মহসিনা আক্তারের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় নাট্যদল ‘স্পর্ধা’র নাটক তবুও জেগে উঠি দেখতে দেখতে মনে হলো, এই নাটকের চরিত্রগুলো তো আসলে আমি—আমার ছোটবেলা, বেড়ে ওঠা; এই যে আমার চারপাশে এত বাধা, আবার সেগুলো উপেক্ষা করে জেগে ওঠা, সবই আমার জীবনে নানাভাবে ঘটেছে! শুধু নিজের কথাই–বা বলি কেন, আমাদের আশপাশের প্রত্যেক মেয়েই এ নাটকে তীব্রভাবে উপস্থিত। তাই নাটক শেষে আমার চোখও বাষ্পীভূত!
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ঘেরাটোপে মেয়ে হিসেবে বেড়ে ওঠা যে কত কষ্টের, তা আমরা পদে পদে উপলব্ধি করি। কিন্তু নাটকের সঙ্গে বাস্তবের পার্থক্য হলো, বাস্তবে আমাদের কষ্টগুলোর পেছনে কোনো আবহসংগীত থাকে না। তাই অনেক সময় সাদা চোখে তা ধরাও পড়ে না। মহসিনা তবু শুধু আবহসংগীতের ওপর ভর না করে নারীজীবনের কুৎসিত কিছু অধ্যায়কে মঞ্চায়িত করলেন ঘটনার পুনর্বৃত্তায়নের মধ্য দিয়ে। এটি ছিল এই মৌসুমে নাটকটির শেষ মঞ্চায়ন।
পুরো নাটকে দর্শকদের অবাক করেছেন মরিয়ম রূপা। তাঁকে চিনি বহু বছর ধরে, ভালো একজন আলোকচিত্রী তিনি। কিন্তু অভিনয়েও যে তিনি এতটা দক্ষ, তা কে জানত! সেদিন যখন তাঁর অভিনয় দেখছিলাম, মনে হচ্ছিল, আমার মতো রূপাও কি তাঁর নারী হয়ে ওঠার যাত্রায় এতটাই আঘাত পাওয়া কি না! পুরোটা সময় শর্মী, বহ্নি, মিম, ওরিশা, মূর্ছনা, মিশেল—সবার অভিনয়ের ভেতরে বারবার রূপাকেই দেখেছি। অভিনয়ের মধ্য দিয়ে এই সমাজের প্রতি রূপা ছুড়ে দিচ্ছিলেন রাগ, অভিমান আর ঘৃণা। কতবার যে কাঁদলাম। পরেও আমি রূপাকে ধরে কাঁদলাম, কাঁদলেন রূপাও। এই কান্নাকে ‘কালেকটিভ’ বা সমষ্টিগত ক্রন্দন বলতে পারি। কোনো কথা হলো না, তবু আমরা দুজন দুজনের ভাষা বুঝে গেলাম!
মহসিনা নাটকের নির্দেশক হয়েও অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে নিজের অভিনয়ের ঝলকও দেখিয়ে দিলেন। অনেকটা অকস্মাৎই নাটকের মাঝখানে ঢুকে পড়লেন তিনি। তাঁর এই হঠাৎ ঢুকে পড়া এতটাই বাস্তব ছিল যে মনে হলো, এটা কি স্ক্রিপ্টে ছিল, নাকি তৎক্ষণাৎ তিনি সত্যি সত্যিই রাগ হয়ে ছুটে গেলেন পুরুষ সহকর্মীদের দিকে। এ ধরনের গোলকধাঁধাময় ‘পাবলিক ইন্টার্যাকশন’ প্রযোজনাটিকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।
নারী হলো ফিনিক্স পাখির মতো। নিজের ছাই থেকেই আবার তাঁর জন্ম নিজেরই আগুন দিয়ে। বারবার নিজের জায়গার জানান দেন নারী। বারবার জেগে ওঠেন, বারবার ঘুরে দাঁড়ান। গত ২৮ ডিসেম্বর পান্থপথে মঞ্চস্থ হওয়া নাটকটি যেন সেই বার্তাই আমাদের মনে করিয়ে দিল।
সুবর্না মোর্শেদা