কবি শহীদ কাদরী ছিলেন দারুণ আড্ডাবাজ। জীবনের বিশাল একটা অংশ তিনি গুলিস্তানের রেক্স রেস্টুরেন্ট আর বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছেন। ষাট ও সত্তরের দশকের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ কবি-লেখকের সঙ্গেই শহীদ কাদরীর ছিল গভীর সম্পর্ক। তিনি এতটাই আড্ডাবাজ ছিলেন যে বন্ধুদের মেস আর বাড়িতে ঘুরে ঘুরে পুরো সপ্তাহ কাবার করে দিতেন। কবি শামসুর রাহমান ও সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে তাঁর ছিল দারুণ সম্পর্ক। শামসুর রাহমানের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের ঘটনাটি খুবই চমকপ্রদ।
তখন সবে কবিতা লেখা শুরু করেছেন শহীদ কাদরী। মহিউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত স্পন্দন পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রথম কবিতা ‘পরিক্রমা’ ছাপা হলো। দ্বিতীয় কবিতাও ছাপা হয় সেখানেই, ‘জলকন্যার জন্য’ শিরোনামে।
কবিতা ছাপা হওয়ার পর প্রায় প্রতিদিনই খান মজলিসের বুক স্টলে যেতেন শহীদ কাদরী। স্পন্দন পত্রিকাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজের কবিতা পড়তেন জোরে জোরে। আর আড়চোখে দেখতেন, কেউ পত্রিকাটি খুলে তাঁর কবিতা পড়েন কি না।
একদিন দেখলেন, শামসুর রাহমান সেখানে দাঁড়িয়ে স্পন্দন খুলে কবিতা পড়ছেন। শামসুর রাহমানকে শহীদ কাদরী জিজ্ঞেস করলেন, ‘“জলকন্যার জন্য” কবিতাটা আপনার কেমন লাগল?’ শামসুর রাহমান হেসে বললেন, ‘আপনি কি শহীদ কাদরী? আপনার কথা তো খোকন আমাকে বলেছে।’
তখনই শামসুর রাহমানের সঙ্গে পরিচয় ঘটল শহীদ কাদরীর। তখন তাঁরা পকেটে কবিতা নিয়ে ঘুরতেন। তো পকেট থেকে আরেকটা কবিতা বের করে শামসুর রাহমানকে শোনালেন শহীদ কাদরী। এভাবে শামসুর রাহমানও শহীদ কাদরীর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাঁকে নিজের লেখা নতুন নতুন কবিতা শোনাতেন। গড়ে উঠল তাঁদের বন্ধুত্ব। তবে তাঁরা একে অন্যকে খেপিয়ে খুব মজা পেতেন।
একবার হলো কি, তাঁদের সবাই ফরাসি কবিতা নিয়ে মজেছেন। এর মধ্যে শামসুর রাহমান খানিকটা সিরিয়াস হয়ে গেলেন। নিজের কবিতায় ফরাসি শব্দ আর ভাবের সন্নিবেশ ঘটাতে লাগলেন। বিষয়টা শহীদ কাদরীর চোখ এড়াল না। তাই একদিন কৌতুক করেই শামসুর রাহমানকে খোঁচা দিলেন তিনি, ‘কী, বাংলা ভাষায় আপনার ফরাসি কবিতা লেখা কেমন চলছে?’ এ কথা শুনে শামসুর রাহমান তো রেগেমেগে আগুন। তিন মাস শহীদ কাদরীর সঙ্গে কথা বলেননি।
পরে অবশ্য এই রাগ আর থাকেনি।
আদতে কাদরীর রসিকতায় কাউকে খাটো করার ব্যাপার ছিল না। এক সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘সত্যিকার অর্থেই আমি অনেকের সাথেই খুব রঙ্গ–রসিকতা করে কথা বলতাম। কাউকে আঘাত করার জন্য অবশ্যই নয়। তবে বিষয়টা অনেকেই সিরিয়াসলি নিয়ে নিতেন।’
সূত্র: শঙ্খচিল শহীদ কাদরী সংখ্যা ও জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের নিবন্ধ ‘শহীদ কাদরী: লেখা না-লেখার গল্প’
গ্রন্থনা: বাশিরুল আমিন