বাংলায় যেভাবে ঈদ-উৎসব শুরু হলো

বাঙালি মুসলমানের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হলো ঈদ। কেমন ছিল সেকালের বাঙালিদের ঈদ উদ্‌যাপন? বিভিন্ন বইপত্রের শরণ নিয়ে জানা যাক সে সম্বন্ধে।

১৬৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ অঞ্চলের প্রথম ঈদগাহের (ধানমন্ডির শাহি ঈদগাহ) ছবি এবং শিল্পী আলম মুসাওয়ার অঙ্কিত সেকালের ঈদযাত্রার চিত্রাবলি অবলম্বনে কোলাজ

১৭২৯ সালের পবিত্র রমজান মাসের শেষ দিন। রাত পোহালেই ঈদ। দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি খান খবর পেলেন ত্রিপুরা রাজ্য জয় হয়েছে, এটি এখন তাঁদের দখলে। এই সংবাদ মুর্শিদ কুলি খানের ঈদের আনন্দ দ্বিগুণ করে দিল।

মীর সৈয়দ আলী ও মীর মোহাম্মদ জামানকে তিনি আদেশ দিলেন, ঢাকা কেল্লা থেকে (ধানমন্ডির) ঈদগাহ পর্যন্ত দুই মাইল রাস্তায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এক হাজার টাকা বিলিয়ে দিতে। ঈদযাত্রা করে তাই-ই করা হলো। ঘটনাটি সম্পর্কে স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর বিখ্যাত বই বেঙ্গল নওয়াবস-এ বিশদভাবে লিখেছেন।

এই দান আর ঈদের আনন্দযাত্রা সব সময়ই যে এমন ছিল, তা নয়। তবে পরবর্তী দুই-আড়াই শ বছর পর্যন্ত নায়েব-নাজিমরা ধারাটি অব্যাহত রেখেছিলেন। এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, সেকালে ঈদ-উৎসবের সময় নবাবেরা নিজেদের শানশওকত আর আনন্দ প্রকাশের জন্য বড় একটা বহর নিয়েই ঈদগাহে যেতেন এবং সাধারণ মানুষকে দিতেন উপহার। নিম্নবিত্ত মানুষও তখন রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে থাকত, মোগল-আমিরদের ঈদযাত্রা দেখার জন্য বা উপহার পাওয়ার আশায়।

বাংলায় ঘটা করে ঈদ উদ্‌যাপনের ইতিহাসের সূচনা মোগলদের হাত ধরে। তার আগে বাংলা অঞ্চলে জাঁকজমকভাবে ঈদ-উৎসব বা ঈদের সংস্কৃতির খোঁজ সেভাবে মেলে না। ইতিহাস ঘাঁটলে এ অঞ্চলে প্রথম যে ঈদগাহের সন্ধান মেলে, সেটি ১৬৪০ সালের দিকে ধানমন্ডিতে নির্মিত এবং শাহি ঈদগাহ নামে পরিচিত।

বাংলায় ঘটা করে ঈদ উদ্‌যাপনের ইতিহাসের সূচনা মোগলদের হাত ধরে। তার আগে বাংলা অঞ্চলে জাঁকজমকভাবে ঈদ-উৎসব বা ঈদের সংস্কৃতির খোঁজ সেভাবে মেলে না। ইতিহাস ঘাঁটলে এ অঞ্চলে প্রথম যে ঈদগাহের সন্ধান মেলে, সেটি ১৬৪০ সালের দিকে ধানমন্ডিতে নির্মিত এবং শাহি ঈদগাহ নামে পরিচিত। বাংলার সুবেদার শাহ সুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম এটি নির্মাণ করেন। ঢাকার ইতিহাসবিদ হেকিম হাবিবুর রহমানের লেখা থেকে জানা যায়, ১৬৪০ সালে প্রথম দিকে গড়ে ওঠা ধানমন্ডির ওই ঈদগাহে সবার যাওয়ার সুযোগ ছিল না, কেবল নবাব, উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারী, কাজি-হাকিম এবং তাঁদের বন্ধুবান্ধবই ঈদগাহে যেতেন।

