মোশাররফ করিমকে কেন ‘নায়ক’ হিসেবে মেনে নিলাম আমরা
আজ ২২ আগস্ট অভিনেতা মোশাররফ করিমের জন্মদিন। তথাকথিত চোখে পড়ার মতো আকর্ষণীয় চেহারা নেই তাঁর। নেই সিক্স প্যাক অ্যাবসে মোড়া নায়কসুলভ পেটানো শরীর। তবু তিনি আমাদের ‘নায়ক’। অনায়কোচিত চেহারার মোশাররফ করিমকে কেন ‘নায়ক’ হিসেবে মেনে নিলাম আমরা, এই অভিনেতার জন্মদিনে তার সুলুক-সন্ধান।
আড়িয়াল খাঁর তীরে স্বর্গছেঁড়া গ্রাম পিঙ্গলকাঠির আবদুল করিম নামকরা অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে যায়। তাঁর ১০ সন্তানের মধ্যে ৮ম সন্তান ছিল খুব ডানপিটে, অথচ বাবার নেওটা। কলাপাতা রঙের শৈশবে ছেলেটির প্রিয় খেলা ছিল বাবাকে অনুকরণ করা। বাবা কীভাবে হাঁটেন, কথা বলেন, চা খান—বাবার সব অঙ্গভঙ্গি নকল করতে করতেই ছেলেটির মনে রোপিত হয়েছিল অভিনয়ের সুপ্ত বীজ। আবদুল করিম যত্ন করে আবৃত্তি শেখালেন আদরের সন্তানকে। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি চলতে থাকল যাত্রাপালায় শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়। এ পথচলায় বাবা ছেলেকে সরাসরি সায় না দিলেও বাধাও দেননি কখনো। এই ডানপিটে ছেলেই পরবর্তীকালে হলেন দেশবিখ্যাত অভিনেতা মোশাররফ করিম। পূরণ করলেন বাবার মনের কোণে লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত স্বপ্ন।
তথাকথিত চোখে পড়ার মতো আকর্ষণীয় চেহারা নেই মোশাররফ করিমের। নেই সিক্স প্যাক অ্যাবসে মোড়া নায়কসুলভ পেটানো শরীর। বরং মেদযুক্ত শরীরটায় বিসদৃশ একটা ভুঁড়ি উঁকিঝুঁকি দেয়।
উচ্চতাতেও মার খেয়ে গেছেন খানিকটা। অথচ এই গড়পড়তা অনায়কোচিত আদল নিয়েই নাটক, সিনেমা আর ওটিটি জগতের বেতাজ বাদশা অভিনেতা মোশাররফ করিম, দেশ-দেশান্তরে জনপ্রিয়তার আকাশচুম্বী অট্টালিকায় তাঁর বসবাস। মহল্লার বড় ভাই, আদর্শ প্রেমিক, পকেটমার, হিজড়া, শহুরে বাটপার থেকে আইকনিক হিমু,সিস্টেমের ভিত নাড়িয়ে দোওয়া কেন্দ্র ও পরিধির ওসি হারুন—প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গেই তিনি মিশে যান জলের মতো অনায়াসে। কীভাবে অনায়কোচিত চেহারা নিয়ে ‘নায়ক’ হয়ে উঠলেন মোশাররফ করিম? আমাদের জনসমাজ ও জনসংস্কৃতির মধ্যে কেমন করে স্থান করে নিলেন তিনি?
উত্তর হলো, এই অভিনেতার নিজস্ব ভঙ্গিমার অভিনয়। তবে এর বাইরেও আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে, ‘নায়ক’ বলতে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মানসপটে যে ধরনের চেহারা ভেসে উঠত, মোশাররফ করিমের আদল সম্পূর্ণ তার বিপরীত—এলেবেলে আদলের এই মানুষকে মনে হয়, এ তো আমাদের চেনা চেহারার, যেন তিনি আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে। আর এর সঙ্গে যখন তাঁর ঈর্ষণীয় অভিনয়প্রতিভা যুক্ত হয়, তখনই ঘটে যায় দুইয়ে দুইয়ে চার, অনায়কোচিত আদল আর বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, বরং আমরা এমনও ভাবি যে আমাদের চারপাশের দৃশ্যাবলিই যেন মোশাররফ-মারফত দেখতে পাচ্ছি! ফলে এই অভিনয়শিল্পীকে নায়ক বলতে আমরা আর কসুর করি না। এমনকি মোশাররফকে নায়ক হিসেবে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে আদতে আমরাই কি নায়ক হয়ে উঠি না?
