যেভাবে পালিত হলো জীবনানন্দ–গবেষক ক্লিন্টন বি সিলির জন্মদিন
জীবনানন্দ–গবেষক ক্লিন্টন বি সিলি তিরাশিতে পা রাখলেন। ২১ জুন ছিল তাঁর জন্মদিন। এ উপলক্ষে ক্লিন্টনের সুহৃদদের পক্ষ থেকে জুম প্ল্যাটফর্মে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উদ্যোগটি গ্রহণ করেন বরিশাল জেলা স্কুলের ক্লিন্টনের প্রাক্তন ছাত্র এবং পরবর্তী সময়ে বন্ধু অস্ট্রেলিয়া নিবাসী সাঈদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ ছিল ক্লিন্টনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ, সঙ্গে একটি ধারণকৃত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল বাড়তি পাওয়া।
‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’—কে কবি আর কে কবি নয়, এটি মীমাংসা করার স্থির প্রত্যয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ দিয়েছিলেন এই অমোঘ বাণী। ক্লিন্টন বি সিলি রূপসী বাংলার কবিকে চিনতে পেরেছিলেন, তবে সেটি বরিশালে থাকার সময়ে নয়। গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে পিস কোরের সহযোগিতা প্রকল্পে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিতে বরিশালে এসে তিনি বরিশাল জিলা স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষকের কাজ নেন। চলাফেরার সময় বা কাজের তাগিদে ইউসিসের অফিসে যেতে হতো তাঁকে। মাঝেমধ্যে পথ বদলানোর জন্য শহরের ভেতরের রাস্তাগুলো ধরে হেঁটে গিয়ে উঠতেন বগুড়া রোডে, যেটা শেষ হয়েছে হাসপাতাল রোডে তখনকার ইউসিস অফিসের কাছাকাছি জায়গায়। পরে ক্লিন্টন বি সিলি বুঝতে পেরেছিলেন, এই পথে যাওয়ার সময় জীবনানন্দ দাশের পুরোনো বাড়ি পেরিয়ে যেতেন তিনি, যার নাম ছিল ‘সর্বানন্দ ভবন’—এ বাড়িতেই কবির জন্ম হয়েছিল। বরিশালে ক্লিন্টন বি সিলির প্রায় দুই বছরের অবস্থানকালে জীবনানন্দ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। শিকাগো ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশীয় ভাষা ও সভ্যতা বিভাগে পিএইচডি প্রোগামে ঢোকার পরই কেবল জীবনানন্দ এবং তাঁর কবিতা বিষয়ে জ্ঞাত হন তিনি।
জীবনানন্দর কবিতা বাঙালির মনেই কেবল শিহরণ জাগায়নি, মার্কিন গবেষককেও তা স্পর্শ করেছিল। পরবর্তীকালে ক্লিন্টন বি সিলি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও জীবন নিয়ে লিখেছিলেন ‘আ পোয়েট অ্যাপার্ট’ (১৯৯০) নামের একটি সারবান গ্রন্থ। বাংলাদেশে প্রাবন্ধিক ফারুক মঈনউদ্দীনের অনুবাদে ‘অনন্য জীবনানন্দ’ (২০১১) নামে গ্রন্থটির একটি পাঠযোগ্য অনুবাদ প্রকাশ করে ‘প্রথমা’ প্রকাশনী। এ পর্যন্ত এর আটটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। বরিশাল জিলা স্কুলের ক্লিন্টনের প্রাক্তন ছাত্রদের মতো অনুবাদক ফারুক মঈনউদ্দীনও সংযুক্ত হয়েছিলেন জন্মদিনের অনুষ্ঠানে।
