কেন ওস্তাদ জাকির হোসেন তবলার সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড

১৫ ডিসেম্বর প্রয়াত হয়েছেন কিংবদন্তি তবলাবাদক ওস্তাদ জাকির হোসেন। ভাবুন, তবলার মতো একঘেয়ে একটা বাদ্যযন্ত্র শ্রোতারা কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনেন! এটাকেই সম্ভব করেছেন জাকির হোসেন। কেন তিনি তবলার সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড?

ওস্তাদ জাকির হোসেনফাইল ছবি

ওস্তাদ জাকির হোসেনকে চিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই। সম্ভবত তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম। থাকতাম সবচেয়ে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে। ভারতের কাছে বলে ওপারের ‘দূরদর্শন’ চ্যানেল দেখা যেত। কোনো এক রোববার সকালের দিকে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে ঝাঁকড়া চুলের তরুণ জাকির হোসেন এলেন। কিন্তু সেদিন তাঁর সঙ্গে তবলা ছিল না। খালি হাতে ছন্দ তুললেন। উপস্থাপক তাঁকে ‘ওস্তাদ’ বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ায় তিনি বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, ‘আমাকে যদি ওস্তাদ বলেন, তবে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, আল্লারাখা সাহেবদের কী বলে সম্বোধন করবেন?’

এরপর বহু বছর কেটে গেছে। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার রুমে একটি ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল। এক বন্ধু কোথা থেকে যেন একটি ক্যাসেট জোগাড় করলেন; ‘ওয়ান অ্যান্ড অনলি’। আদনান সামি ও জাকির হোসেনের যুগলবন্দী। সেই রাতে আমরা ক্যাসেটটি বারবার শুনলাম। অসাধারণ সেই সুর আমাদের উদ্দীপ্ত করে তুলল! রাগ বাগেশ্রী, দুর্গা আর জ্যাজ! ভোরের দিকে বুঝলাম, যেটিকে সারা রাত সন্তুর ভেবে শুনছিলাম, সেটি আসলে পিয়ানো। পিয়ানোর টোকা সরোদের মতো গভীর, আর সন্তুরের টোকা সেতারের মতো হালকা ও মিষ্টি। পিয়ানোতে ক্লাসিক্যাল মিউজিক বাজানো যায়? অবশ্য পরে জেনেছি, ভি বালসারা পিয়ানোতে ক্লাসিক্যাল বাজাতেন। সন্তুরে ক্লাসিক্যাল বাজানো গেলে পিয়ানোতে যাবে না কেন?

প্রসঙ্গ এখানে সন্তুর বা পিয়ানো নিয়ে নয়! বিষয়টা হলো পারফরম্যান্স নিয়ে। এই উপমহাদেশের ক্ল্যাসিক্যাল গানে ‘মীড়’ অত্যন্ত জরুরি অনুষঙ্গ। পিয়ানো বা সন্তুরে সেটা সম্ভব নয়। তাই বলে কি কেউ থেমে থেকেছেন? এখন ভাবুন, তবলার মতো একঘেয়ে একটা বাদ্যযন্ত্র শ্রোতারা কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনেন! এটাকেই সম্ভব করেছেন জাকির হোসেন। আমাদের দেশে কিংবা আশপাশের দেশগুলোয় যাঁরা তবলা বাজান বা শেখেন, তাঁদের কাছে জানতে চাইলে বেশির ভাগই জবাব দেবেন যে তাঁরা জাকির হোসেনের বাজনা শুনেই তবলায় হাত দিয়েছেন। তিনি আমাদের সংস্কৃতিজগতে তবলাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

তবলা এমন একটি বাদ্যযন্ত্র, যেখানে চামড়ার দুইটি আচ্ছাদনে জীবন আনতে হয়। আট-দশটি আঙুলের খেলায় প্রাণ সঞ্চার করতে হয়। কিন্তু আঙুলের কী সাধ্য? খেলে তো মন। শিল্পীর মগজ ও সাধনার নিংড়ানো ফসলেই শিল্পের সৃষ্টি হয়। জাকির হোসেনের মতো মানুষ, যাঁরা শতাব্দীতে দু-একজনের বেশি জন্মান না, তাঁদের কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনা চলে না।

আমাদের এই অঞ্চলে আবহমানকাল থেকে তবলা একটি সহবাদ্যযন্ত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়ে এসেছে। কণ্ঠ, সেতার, সরোদ বা বাঁশির মতো কোনো যন্ত্রের সঙ্গে তবলা সংগত করা হয়। কিন্তু যখন জাকিরের হাতে তবলা, তখন তিনি আর সহশিল্পী নন। সমমর্যাদাসম্পন্ন শিল্পী। আজ থেকে দুই–তিন যুগ আগে, যখন ক্যাসেট ও সিডি প্লেয়ারে মানুষ সংগীত শুনত, সেই সময় অনেক শ্রোতার সিডি ক্যাসেটের র‍্যাকে জাকির হোসেনের একক তবলাবাদনের অ্যালবাম পাওয়া যেত। এখন ইউটিউবের যুগ বলে তা আরও সহজ হয়েছে। জাকিরকে এখন চাইলেই শোনা যায়।

