বাংলা বইয়ের বিদেশ ভ্রমণ
বাংলা বই উড়তে জানে। ওড়ার ক্ষমতা নিয়েই তার জন্ম। আমাদের প্রথম বই ‘চর্যাপদ’ উড়ে গিয়েই তো নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তারপর হাজার বছর ধরে নেপালের রাজদরবারের রয়্যাল লাইব্রেরির কোথাও নিভৃতে ঘুমিয়ে ছিল বইটি। ওড়ার ক্ষমতা আছে বলেই পৃথিবীব্যাপী ডানার সুগন্ধ ছড়িয়েছিল ‘গীতাঞ্জলি’, বিশ শতকের গোড়ার দিকে ছিনিয়ে এনেছিল নোবেল পুরস্কার। এই একুশ শতকেও বাংলা বই ডানা মেলছে আরও ব্যাপক আর বিপুলভাবে।
এখন পরিযায়ী পাখির মতো ঝাঁক বেঁধে উড়ে উড়ে সাগর–মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছে বাংলা বই। এ জন্যই হয়তো নিউইয়র্ক বইমেলার উদ্বোধনের সময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছিলেন, ‘আমরা ছড়িয়ে আছি বিশ্বময় হাজার হাজার বছর ধরে। সাত হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষার পরিবার বিবর্তিত হয়ে আসছে। আর বাংলা ভাষা হাজার বছর ধরে লিখিতাকারে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। আমাদের অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যার প্রথম উপকরণ ভাষা, সেই বাংলা ভাষার মাধ্যমেই আমাদের জাতিসত্তা, ব্যক্তিসত্তা ও ধ্বনিসত্তা বিবর্তিত হয়েছে।’ এ কথার মর্ম হৃদয় দিয়ে বুঝতে পেরেছেন প্রবাসে বসবাসকারী বাঙালিরা। জীবিকাসহ নানা কারণে পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়েও তাঁরা বাংলা ভাষাকে ভুলতে পারেন না। কেননা এই ভাষার মাধ্যমেই তাঁদের জাতিসত্তা ও ব্যক্তিসত্তা বিকশিত হয়েছে। এই ভাষার আবেদন তাঁদের রক্তের গভীরে। তাই বিদেশের মাটিতে বাংলা বইয়ের মেলা বাঙালিদের আত্মার ও প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে।
গত ২৪ থেকে ২৭ মে; এই চার দিন নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় পারফর্মিং আর্ট সেন্টারের সবুজ প্রাঙ্গণটিকে মনে হয়েছিল ঢাকার বর্ধমান হাউসের আশপাশ থেকে তুলে আনা বইমেলারই একটি জীবন্ত অংশবিশেষ। নিউইয়র্কের বই ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষেরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন বছরের এই বিশেষ চার দিনের জন্য। শুধু নিউইয়র্ক নয়, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গরাজ্য ও কানাডা থেকেও অনেকেই এসেছেন এই বইমেলায়। মানুষের এই ভালোবাসা ও আকর্ষণের কারণেই হয়তো আয়োজক প্রতিষ্ঠান মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ৩৩ বছর ধরে সফলভাবে এমন প্রাণবন্ত একটা অনুষ্ঠান করতে পারছে। শুধু যে করতে পারছে তা নয়, বিদেশের মাটিতে বাঙালির একটা ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে তারা।