জীবনানন্দ সম্পর্কে বরিশালে থাকাকালে সচেতন না হলেও বাংলাদেশ পর্বের পর কলকাতায় ক্লিন্টন বি সিলি কবিপত্নী লাবণ্য দাশ, তাঁর পুত্র-কন্যা, ভাই অশোকানন্দ ও বোন সুচরিতা দাশের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তাঁর আগ্রহ মেটাতে এবং গবেষণাকাজে সাহায্য করতে কবি বুদ্ধদেব বসু, তাঁর কন্যা মীনাক্ষী দত্ত এবং কবির জামাতা জ্যোতির্ময় দত্তের ভূমিকার কথা অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন তিনি। জানা গেল, বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে ক্লিন্টন বি সিলির নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তিনি যেসব গবেষণার কাজ করেছেন, বুদ্ধদেব বসুর সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব করে তোলা যেত না বলেও তিনি জানান।
‘আ পোয়েট অ্যাপার্ট’ ছাড়াও ক্লিন্টন ‘বরিশাল অ্যান্ড বিয়ন্ড: এসেজ অন বাংলা লিটারেচার’, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধকাব্য’ ও বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’র ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ক্লিন্টন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ভারতের আনন্দ ও এ কে রামানুজন পুরস্কার। বাংলা একাডেমি তাঁকে সাম্মানিক ফেলোশিপ প্রদান করেছে।
জন্মদিন অনুষ্ঠানের জুম প্ল্যাটফর্মে দেশ-বিদেশ থেকে যুক্ত ক্লিন্টন বি সিলির অনুরাগীরা কথা বলছিলেন বিপুল আবেগে। ক্লিন্টনের অনুভূতি প্রকাশ ছিল বিশুদ্ধ বাংলায়। তাঁর নিজের কথা, বরিশালের কথা এবং লেখালেখি বিষয়ে অভিজ্ঞতার কথাও বিস্তারিতভাবে জানা গেল। বইতে ক্লিন্টন লিখেছিলেন জীবনানন্দের সবচেয়ে নিশ্ছিদ্রভাবে রচিত কবিতার নাম ‘বনলতা সেন’। আয়োজকেরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আবৃত্তিতে কবিতাটি শোনানোর ব্যবস্থা করেন। কবির অনুবাদে ‘বনলতা সেন’-এর ইংরেজিতে অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ক্লিন্টন তাঁর গ্রন্থে অনুবাদটি যে শিল্পসম্মতভাবে অনূদিত হয়েছিল, সেটি লিখেছিলেন; ক্লিন্টনও ‘বনলতা সেন’ অনুবাদ করেছিলেন। এ ছাড়া অধ্যাপক হায়াৎ মামুদকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধকাব্য’-এর অনুবাদ সম্পন্ন করেন। পুরোনো দিনের বাংলা ভাষা আর অলংকারের জটিলতায় ‘মেঘনাদবধকাব্য’ প্রথমে গদ্যে অনুবাদের কথা ভাবা হয়। ক্লিন্টেনের ধারণা ছিল, এ ধরনের কবিতার অনুবাদকর্ম জটিল কাজ হবে, পরে অবশ্য তাঁর হাত ধরে ‘মেঘনাদবধকাব্য’ কবিতায় অনূদিত হয়।
প্রশ্ন ছিল, গবেষণাকাজ করতে তাঁর কেমন লাগত? ‘আমি বেশ সন্তুষ্ট যে এমন একটা জীবনযাত্রা বেছে নিয়েছিলাম। অন্য দিকে গেলে অত ভালো হতো না। গবেষণার কাজ আমি উপভোগ করেছি’, স্পষ্ট উচ্চারণে থেমে থেমে বলা কথাগুলোতে ক্লিন্টনের প্রত্যয়, কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতাই প্রকাশ পেয়েছে।
বাংলাদেশ ও কলকাতায় সময় কাটিয়ে ক্লিন্টন যেন বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে সামনে পেয়ে শিল্পসাহিত্য নিয়ে দেশ–বিদেশে বসবাসরত আর জুম প্ল্যাটফর্মে যুক্ত কমবেশি সবার মধ্যেই আবেগ কাজ করছিল। এ কারণে কিনা আয়োজকেরা নানা অনুষঙ্গ দিয়ে অনুষ্ঠানকে ভরিয়ে তুলেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের গানের আয়োজন ছিল অনুষ্ঠানের প্রাণ। বাজানো হলো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে’, কলিম শরাফীর ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’, অদিতি মহসিনের ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’, শ্রাবণী সেন ও কৌশিকী চক্রবর্তীর ‘মধুর মধুর ধ্বনি বাজে হৃদয়কমলবনমাঝে’, সুস্মিতা পাত্রের ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ এবং ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে ছিল লুবনা মরিয়মের নৃত্য।