পরে সতের শতকের দিকে সিলেটের প্রথম ঈদগাহ শাহি ঈদগাহ এবং আঠারো শতকে কিশোরগঞ্জের নরসুন্দার তীরে শোলাকিয়াহ ঈদগাহসহ পর্যায়ক্রমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঈদগাহ বা ঈদের মাঠের গোড়াপত্তনের মধ্য দিয়ে মূলত মুসলমানদের এই প্রধান ধর্মীয় উৎসব পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

এর আগে বাংলার সাধারণ মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঈদ-উৎসব উদ্‌যাপন করতে তেমনভাবে দেখা যায়নি। জেমস টেলরের লেখা টপোগ্রাফি অব ঢাকা কিংবা জেমস ওয়াইজের বই ঘাঁটলে মালুম হয়, তখনকার সময়ের সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় বিষয়-আশয় নিয়ে আজকের মতো এতটা সচেতনতা ছিল না, এমনকি ঈদের নামাজ কীভাবে পড়তে হয়, অনেকে সেটাও ঠিকভাবে জানতেন না।

১৮৮৫ সালের দিকে ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস ওয়াইজ তাঁর নোটস অন রেইসেস: কাস্ট অ্যান্ড ট্রেড অব ইস্টার্ন বেঙ্গল বইয়ে লিখেছিলেন, ‘ঈদের সময় লক্ষ্যা নদীর তীরে স্থানীয় গ্রামবাসী মিলিত হয়েছিলেন নামাজ পড়ার জন্য। তবে সেটা কীভাবে করবেন, তা তারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। আসলে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতাই এর জন্য দায়ী। নদীতে নৌকায় করে ঢাকার এক যুবক যাচ্ছিল। অবশেষে তাকে দিয়ে ঈদের জামাত পড়ানো হলো।’

ইতিহাস বলছে, মোগল শাসক ও ঢাকায় আসা খোরাসানি শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের হাত ধরে বাংলার ঈদ-উৎসব দিনে দিনে বর্ণিল হতে শুরু করে। উৎসবকে আরও সপ্রাণ করতে ধীরে ধীরে এতে যুক্ত হয় ‘ঈদ-মিছিল’, ‘চানরাতের উৎসব’, ‘মেহেদি উৎসব’, ‘ঈদ মেলা’সহ বিচিত্র সব অনুষঙ্গ। ঢাকা পাঁচাস বারাস পাহলে বইয়ে হেকিম হাবিবুর রহমান দাবি করেন, ঢাকায় যে খোসবাস সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, তা ছিল মূলত ইরান ও আগ্রার সমাজব্যবস্থার অনুকরণে।

ঈদ-মিছিল

নায়েব-নাজিমদের এ সময় ঢাকায় যে ঈদ-মিছিল বের হতো, তা যথেষ্ট দৃষ্টিনন্দন ছিল। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকার শিল্পী আলম মুসাওয়ার নায়েব-নাজিমদের মহররম ও ঈদযাত্রার ৩৯টি ছবি আঁকেন, বর্তমানে ছবিগুলো জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এসব ছবি থেকে সেকালের ঈদ-মিছিল সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।

কী না ছিল ঈদের সেই মিছিলের মধ্যে! মিছিলের বিরাট বহরের সঙ্গে রংবেরঙের নিশান, জমকালো হাওদায় সজ্জিত হাতি, উট, পালকি...আরও কত কী! সামনের হাতিতে থাকতেন নায়েব-নাজিম। তাঁর পেছনে থাকতেন আমির, অমাত্য ও বিদেশি মেমরা। আর এসবের পেছনে কিংখাবের ছাতা হাতে ছিলেন ছাতি বরদার ও বাদ্যকরেরা।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ঢাকা সমগ্র গ্রন্থে জানাচ্ছেন, এই ঈদ শোভাযাত্রা বা আনন্দমিছিল ঢাকার নিমতলি প্রাসাদ থেকে চকবাজার, হোসেনি দালান ঘুরে আবার ফিরে আসত প্রাসাদে। আর ওই শোভাযাত্রা থেকে গরিব আদমিদের পয়সা ছিটিয়ে দেওয়া হতো।

