অবন্তিকাও বাবার মতো প্রতিবাদী স্বভাবটা পেয়েছিল
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার বাবা জামাল উদ্দিন ছিলেন লেখক সুমন রহমানের সহকর্মী। একসময় দেবীদ্বার সরকারি কলেজে পড়াতেন তাঁরা। যখন অবন্তিকার জন্ম হয়নি, তখন থেকেই তাঁরা ঘনিষ্ঠ ছিলেন। অবন্তিকার মৃত্যুর পর এই লেখায় সুমন রহমান লিখলেন বাবার মতো তাঁর মেয়ে অবন্তিকাও ছিলেন প্রতিবাদী।
ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার মৃত্যুতে ব্যথিত ও ক্রুদ্ধ ছিলাম সকাল থেকেই। সন্ধ্যায় ঢাকায় এসে প্রথমেই যেটা জানলাম সেটা হলো, অবন্তিকা আমাদের মেয়ে, আমার প্রথম জীবনের সহকর্মী ও বন্ধু প্রয়াত অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের মেয়ে। অবন্তিকার জন্মেরও বহু আগে আমি আর জামালের পরিবার পাশাপাশি বাসায় থাকতাম কুমিল্লার দেবীদ্বারে। পড়াতাম দেবীদ্বার সরকারি কলেজে। জামাল ফিজিকসে পড়াত, আমি ফিলোসফি।
সেটা ১৯৯৬ সালের কথা। আমরা কয়েকজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সী শিক্ষক দেবীদ্বার সরকারি কলেজে জয়েন করেছিলাম। টগবগে তরুণ আর চারপাশে তখন চলছিল নকলের মহোত্সব। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, নকল রুখতে হবে।
কিন্তু রুখবে কে? প্রবীণ সহকর্মীরা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। ফলে লড়াইটা খুব কঠিন হয়ে পড়ল। আমাদের বন্ধুরা রাস্তাঘাটে আক্রান্ত হলেন, বাসা ভাঙচুর হলো, কলেজ ক্যাম্পাসেও আক্রমণের শিকার হতে হলো। জামালের গায়ে ঢিল পড়ল, বাচ্চুকে মারতে এল আধলা ইট নিয়ে, তারেক আজিজকে হুমকি–ধমকি দেওয়া হলো, আমার বাসায় কাচ ভেঙেচুরে দেওয়া হলো রাতের বেলায়। আমাদের আগের ব্যাচের সিনিয়র কলিগরাও একইভাবে আক্রান্ত হলেন। নুরু ভাই, সাদেক ভাই কিংবা এলাহী ভাই। বাদবাকি প্রবীণ সহকর্মীরা তেমন কোনো সহযোগিতা করতেন না, বরং বাঁকা হাসি দিতেন। একজন আমাকে বললেন, বাছুরের শিং গজাইলে সবখানেই গুঁতা মারে। এখন বুঝবেন!
বছর দুয়েকের লাগাতার চেষ্টায় দেবীদ্বার সরকারি কলেজকে প্রায় নকলমুক্ত করতে পেরেছিলাম। খুব কঠিন কাজ ছিল সেটা। অনেকটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মতো। কারণ, স্থানীয় মানুষের পারসেপশনে নকল করাটা অনেকটা ‘অধিকার’–এর মতো ছিল। আর নকল ধরাটা ছিল ‘ডিস্টার্ব’! অন্যত্র অনেক নীতিমান, অথচ নকল করার ব্যাপারে এমনটা ভাবেন—এমন অনেক মানুষকে আমরা তখন দেখেছি।
অবন্তিকার বাবা অধ্যাপক জামাল খুব প্যাশনেট শিক্ষক ছিলেন। টিভিতে অবন্তিকার মা অর্থাৎ আমাদের শবনম ভাবির চেহারা দেখে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কী যে হাসিখুশি আর অতিথিপরায়ণ পরিবার ছিলেন তাঁরা! তাঁদের সোনার টুকরা মেয়ে অবন্তিকা। ছোটবেলা থেকেই দারুণ চটপটে ছিল। কত কিছু করার কথা ছিল তার! কত কিছু দেওয়ারও কথা ছিল সমাজকে! অথচ ক্রমাগত হয়রানির শিকার হতে হতে আজ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। তাকে প্রকারান্তরে হত্যা করা হয়েছে। যাদের লাগাতার হয়রানির কারণে সে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অবন্তিকার নিজের করা সেই তালিকায় একজন শিক্ষক তথা একজন সহকারী প্রক্টরও আছেন!
অবন্তিকার বাবা অধ্যাপক জামাল খুব প্যাশনেট শিক্ষক ছিলেন। টিভিতে অবন্তিকার মা অর্থাৎ আমাদের শবনম ভাবির চেহারা দেখে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কী যে হাসিখুশি আর অতিথিপরায়ণ পরিবার ছিলেন তাঁরা! তাঁদের সোনার টুকরা মেয়ে অবন্তিকা। ছোটবেলা থেকেই দারুণ চটপটে ছিল। কত কিছু করার কথা ছিল তার! কত কিছু দেওয়ারও কথা ছিল সমাজকে! অথচ ক্রমাগত হয়রানির শিকার হতে হতে আজ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। তাকে প্রকারান্তরে হত্যা করা হয়েছে।
অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের মৃত্যুটাও মর্মান্তিক। যে প্রতিজ্ঞা নিয়ে একসময় আমরা দেবীদ্বার কলেজকে নকলমুক্ত করেছিলাম, জামাল সেখান থেকে সরে আসেননি। বছর কয়েক আগে এক নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি অবৈধ ভোটদানের কোনো ঘটনা রুখতে গিয়েছিলেন। বেধড়ক মারা হয় তাঁকে। সেই যে অসুস্থ হয়ে পড়লেন আর সুস্থ হতে পারলেন না। বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় গত বছর মৃত্যু হয় তাঁর।
অবন্তিকাও বাবার এই স্বভাবটা পেয়েছিল। প্রতিবাদ করার স্বভাব। অত্যন্ত বিপজ্জনক স্বভাব, বলতেই হবে। জীবন দিয়ে বাবা ও মেয়ে এর দায় শোধ করে গেল। একজন নীতিমান শিক্ষক, অন্যজন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী।
শিক্ষাঙ্গনে ওদের দরকার নেই। সহকারী প্রক্টর আর তাঁর দলীয় পান্ডারা থাকলেই চলবে।