ইতিহাসের দিশারি রণজিৎ গুহর ‘দেশে ফেরা’
গতকাল প্রয়াত হয়েছেন প্রভাবশালী ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ। ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫তম সমাবর্তনে ‘ডক্টর অব লিটারেচার’ উপাধি দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। সে সময় প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল এই লেখা। নিম্নবর্গের এই ইতিহাসকারের মৃত্যুর পর প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় লেখাটি আবার প্রকাশিত হলো।
অধ্যাপক আহমেদ কামালের স্বপ্ন ছিল গুরু রণজিৎ গুহকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকবার এনে বক্তৃতা করাবেন। সমকালীন দুনিয়ায় সবচেয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী জীবিত ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহরও খুব আগ্রহ ছিল, গান্ধীর মতো ভাসানীকে নিয়েও বড় মাপের গবেষণা হোক। দুটি স্বপ্নের কোনোটিই পূর্ণ হয়নি। তবে মেঘের স্বাদ বৃষ্টিতে হলেও কিছুটা মিটেছে। রণজিৎ গুহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা সম্ভব না হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ৪৫তম সমাবর্তনে এই ক্ষণজন্মা পণ্ডিতকে ‘ডক্টর অব লিটারেচার’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছে। অসুস্থতার কারণে তিনি সশরীর আসতে পারেননি তাঁর ছেড়ে যাওয়া ‘স্বদেশে’।
রণজিৎ গুহকে প্রাচ্যের তত্ত্ববিদ বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। তিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসকে, ভারতবর্ষ তথা বাংলার কৃষককে নূতন আলোয় দেখাতে পেরেছেন। এর আগে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে যে ইতিহাস আমরা দেখতে পেতাম, তা ছিল কেবল রাজরাজড়া কিংবা শহুরে-শিক্ষিত ভদ্রলোক নেতাদের ইতিহাস। সেই ইতিহাস আবার ইউরোপের চোখে দেখা। যেখানে ভারতবর্ষ বা প্রাচ্য মানেই অন্ধকার এক এলাকা, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি সেখানে আলো এনেছে। উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষ যে কৃষক, সেই কৃষককে দেখানো হয়েছে অসভ্য, কুসংস্কারময়, অসংগঠিত, নিজের ভাগ্য নিজে বদলাতে অক্ষম এক দুর্বল চরিত্র হিসেবে। রণজিৎ গুহ ও তাঁর অনুসারী নিম্নবর্গীয় ইতিহাসবিদেরা বললেন, শাসকের চোখ দিয়ে দেখা ইতিহাস সহি ও সত্য হতে পারে না। শাসক কিংবা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত ইতিহাসে শাসিত সাধারণ মানুষকে ছোট করেই দেখানো হবে। তাঁরা ইতিহাস খুঁড়ে তথ্য-প্রমাণ ও চিন্তা হাজির করে বললেন, ইংরেজ আমলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষক বিদ্রোহগুলোও জোরদার ও প্রবল ভূমিকা রেখেছে। সেই সময়ের ১১১ বছরের মধ্যে ১১৮টি কৃষক বিদ্রোহের নজির টেনে তাঁরা দেখান, এসব কৃষক বিদ্রোহই একটানা বিদেশি শাসন ও অন্যায়ের বিরোধিতা করে গেছে। সিপাহি বিপ্লব, তিতুমীরের লড়াই, তেভাগা আন্দোলন কিংবা সাঁওতাল, মুন্ডা, কোচ প্রভৃতি বিদ্রোহে নিম্নবর্গীয় মানুষের আত্মমর্যাদাবোধ তথা ইমানের সবলতা কোনো অংশেই কমজোরি নয়। তাদের নিজস্ব চেতনা, নৈতিকতা তথা অধিকারবোধ উচ্চবর্গের প্রচারকদের কাছ থেকে শেখা নয়; এসবের শেকড় তাদের জীবনের মধ্যেই পোঁতা। এটা করতে গিয়ে রণজিৎ গুহ তাঁর ‘পিজান্ট ইনসার্জেনসি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ বইয়ে ইতিহাসের নায়ক হিসেবে কৃষক শ্রেণিকে প্রতিষ্ঠা করেন। কেবল