুই তো জানেন না, শুধু শুধু...আপনি পাখিটারে মারবেন।’
‘মারব কেন?’
‘উড়তে না পারলে ইঁদুর-বিড়ালে খেয়ে ফেলবে না?’
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম, ‘তুই পাখি ছাড়’।
হৃদয় পাখি ছেড়ে দিল। হলুদ চড়ুই পাখির সমান পাখি। পাখি হৃদয়ের হাত গলে ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেল। আমি বিজয়ীর ভঙ্গিতে হৃদয়ের দিকে তাকালাম। হৃদয় বলল, ‘বেশি দূর যাইতে পারব না। সামনেই কোথাও গিয়ে পড়ে থাকব। এই পাখি বেশি দূর যেতে পারে না। আপনে শুধু শুধু...’
আমাদের অবশ্য ওই ‘সামনের কোথাও’টা আর দেখা হলো না। দেখা হলো না পাখি উড়তে পারল, না পড়ে গেল। কারণ, আমাদের সামনে আকাশ নেই। কংক্রিটের বিল্ডিংয়ের দঙ্গল আছে। পাখি তাদের ভেতর কোথাও হারিয়ে গেল। কিংবা হৃদয়কে ভুল প্রমাণিত করে আকাশে উড়ে গেছে। আমি এসে পড়তে বসলাম। পড়া, লেখা কিংবা দেখা নিয়ে আমি নিজেকে জোর দিই না। যখন যা ইচ্ছে হয়, তা-ই করার চেষ্টা করি। কেউ হয়তো রেফার করেছেন আলফ্রেড হিচকক, কোয়েন্টিন তারান্তিনো কিংবা স্ট্যানলি কুবরিকের কঠিন কোনো সিনেমা। আমি খুব আয়োজন করে সেই সিনেমা দেখতে বসে টম অ্যান্ড জেরির কার্টুন দেখা শুরু করি। ঘণ্টা তিনেক সেই কার্টুন দেখে প্রফুল্ল চিত্তে ঘুমিয়ে পড়ি। বইয়ের ক্ষেত্রেও তাই। কমলকুমার মজুমদারের লেখা পড়তেই হবে, না পড়লে লেখকজীবনের ষোল আনাই মিছে, এই ‘আপ্তবাক্য’ শুনে শুনে তাঁর বই নিয়ে বসে, কী মনে করে আমি প্রফেসর শঙ্কু কিংবা নবীন কোনো লেখকের বই নিয়ে টানা দুই ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম। আবার উল্টোটাও হয়। পত্রিকার কোনো কুড়মুড়ে নিউজ থেকে কীভাবে কীভাবে যেন ফার্ডিন্যান্দো সস্যরের দাঁতভাঙা থিওরি পড়তে শুরু করি। গুগল খুঁজে খুঁজে সিগ্নিফায়ার, সিগনিফায়েড বোঝার চেষ্টা করি। ইউনিভার্সিটিতে যে লিঙ্গুইস্টিকস কোর্সের কথা শুনলেই দুচোখে ঘোর অন্ধকার দেখতাম, হয়তো হঠাৎই তার গভীর গহ্বরের অতলে নিমজ্জিত হই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কৌতূহলে বুঁদ হয়ে থাকি। আমি ইচ্ছেস্বাধীন মানুষ। যতটা সম্ভব ইচ্ছেকে বলি, স্বাধীন থাকো। অথচ সেখানে পাখি থাকবে পরাধীন?