চাঁদ দেখা

এখন ঈদের চাঁদ দেখাকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস দেখা যায়, সেকালেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ঈদের মূল আনন্দ শুরু হতো ঈদের চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে। ঈদের চাঁদ দেখতে কেউ নৌকা নিয়ে যেতেন বুড়িগঙ্গায়, কেউবা কেল্লায় উঠতেন। চাঁদ দেখার জন্য নবাববাড়ির ছাদই ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত। চাঁদ দেখা গেলে নবাববাড়ি থেকে তোপধ্বনির আওয়াজ শোনা যেত। সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় আলোকিত হতো মোগল আমলের ঢাকা।

সৈন্য শিবিরে বেজে উঠত শাহি তূর্য। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলত আতশবাজির খেলা। গবেষক আনোয়ার হোসেন আমার সাত দশক বইয়ে জানাচ্ছেন, চাঁদ দেখার পর ঈদকে স্বাগত জানিয়ে কিশোরেরা মিছিল করত এবং কাসিদা গাইত। ঢাকায় চাঁদরাতে কী হতো, তার সবিস্তার বর্ণনা পাওয়া যায় আবু যোহা নুর আহমদের বই উনিশ শতকের ঢাকার সমাজ জীবন-এ। এতে তাঁর ভাষ্য, ‘চাঁদ দেখামাত্রই চারিদিক হইতে মোবারকবাদ, পরস্পর সালাম বিনিময় এবং গোলাবাজি ও তোপের আওয়াজ হইতে থাকিত।’

বিশ শতক পর্যন্ত ঈদের কেনাকাটা সাধারণ চাঁদরাতেই হতো। ছেলেরা কাগজের টুপি কিনত, মেয়েরা কিনত চুড়ি। তবে বর্তমানে ঈদ সামনে রেখে যেভাবে নতুন জামা-জুতা কেনার হিড়িক পড়ে, বাঙালি মুসলমান সমাজে এই চল খুব বেশি দিন গড়ে ওঠেনি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ অঞ্চলে মাত্র কয়েক দশক আগ থেকে ঈদ উপলক্ষে মানুষ দর্জিবাড়িতে যাতায়াত শুরু করে। লোকসংস্কৃতিবিদ শামসুজ্জামান খানের ‘বাঙালি মুসলমানের ঈদ’ প্রবন্ধে এ কথার সপক্ষে সাক্ষ্যও পাওয়া যাচ্ছে। তিনি লিখেছেন, সেসময়কার সাধারণ মানুষ ধুতি পরতেন। নামাজের সময় ধুতির পেছনের গিঁঠ খুলে দিতেন।

ঈদের মেলা

মুনশী রহমান আলী তায়েশ তাওয়ারিখে ঢাকা বইয়ে লিখেছেন, ‘উনিশ শতকের শেষের দিকে ঢাকার মুসলমানেরা ধানমন্ডির মোগল ঈদগাহে যেতেন ঈদের নামাজ পড়তে। যদিও সে ঈদগাহ তখন অযত্ন-অবহেলায় জরাজীর্ণ ও জঙ্গলাকীর্ণ। ঈদ উপলক্ষে এখানে মেলা হতো, সেখানে যোগ দিতেন ঢাকা ও আশপাশের এলাকার লোকজন।’