জীবনানন্দের ‘নির্জন স্বাক্ষর’ ও ‘রূপসী বাংলা’র কিছু অংশের আবৃত্তি ছিল অনুষ্ঠানের বাড়তি আকর্ষণ, আবৃত্তি করেছেন শামস উজ জোহা। জোয়ান বায়েজের ‘মে ইউ স্টে ফরএভার ইয়ং’, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’, আমজাদ আলী খানের সরোদ, আলিফ লায়লার সেতার বাদন, বব ডিলানের ‘হাউ মেনি রোডস মাস্ট আ ম্যান ওয়াক ডাউন’-এর পরিবেশনাও ছিল মুগ্ধ করার মতো।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ১৯৬৩ সালে দেওয়া বিশ্বখ্যাত বক্তৃতা ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’-এর অংশবিশেষ নিয়ে ছিল একটি আয়োজন, যেখানে মার্টিন লুথার কিং তাঁর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। সে স্বপ্ন ছিল সাম্যের, ঐক্যের ও শোষণমুক্ত সমাজের।
ক্লিন্টন বি সিলিকে চমকে দিতে হয়তো তাঁর দেখা ৬০ বছর আগের বরিশালের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছবি দেখানো হয়, সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় হালের ঝকঝকে চাকচিক্যভরা বরিশালের ছবি। কয়েক যুগ আগের-পরের ছবি দেখে বোঝা গেল, জীবনানন্দের রূপসী বাংলার তথা বরিশালের অবকাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে। বরিশালের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে বাহন, সেই স্টিমারের সিঁটির শব্দও বাজানো হলো।
ক্লিন্টন বি সিলি আর জীবনানন্দ দাশ যেন একই সুরে বাঁধা। আর এ কথা বলতেই হবে, ক্লিন্টনের গবেষণাগ্রন্থ পাঠে পাঠক বহির্জীবনকে দূরত্বে রেখে অন্তসারকে বৃহতে পরিণত করার জন্য আত্মোৎসর্গকারী কবি জীবনানন্দ দাশকে জানার এবং গভীরভাবে অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিল।
বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কবি জীবনানন্দ যেন পথ ভুলে ধূসর এই পৃথিবীতে এসেছিলেন। অন্যমনে, কেমন এক হেলাফেলায় যাপন করেছেন জীবন। তারপর প্রবল এক অন্যমনস্কতার ঘোরে কলকাতার রাস্তায় ট্রামের চাকার নিচে পিষ্ট হয়েছে তাঁর জীবনের অবশেষ। তাঁর সময়ের বাঙালি জীবনানন্দকে চেনেনি। তবে পাপমোচনের চেষ্টায় উত্তরকালের বাঙালি, যেখানে যত কবিতাপ্রেমী আছেন, তাঁরা চেনার চেষ্টা করছেন জীবনানন্দ নামের ধোঁয়াশাটিকে। কুসুমকুমারী দাশের অভিমানী সন্তানের তাতে অবশ্য কিছু আর যায়–আসে না। হেমন্তের ঝড়ে ঝরে যাওয়ার আগে অনন্তকালের গায়ে অমোঘ চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছেন তিনি। অমোচনীয় সেই চিহ্ন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কবিতাপ্রেমীদের ঘুমঘোরে জাগিয়ে রাখবে। ক্লিন্টন বি সিলি তাঁর গবেষণাগ্রন্থ দিয়ে আমাদের ঘুমের ঘোরকে উসকে দিতে সাহায্য করেছেন। কেবল ধন্যবাদ দিয়ে তাঁর ঋণ শোধ করা যাবে না।