আমরা সাধারণ শ্রোতারা অনেক সময়ই গান বা বাজনা শুনে তা বুঝে উঠতে পারি না। শুধু জানি, যেহেতু বড় কোনো শিল্পী পারফর্ম করছেন, নিশ্চয়ই ভালো করছেন। তবে মহান শিল্পীরা যখন পারফর্ম করেন, তখন তা সাধারণের কাছে অনেক বোধগম্য করে তোলেন। ধ্রুপদি সংগীতের রাস্তায় একটু–আধটু ঘোরারঘুরি করার অভিজ্ঞতা থাকলে ওস্তাদ আবদুল করিম খান, ফইয়াজ খান কিংবা আমির খানের গানের রস না বোঝার কোনো কারণ নেই। আরও সহজভাবে যদি বলা যায়, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সানাই কি যেকোনো শ্রোতা বুঝতে পারেন না? শিল্পী যত বড়, তাঁর শিল্প তত সহজ, বোধগম্য, সাধারণভাবে বলা যায়। যাঁরা যত্ন করে শুনেছেন, তাঁরা জানেন, আব্বাস উদ্দিনের গানের মতো সরল গান আর হতে পারে না! কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন তিনি!

ফিরে আসি জাকির হোসেনের কাছে। তিনি নিজেই একটি ব্র্যান্ড। তবলা মানেই জাকির। তিনি এমন একটি জীবন পার করে গেলেন, যখন ধ্রুপদি সংগীতের জয়জয়কার! ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান আর উদয় শঙ্কর যেমন এই উপমহাদেশের সংগীত ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন, তেমন তাঁদের পরের প্রজন্ম রবিশঙ্কর, আলী আকবর খান কিংবা জাকির হোসেন সেই পথকে আরও প্রশস্ত করেছেন।

তবে সুপারস্টারদের পারফরম্যান্সকে অনেক সময় সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। জাকিরকে আমরা যতটা না চিনেছি তাঁর তবলায় অনন্য দক্ষতার জন্য, তার চেয়ে হয়তো বেশি চিনেছি তবলায় ট্রেন চালানো, পায়রা ওড়ানো—এ ধরনের কৌশলের মাধ্যমে। যদিও এসবই তাঁর বিশাল প্রতিভার কাছে তুচ্ছ। তিনি যা করেন, তা খুবই সামান্য কিছু মানুষ করতে পারেন। সংগীত নিয়ে লেখার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এর রস আস্বাদন করতে হয়; এটি শব্দে বা অক্ষরে প্রকাশ করা যায় না। সংগীতকে তুলনা করতে হয় সংগীত দিয়েই। সুরের কথা বলতে গেলে হয়তো কিছু বলা যায়, কিন্তু তবলাকে নিয়ে? তবলা নিয়েও হয়তো বলা যায়, কিন্তু সেই ভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই। শুধু জানি, জাকির হোসেন এক অনন্য শিল্পী ছিলেন।

ঢাকায় অনেকবারই এসেছেন জাকির হোসেন। দেশের একটি বড় আসরে একবার তিনি তবলা নিয়ে বসলেন। পেছনে বিশাল এলসিডি পর্দায় সাগরের জল। বাজাতে বাজাতে তাঁর হাত থেমে গেল। একপর্যায়ে এসে তিনি পেছনের পর্দাটি বন্ধ করতে বললেন। জানালেন, তাঁর মনে হচ্ছিল যেন তিনি পানিতে ডুবে যাচ্ছেন, ভেসে যাচ্ছেন। তারপর আবার আঙুলের জাদুতে পায়রা ওড়ালেন।

জাকির এমন পরিবারে বেড়ে উঠেছেন যেখানে তিনি জন্ম থেকেই তবলার বোল শুনে এসেছেন। মাত্র তিন বছর বয়সেই তাঁর বাবা পণ্ডিত আল্লারাখার কাছে তালিম নেন এবং এই পথে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। বলাই বাহুল্য, বাবা ও গুরু অত্যন্ত গুণী শিল্পী ছিলেন বলে তিনি নিশ্চয়ই অনেক ছোটবেলা থেকেই বড় বড় শিল্পীর সান্নিধ্যে এসেছেন। তাঁর নামটিও রেখেছেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান, যিনি আমাদের ধ্রুপদি জগতের আরেক মহিরুহ!