১৯৯২ সালে ‘মুক্তধারা’ ও ‘বাঙালির চেতনা মঞ্চ’ নামে দুটি সংগঠনের উদ্যোগে শুরু হওয়ার পর থেকে আজ অবধি প্রতিটি বইমেলা উদ্ভাসিত হয়েছে নানা তারার আলোয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উজ্জ্বল ব্যক্তিরা প্রতিবছর এখানকার বাঙালিদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় উজ্জীবিত করে যান। প্রথমবার এই বইমেলায় এসেছিলেন ছিলেন জ্যোতি প্রকাশ দত্ত। এরপর একে একে আসেন শহীদ কাদরী, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, পূরবী বসু, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, হুমায়ূন আহমেদ, দিলারা হাশেম, ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, ইমদাদুল হক মিলন, হুমায়ুন আজাদ, জয় গোস্বামী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, রাবেয়া খাতুন, আনিসুল হক, গোলাম মুরশিদ, আনিসুজ্জামান, রফিক আজাদ, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, তপন রায় চৌধুরী, শামসুজ্জামান খান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সেলিনা হোসেন, পবিত্র সরকার, রামেন্দু মজুমদার, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, আসাদ চৌধুরীসহ অনেকেই। এ তালিকা বেশ দীর্ঘ। নিউইয়র্ক বইমেলাকে তাই অনেকে বলেন তারকাখচিত বইমেলা।
২০২৪ সালের বইমেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। দুই বাংলা আর বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বাংলা সংস্কৃতির প্রাণময় মানুষেরা এবারও তাঁদের কথার সুবাস ছড়িয়েছেন বইমেলার মঞ্চ থেকে। উদ্বোধন করার জন্য এসেছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। উদ্বোধনীসহ চার দিনব্যাপী মেলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কথামালায় থেকেছেন ঢাকা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৌমিত্র শেখর, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রহ্লাদ রায়, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, কথাসাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগর, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী লিলি ইসলাম, কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, কবি সৈয়দ আল ফারুক, কবি জাফর আহমদ রাশেদ, সময় প্রকাশনের প্রধান নির্বাহী ফরিদ আহমদ, অভিনেত্রী সারা যাকের, কবি শিহাব শাহরিয়ার, কবি জিন্নাহ চৌধুরী ও ছড়াকার শামস চৌধুরী রুশো।
মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সভাপতি নুরুন নবী, ৩৩তম বইমেলার আহ্বায়ক হাসান ফেরদৌসসহ আরও অনেকে। প্রতিবছর মার্কিন বাঙালি প্রবাসীরা বইমেলার কল্যাণে গুণীজনের সান্নিধ্য পান। নিউইয়র্কপ্রবাসী ডেইলি স্টারের সাবেক সাংবাদিক মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রবাসীদের জন্য এটা বড় সৌভাগ্যের বিষয় যে কয়েক দশক ধরে মুক্তধারা আমাদের এই সুযোগ করে দিচ্ছে। এ কারণে মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহার কাছে আমরা ঋণী।’
বিশ্বজিৎ সাহা নিজেও নিউইয়র্কবাসীর প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা জানান। এত বছর ধরে এত বড় একটা আয়োজনে সমর্থন দেওয়ার জন্য। তিনি বলেন, ‘এই বইমেলাকে আমরা একটা আন্দোলন হিসেবে নিয়েছি। বাঙালি যেখানেই থাক, যত দূরেই থাক, তার প্রাণে যেন বাংলা থাকে। বাংলাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে, বাংলা বইয়ের বাজারের পরিসর বাড়াতে, নতুন প্রজন্মকে পাঠাভ্যাসে ফিরিয়ে আনতে আমাদের এই আয়োজন।’ বিশ্বজিৎ সাহা জানান, বাংলাদেশের বড় বড় প্রকাশকের অংশগ্রহণের কারণে পাঠকেরা লাভবান হয়েছেন। মোট ৪১টি স্টলে বাংলাদেশ, ভারত, লন্ডন, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী লেখকদের লেখা ১০ হাজার বই ছিল এ বইমেলায়।