ওপরে এই যে কথাগুলো বললাম, যে প্রশ্নটি রাখলাম, তার সপক্ষে এখন বরং কথাগুলোকে আরেকটু বিশদ করা যাক, তাকানো যাক দর্শকের দিকেও। বিনোদনের বহুমাত্রিক সহজলভ্যতার এ পর্যায়ে এসে দর্শকেরাও ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠছেন। এখন আর তাঁদের কাছে অভিনেতার ‘লুক’ অতটা গুরুত্ব পায় না।
তাঁরা বরং পরিচিত আবেগ, অনুভূতি, ব্যক্তিত্ব, প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শরীরী ভাষাকেই শিল্পমাধ্যমে নিজের হাতের রেখার মতো খুঁজে ফেরেন। দর্শকেরা এমন কাউকে চান, যিনি তাঁদের নিয়ে, তাঁদের মতো করে কিছু সুখ-দুঃখের গল্প বলবেন, হাসাবেন, কাঁদাবেন। অভিনয়শিল্পী হয়তো খুব নায়কোচিত কেউ হবেন না, বরং তিনি হয়ে উঠবেন খুব কাছের—‘আ কমন ম্যান’। এর প্রতিফলন আমরা বলিউডে মনোজ বাজপেয়ী, পঙ্কজ ত্রিপাঠি, নওয়াজউদ্দীন সিদ্দিকীর উত্থানের মধ্যেও দেখতে পাই।
বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বাস্তবঘেঁষা সব স্মরণীয় চরিত্র উপহার দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। আমরাও একই কারণে বলতে পারি, আমাদের একজন মোশাররফ করিম আছেন। হাস্যরসাত্মক থেকে গম্ভীর চরিত্র, সাড়া ফেলে দেওয়া পার্শ্বচরিত্র থেকে প্রধান আকর্ষণ—সব ক্ষেত্রেই নিজস্বতা বজায় রেখে পরিচালকের ‘ট্রাম্প কার্ড’ হয়ে ওঠেন মোশাররফ করিম।
১৯৯৯ সালে ‘অতিথি’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে টিভির পর্দায় তাঁর আগমন। সাত শর কাছাকাছি নাটক, টেলিফিল্মে এই বহুপ্রজ অভিনেতা স্মর্তব্য সব চরিত্রের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছেন নাট্যজগতের মুকুটহীন সম্রাট।
‘নায়ক’ বলতে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মানসপটে যে ধরনের চেহারা ভেসে উঠত, মোশাররফ করিমের আদল সম্পূর্ণ তার বিপরীত—এলেবেলে আদলের এই মানুষকে মনে হয়, এ তো আমাদের চেনা চেহারার, যেন তিনি আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে। আর এর সঙ্গে যখন তাঁর ঈর্ষণীয় অভিনয়প্রতিভা যুক্ত হয়, তখনই ঘটে যায় দুইয়ে দুইয়ে চার, অনায়কোচিত আদল আর বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, বরং আমরা এমনও ভাবি যে আমাদের চারপাশের দৃশ্যাবলিই যেন মোশাররফ-মারফত দেখতে পাচ্ছি! ফলে এই অভিনয়শিল্পীকে নায়ক বলতে আমরা আর কসুর করি না। এমনকি মোশাররফকে নায়ক হিসেবে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে আদতে আমরাই কি নায়ক হয়ে উঠি না?
‘৪২০’-এর মন্টু, ‘হাড়কিপটে’-এর গোল্লা, ‘হাউজফুল’-এর ইফতি, ‘ভবের হাট’-এর ভাসান খাঁ, ‘ক্যারাম’-এর শফিকুল, ‘সাকিন সারিসুরি’র রুইতনের মতো উল্লেখযোগ্য সব চরিত্রে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের নাট্যজগৎকে। এই বহুপ্রজতার মুদ্রার উল্টা পিঠের আঁধারকেও অবশ্য এড়াতে পারেননি এই অভিনেতা। অজস্র নাটকে পরিচিত মুখ হয়ে উঠতে গিয়েই হয়তো মানসম্মত কাজ উপহার দিতে পারেননি কখনো কখনো।
২০০৪ সালে তৌকির আহমেদ পরিচালিত ‘জয়যাত্রা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষেক হয় তাঁর। অভিনয় করেছেন ‘রূপকথার গল্প’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘প্রজাপতি’, ‘টেলিভিশন’, ‘জালালের গল্প’, ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘হালদা’র মতো চলচ্চিত্রে।
সম্প্রতি ওটিটি জগতের উত্থানে মোশাররফ করিমের অভিনীত ওসি হারুন চরিত্রটি ঝড় তুলেছে দর্শকের মনে। সিস্টেমের পরিধিতে থেকে কেন্দ্রকে নাড়াতে চাওয়া মনস্তাত্ত্বিকভাবে জটিল ধূসর এই চরিত্র যেন হয়ে উঠেছে ওটিটি জগতের ‘কাল্ট’। ওসি হারুনের সংলাপ—‘দুইটা কথা মনে রাখবেন’ এখন আপামর দর্শকের মুখেমুখে ফেরে। কেননা, অভিনয়ের মাধ্যমে জনসমাজের নাড়িতে ঘা দিতে পেরেছেন তিনি।