দেশভাগের অন্বেষণে বাংলাদেশে

দেশভাগ নিয়ে গবেষণার কাজে ভারতের বাচনিক ইতিহাসের গবেষক রাশি পুরি সম্প্রতি এসেছিলেন বাংলাদেশে। দেশভাগের কারণে যাঁরা ওপার থেকে এপারে এসেছেন, তিনি কথা বলেছেন তাঁদের ও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে

১৯৪৭ সালের দেশভাগের চার কুশীলব (বাঁ থেকে) জওহরলাল নেহরু, সিরিল র‍্যাডক্লিফ, লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলন শুরু হওয়ার তিন সপ্তাহ আগে আমি এর রাজধানী ঢাকায় গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল ১৯৪৭ সালের দেশভাগের খোঁজ। দেশভাগ তর্কাতীতভাবে উপমহাদেশে অনেক ঘটনার ভিত্তি স্থাপন করে দিয়েছিল। সেসব ঘটনার পরম্পরা এগিয়ে গেছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিসংগ্রামের দিকে। দেশভাগের যাঁরা শিকার, যাঁরা বেঁচে আছেন সেই সময় পার হয়ে, তাঁরা মনের গভীরে সেই স্মৃতিকে কবর দিয়ে রেখেছেন। এই নগরীর জনস্মৃতিতে একে খুঁজে পাওয়া কঠিন। সারা দেশেও হয়তো তা-ই।

দেশভাগের ফলে ১৯৪৭ সালে দুটি নতুন দেশ গঠিত হলো—ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের আবার ছিল দুটি অংশ। একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব ২ হাজার ২০৪ কিলোমিটার। বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগ হয়ে পাকিস্তান আর ভারতে পড়েছিল। তবে এর মধ্যে পাঞ্জাবের দেশভাগচর্চা প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। এর কারণ সম্ভবত সেখানে ঘটে যাওয়া হিংসাত্মক ঘটনা আর সেই সঙ্গে মাত্র এক বছরের মধ্যে বিশাল সংখ্যার অভিবাসন। পাঞ্জাবের দেশভাগের আলোচনা ১৯৪৭ সালের চৌহদ্দিতে বেঁধে রাখা যায়। ১৯০৫ সালের পরে বাংলার দ্বিতীয় দেশভাগকে তেমনটা করা যায় না। এখানে সংখ্যালঘুদের অভিবাসন ঘটেছে ধীরে, ক্রমাগত। প্রতিবার তা বাংলার ঝাঁঝরা সীমান্তের দুই পাশে নতুন করে দাঙ্গা বাধিয়েছে। আর ১৯৪৭ সালে শুরু হওয়া শরণার্থী সমস্যা হয়েছে তীব্রতর।

১৯৭১ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে অভিবাসনের আরেক বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়েছিল ভারতে। ১৯৪৭ সালের পর এত বড় অভিবাসন আর হয়নি। লাখ লাখ আশ্রয়প্রার্থীর মধ্যে শুধু যে হিন্দু-মুসলিম বাঙালি ছিলেন এমন নয়; ছিলেন বাংলাদেশের ‘উর্দুভাষী’ জনতাও। তাঁদের অনেকেই মাত্র তিন দশক আগে এই অঞ্চল ছেড়ে পাকিস্তানে অভিবাসিত হয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরই গোটা অঞ্চল আচ্ছন্ন হলো মহান মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান আজও এই যুদ্ধকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে ও স্মরণ করে।

ঢাকাজুড়ে দেখেছি মহান মুক্তিযুদ্ধ আর সেই যুদ্ধের বীরদের নিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ, স্থাপনা, ব্যানার। পুরো দেশ সেই স্মৃতিকে তরতাজা রাখতে বদ্ধপরিকর। সে চিহ্ন স্পষ্ট। সেই বীরত্বের জীবন্ত ইতিহাসকে দেখতে পেয়েছি নগরীর পরিবেশের অংশ হিসেবে। তবে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ নিয়ে ভারতীয় গবেষক হিসেবে, এ সবকিছুর মধ্যে আমি খুঁজেছি দেশভাগ। খুঁজেছি সেই পুরোনো সময়ের ঝলক, যখন বাংলা ছিল অখণ্ড।

সেই অতীতকে খুঁজতে আমি গেছি মানুষের কাছে। অবিভক্ত ভারতে তাঁদের অভিজ্ঞতা, তাঁদের অভিবাসনের স্মৃতি ও পাকিস্তানের উত্থান সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা ও সাংস্কৃতিক পটভূমির মানুষ।

ইতিহাস এই উদ্বাস্তুদের তরুণ প্রজন্মকে দেশভাগের উত্তরাধিকারের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।

ইতিহাস লেখক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমরের বাড়ি ছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের খুলনায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর আক্রমণের জবাবে সেই বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেটা দেশভাগের প্রায় তিন বছর পরের ঘটনা। এ কারণে তাঁর পরিবার ঢাকায় অভিবাসিত হয়। উমরের বাবা ছিলেন মুসলিম লীগের প্রখ্যাত নেতা আবুল হাশিম। আমি ভাবছিলাম, তিনি আরও আগেই দেশ–ত্যাগ করেননি কেন?