৩
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আমার অসম্ভব প্রিয় লেখক। বইমেলায় আল মাহমুদের দুটি বই কিনেছিলাম। ‘এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না’ আর ‘ইতিহাস দেখ বাঁক ঘুরে গেছে ফের ইতিহাসে’। দ্বিতীয় বইটির একটি কবিতার লাইন আমার মাথায় ঢুকে গেছে। আমি সারাক্ষণ তা বিড়বিড় করে আওড়াই—‘সব শেষ হলো, সন্ধ্যা ঘনালো/বেলা শেষ তবে, দূরে যেতে হবে/ ভুলে যেতে হবে নাম ও ঠিকানা/ নাহি কোনো মানা’। ভাবলাম এবার অন্য কিছু পড়ি। নাহলে এটা মাথা থেকে যাবে না। কত বই থরে থরে সাজানো শেলফে, অথচ সময়ের অভাবে ছুঁয়ে দেখা হয় না। এবার তাহলে পড়ি। একে একে বই নামাই, ধুলো ঝেড়ে পরেরটা দেখি, আবার নামাই, আবার দেখি। এত বই পড়া হয়নি! আফসোস হতে থাকে। এবার তো অফুরন্ত অবসর, সেই অবসরে আমি রাজ্যের বই বিছানার পাশে জড়ো করে ওলটাতে থাকি। কিন্তু কে জানত, শীর্ষেন্দু আমাকে শৈশবস্মৃতির আস্বাদ নিতে ডাকছেন! কতবার পড়েছি কে জানে, সব বই একপাশে ঠেলে সরিয়ে রেখে আবারও পড়তে শুরু করলাম শীর্ষেন্দুর কিশোর উপন্যাস ‘গৌরের কবচ’। সেটি শেষ করে ‘হারানো কাকাতুয়া’, ‘গোলমাল’, ‘চক্রপুরের চক্কর’, ‘ছায়াময়’, ‘সোনার মেডেল’, ‘পাতালঘর’, ‘বিপিনবাবুর বিপদ’—একে একে দশটি পড়ে ফেললাম! এবং বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম এই যে আমি পড়ায় মন বসাতে পারছিলাম না, কিছু দেখতে ভালো লাগছিল না, লিখতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, কেমন অস্থির লাগছিল, দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, তা যেন কোথায় কর্পূরের মতন উধাও হয়ে গেল। কিন্তু আমার হঠাৎ শৈশবে ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। দুর্দমনীয় ইচ্ছে। ছুটে বেড়াতে ইচ্ছে করছে আকাশের মতন খোলা কোনো মাঠে। কোনো জল ছলছল নদীর ধারে। কান পাততে ইচ্ছে হচ্ছিল কলকল শব্দের কাছে।
৪
আমি চুপচাপ বসে আছি জানালার পাশে। প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কেউ একজন দূরের ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। আমি অদ্ভুত চোখে সেই ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখ কি বিষণ্ণ? একটা হলদে ছোট্ট পাখি ঠিক তখুনি, একদম আমার সামনের বারান্দার গ্রিলে এসে টুপ করে বসে পড়ল। তারপর যেন ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকাল। আমার সেই ছেড়ে দেওয়া পাখিটা নয়তো?
সেটি হবার কথা নয়। আমি অবশ্য চিনতেও পারলাম না। হলুদ রং হলেই তো আর সব পাখি এক নয়। আচ্ছা এই যে মানুষ আলাদা করে পাখিদের চেহারা চিনতে পারে না, পাখিরা কি মানুষের চেহারা চিনতে পারে? আলাদা আলাদা মানুষ? আলাদা আলাদা মুখ? আমার কেন যেন মনে হলো পাখিটা আমাকে চিনতে পেরেছে। সে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। তারপর পাখায় ঠোঁট ঘসছে। তারপর চকিতে তাকাচ্ছে। নাকি আমার পেছনে মৃদু হাওয়ায় দুলতে থাকা শূন্য খাঁচাটা দেখছে? আমি জানালার গ্রিলের ভেতর থেকে তাকিয়ে আছি। বাইরে আকাশ। পাখিটা সেই আকাশে ডানা মেলে উড়ে যেতে যেতে কিছু কি বলল? কে জানে! হয়তো বলল। কিংবা এসবই আমার কল্পনা কিংবা বিভ্রম। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো, আমি পাখিটার শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। কিন্তু সেই শব্দের অর্থটাই কেবল বুঝতে পারলাম না।
আচ্ছা, আমরা কি কেবলই শুনতে পাই, দেখতে পাই, কেবল ওই অর্থটাই বুঝতে পারি না? না পাখির, না মানুষের। না পৃথিবীর, না প্রকৃতির।