এভাবে ঈদ উপলক্ষে মেলার যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, অচিরকালের মধ্যে তা বিভিন্ন স্থানে সম্প্রসারিত হয়। ধানমন্ডির পর ঢাকার চকবাজার, কমলাপুর ও রমনায়ও ঈদ মেলার সূচনা ঘটে। এসব মেলায় সাধারণত শিশু-কিশোরদের খেলনা, হরেক পদের মণ্ডামিঠাই ও নানা রকমের খাবার পাওয়া যেত। আশরাফউজ্জামান তাঁর আত্মস্মৃতিমূলক এক নিবন্ধে এই মেলার কথা উল্লেখ করেছেন, ‘ঈদের মেলা হতো চকবাজারে এবং রমনা ময়দানে। বাঁশের তৈরি খাঞ্চা ডালা আসত নানা রকমের। কাঠের খেলনা, ময়দা এবং ছানার খাবারের দোকান বসত সুন্দর করে সাজিয়ে। কাবলীর নাচ হতো বিকেলবেলা।’

ঈদ মেলার সংস্কৃতিটি খুব দ্রুতই বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে ছড়িয়ে পড়ে। গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকের সামাজিক ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ঈদকে কেন্দ্র করে বাংলার গ্রামীণ জনপদে মেলার যে সংস্কৃতি শুরু হয়, দ্রুতই তা ঈদের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, কবি জসীমউদ্‌দীন প্রমুখ মনীষীর আত্মস্মৃতিতে সেকালের ঈদ–উদ্‌যাপনের টুকরা টুকরা বিবরণ আছে। সেখান গত শতকের ঈদ-সংস্কৃতির চিত্র ফুটে ওঠে। জানা যায়, ঈদের সকালে শিশু-কিশোরেরা মুরব্বিদের কাছ থেকে ঈদসালামি সংগ্রহ করে তারপরই ঈদগাহে যেত। পরে ঈদের নামাজ শেষে ঈদগাহ থেকে ফেরার পথে মেলা থেকে নানা রকম খেলনা আর খাবার কিনে বাড়ি ফিরত। সে সময় এগুলোই ছিল ঈদের আনন্দময় স্মৃতি।

এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঈদের এ ধরনের মেলা বসে। ঈদের নামাজের পর শুরু হওয়া মেলা কোথাও দু-তিন দিন পর্যন্ত চলে।

নানান আয়োজনে ঝলমলে

শুধু ঈদ মেলা নয়, সেকালের ঈদের আনন্দ আরও ঝলমলে হয়ে উঠেছিল বিচিত্র সব ক্রীড়ামূলক আয়োজনে। যেমন ঈদকে ঘিরে নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌড় বা বিভিন্ন ধরনের খেলা হতো। আঠারো শতকের শেষ বা উনিশ শতকের শুরু থেকে ঈদ উপলক্ষে বাংলার বিভিন্ন গ্রামে এই খেলাধুলার প্রচলন হয় বলে গবেষকদের অনুমান। যদিও এ অঞ্চলে নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌড় বা নানা রকমের প্রতিযোগিতার ইতিহাস বেশ পুরোনো। মির্জা নাথান তাঁর বিখ্যাত বই বাহারিস্তান-ই গায়েবিতে লিখেছেন, ‘সুবেদার ইসলাম খান ঢাকার ইসলামপুরে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকাবাইচের ব্যবস্থা করতেন। এ সময় তিনি নিজেও উপস্থিত থাকতেন।’

আবার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান অনূদিত জেমস টেলরের কোম্পানি আমলে ঢাকা গ্রন্থে আছে, ‘আঠারো শতকের প্রথম থেকেই ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ঈদ ও মহররমে নৌকাবাইচের আয়োজন করা হতো। কোথাও কোথাও ঘোড়দৌড়ের প্রচলনও ছিল।’

বাঙালি মুসলমানের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হলো ঈদ। ধর্মের আচার পালনের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনে এ অঞ্চলে ঈদ উদ্‌যাপনের ক্যানভাসটি দিনে দিনে যে বিশাল হয়ে উঠেছে, এসব দৃষ্টান্তই তার প্রমাণ।