‘আমার বাবা চলে যেতে চাননি। আমাদের চলে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না।’ ৯১ বছর বয়সী উমর উত্তর দিয়েছেন, ‘বাবা বঙ্গভঙ্গ চাননি, কিন্তু আমাদের বাড়িতে আগুন লাগানো হলে বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।’

১৯৪৭ সালের জুন মাসের আগেই দেশত্যাগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখনো ভারত–পাকিস্তানের সীমান্ত ঘোষণা করা হয়নি। এর মধ্যেই মানুষ ‘নিরাপদ অঞ্চল’-এ অভিবাসন করছিলেন। হিন্দু আর শিখরা চলে যান আজকের ভারতে, আর মুসলমানেরা পাকিস্তানের দুই অংশে। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওডিশা ও উত্তর প্রদেশের কিছু অংশের জন্য পূর্ব বাংলা ছিল ভৌগোলিকভাবে কাছে। এ বাস্তবতা অভিবাসনের ক্ষেত্রে তাঁদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে।

নিজেদের বাড়ি ও পরিবার পেছনে ফেলে লাখ লাখ মানুষ হয়ে গেলেন শরণার্থী। এসব অঞ্চল থেকে নারী ও পুরুষ ট্রেনে করে, কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ একেকটি দলে পথ চলে পালাতে লাগলেন উপমহাদেশব্যাপী চলতে থাকা সহিংসতার কবল থেকে বাঁচার তাগিদে। তাঁদের নতুন ঠিকানা ‘মুসলমানদের স্বপ্নভূমি’। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে নদী, বন ও পাহাড়। এর ছিদ্রগুলো দিয়ে দেশভাগের পর বহু বছর ধরে ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ যাতায়াত করেছেন।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি অংশ দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ত্রাণশিবিরে বসবাস করে। তাদের চিহ্নিত করা হয় বিভিন্ন নামে—‘উর্দুভাষী,’ ‘বিহারি’, কখনোবা ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’। কেন তাদের এত সব ভিন্ন নামে ডাকা হয়, কী কারণে ও কীভাবে তারা স্থানচ্যুত হয়ে এখানে এসেছে, এসব বিষয়েরও ব্যবচ্ছেদ হওয়া দরকার।

ঢাকার এমন এক ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, তাঁদের কারও কারও ভাইবোনেরা বাস করেন বাংলাদেশ ও ভারতে। মা আর বাবা বাস করেন হয়তো ভারত বা পাকিস্তানে। তাঁদের মেয়ে বিয়ের পর বাস করছেন বাংলাদেশে। মাঝেমধ্যে তাঁদের দেখা হয় কেবল হোয়াটসঅ্যাপ কলে।

১৯৪৭ সালের উপমহাদেশের বিভাজন এই মানুষগুলোকে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে এসেছিল। এই পরিবারগুলোর অল্পসংখ্যকই স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানে গেছে। এখন তারা ছড়িয়ে গেছে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রজুড়ে। ইতিহাস এই উদ্বাস্তুদের তরুণ প্রজন্মকে দেশভাগের উত্তরাধিকারের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। এই জনগোষ্ঠীকে কত সব ভিন্ন নামে ডাকা হয়। নামগুলো তাদের দুর্দশার প্রতীক। ‘পাকিস্তান’ নামে মুসলিম আবাসভূমি তৈরির জন্য খোদাই করা ভূমিতে এসে ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক দেশে তারা হয়ে পড়েছে ভাষাগত সংখ্যালঘু।

দেশভাগে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এর চেয়ে বড় বলপূর্বক অভিবাসন আর নেই। এ সময় নিহত হয়েছে ১০ লাখের বেশি মানুষ। দেশভাগের ইতিহাস গভীরভাবে এক জন-ইতিহাস। সে সময়ের সমাজ-রাজনৈতিক ঘটনা বৃহত্তর জনস্মৃতিতে ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু দেশভাগে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর ইতিহাস কারও মনে নেই। যখনই এমন কোনো ঘটনা ঘটে, যার শিকড় ১৯৪৭ সালে প্রোথিত, তখনই এই মানুষগুলো আবার দেশভাগের শিকার হয়।

বাংলাদেশ অতীতকে দেখে স্বাধীনতার আগে আর পরে হিসাবে। এর কারণও হয়তো আছে। তবে এর ফলে জনগণের স্মৃতি আর ইতিহাস থেকে দেশভাগ এখানে ফিকে হয়ে গেছে। এ বছর দেশভাগের ৭৭তম বছর। দেশভাগের শিকার প্রজন্মের যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের জীবনে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। তাঁদের স্মৃতিতে আছে দেশভাগের বহু গল্প। সেগুলো মানুষকে জানানোর জন্য সংরক্ষণ করা খুব জরুরি। ইতিহাসের একটি অংশ আমরা ভাগাভাগি করতাম। সেই ইতিহাস আর তাতে থাকা বহু বয়ান অন্বেষণ করলে আমাদের ঘিরে থাকা বর্তমান মুহূর্তকে পুরোপুরি বুঝে ওঠা সম্ভব।