মেলা উপলক্ষে পেনসিলভানিয়া থেকে এসেছিলেন কবি ও সাহিত্য পত্রিকা ‘মনমানচিত্র’–এর সম্পাদক আলী সিদ্দিকী। তিনি বলেন, দেশের শীর্ষ প্রকাশনাগুলোর উপস্থিতি বইমেলাকে পূর্ণতা দিয়েছে।
উত্তর আমেরিকা থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনগুলোর নিজস্ব স্টল মেলার দর্শকদের আকর্ষণ করেছে। এখানকার লেখকদের অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে এবং বিক্রিও হয়েছে আশানুরূপ। মেলায় এসেছে ‘মনমানচিত্র’র বিশেষ প্রকাশনা ‘আত্মহনন: স্বেচ্ছামৃত্যুতে সমর্পিত লেখক কবি–শিল্পী’ সংখ্যা। মেলার প্রথম তিন দিনেই সব সংখ্যা বিক্রি হয়ে যায়।
বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন বাতিঘর প্রকাশনের কর্ণধার দীপংকর দাশ। তিনি বলেন, ‘বিমানে মেলার জন্য বই নিয়ে আসা খুব কঠিন কাজ। আমরা প্রবাসী পাঠকদের উৎসাহের কথা বিবেচনা করে লাভ–ক্ষতির হিসাব বিবেচনায় আনি না। দেশের মাটি ছেড়ে চলে আসা চেনামুখগুলো আমাদের সামনে বই খুলে তাতে চোখ বুলাচ্ছে দেখলে আমাদের শান্তি লাগে। বই যা এনেছি, তার বেশির ভাগ বিক্রি হয়ে গেছে।’
চার দিনব্যাপী মেলা চলাকালে বাইরের উন্মুক্ত মঞ্চে, মিলনায়তনে প্রতিদিন নানা অনুষ্ঠান ছিল। কবিতা পাঠের আসর, ছড়া পাঠের আসর, নাটক, মুক্তিযুদ্ধ, সমকালীন সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে ছিল আলোচনা অনুষ্ঠান। ছিল ‘প্রবাসে সাহিত্যচর্চা মূল্যহীন’ শিরোনামে একটি প্রাণবন্ত সরস বিতর্ক অনুষ্ঠান। এসব ছাড়া ছিল নাটক ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, সংগীত ও নৃত্যানুষ্ঠান।
মেলার চারটি দিন সাহিত্যকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন ছড়াকারেরা। কারণ, মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন তারকা ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন। তাঁকে প্রতিদিন মঞ্চে উঠতে হয়েছে, নানা বিষয়ে কথা বলতে হয়েছে। তবে তাঁকে ঘিরে জমজমাট আড্ডা ছিল ছড়া পত্রিকা ‘ছড়াটে’র স্টলে। ‘ছড়াটে’র একটি বিশেষ মুদ্রিত সংকলন প্রকাশের পাশাপাশি এবারের মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল ছড়াকারদের নিজের হাতের লেখা দিয়ে প্রকাশিত একটি দেয়াল পত্রিকা। মেলাতেই সেটি উন্মোচন করেন লুৎফর রহমান রিটন ও সৈয়দ আল ফারুক। মেলার সবকিছু নিয়ে ‘ছড়াটে’র সম্পাদক শামস চৌধুরী রুশো বলেন, ‘নিউইয়র্ক বইমেলা মানে অন্য রকম আনন্দ। প্রতিবছর অপেক্ষায় থাকি তিন/চার দিনব্যাপী লেখক, পাঠক, প্রকাশক, শিল্পীসহ সংস্কৃতজনদের এই মহামিলনমেলার জন্য। চারদিকে যেমন নতুন বইয়ের গন্ধ, তেমনি শাড়ি-পাঞ্জাবিসহ দেশীয় পোশাক গায়ে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। উৎসবের আনন্দে মনটা প্রফুল্ল থাকে। অন্তত এই কদিন আমরা একটা বাঙালি আবহের ভেতর ডুবে থাকি।’
মহাব্যস্ত মহানগর নিউইয়র্কের বুকে এমন বাংলা আয়োজনে মনে হলো যেন বাংলা ছড়ার ছন্দে কল্লোলিত হচ্ছে হাডসন নদীর ধারা। অতলান্তিক সাগর থেকে হু হু করে বলে উঠছে, আমরা বাঙালি জাতি, আমরা এসেছি।