তা-ই নয়, ইউরোপীয় রাজশক্তি ও চিন্তাশক্তির আসরের ফলে আমরা যে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস আমাদের সমাজ-ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে ভুলে গেছি, সে ব্যাপারেও সতর্ক করেন। তাঁর লেখায় তিনি দেখিয়েছেন, ইউরোপ বা পাশ্চাত্য বিশ্বের কেন্দ্র নয়; বিশ্বে তারাও এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার মতোই একটা অঞ্চলমাত্র। এভাবে তিনি সাম্রাজ্যের রাজধানী থেকে নজর সরিয়ে আনলেন প্রান্তের দিকে। রচিত হতে থাকল প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস।
বিশ্বের সব দেশে আজ নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ধারা বিকশিত হচ্ছে, রচিত হচ্ছে অভিজাত শ্রেণির অহংকারী ইতিহাসের বিপরীতে তলাকার মানুষের নিজস্ব ইতিহাস। এই চিন্তা ইতিহাসের সীমানা ডিঙিয়ে দর্শন, রাজনীতি, সাহিত্য তথা জ্ঞানের সব শাখাকেই প্রভাবিত করেছে। রদবদল ঘটিয়ে দিয়েছে সমাজ-ইতিহাস ও রাজনীতিকে দেখার দৃষ্টিতে।
রণজিৎ গুহকে প্রাচ্যের তত্ত্ববিদ বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। তিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসকে, ভারতবর্ষ তথা বাংলার কৃষককে নূতন আলোয় দেখাতে পেরেছেন। এর আগে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে যে ইতিহাস আমরা দেখতে পেতাম, তা ছিল কেবল রাজরাজড়া কিংবা শহুরে-শিক্ষিত ভদ্রলোক নেতাদের ইতিহাস। সেই ইতিহাস আবার ইউরোপের চোখে দেখা। যেখানে ভারতবর্ষ বা প্রাচ্য মানেই অন্ধকার এক এলাকা, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি সেখানে আলো এনেছে। উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষ যে কৃষক, সেই কৃষককে দেখানো হয়েছে অসভ্য, কুসংস্কারময়, অসংগঠিত, নিজের ভাগ্য নিজে বদলাতে অক্ষম এক দুর্বল চরিত্র হিসেবে। রণজিৎ গুহ ও তাঁর অনুসারী নিম্নবর্গীয় ইতিহাসবিদেরা বললেন, শাসকের চোখ দিয়ে দেখা ইতিহাস সহি ও সত্য হতে পারে না।
রণজিৎ গুহকে মার্ক্সবাদী ধারার ইতিহাসবিদ ধরা হয়। কিন্তু ১৯৬৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের চেকোস্লোভাকিয়া আগ্রাসনের পর তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে দেন। তাহলেও তাঁকে বলা যায় মার্ক্স-ধারার মানবিক উত্তরসূরি, মুসোলিনির হাতে নিহত ইতালীয় বিপ্লবী আন্তোনিও গ্রামসির চিন্তার সহযাত্রী।
আড্ডার ছলে আমরা প্রায়ই বলে থাকি, বাংলা সাহিত্য দারুণভাবে বিকশিত হয়েছে প্রবাসে। প্রবাসটা কোথায়? পশ্চিম বাংলায়। প্রবাস বলছি এই অর্থে যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কারণে লাখ লাখ বাঙালি হিন্দুকে দেশান্তরী হতে হয়। পশ্চিম বাংলায় চলে যাওয়া সেই সব মানুষের মধ্যে ছিলেন গুণী মানুষ। রবীন্দ্রনাথ তো পদ্মাপাড়ের মন নিয়েই লিখেছেন অজস্র কবিতা। এ ছাড়া সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অরুণ সেন, দেবেশ রায় প্রমুখ পূর্ব বাংলা তথা এই বাংলাদেশেরই সন্তান। পণ্ডিত ও গবেষক নীরদ চন্দ্র চৌধুরী, তপন রায়চৌধুরী; কিংবা চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনদেরও আদি বাড়ি তো এ দেশেই। দেশপ্রেম প্রায়ই অন্ধ। ভেবে সুখ, আজকের দুনিয়ায় ইতিহাস সৃষ্টিকারী ইতিহাসবিদ, ইতিহাসের দার্শনিক রণজিৎ গুহর আদি বাড়িও এই বাংলাদেশের বরিশালের সিদ্ধকাঠি গ্রামে।
চিন্তা ও সাহিত্যের সঙ্গে কিংবা ইতিহাসচর্চার সঙ্গেও তেমন দেশে ফেরার টান রয়ে যায় মনে হয়। জীবনানন্দ দাশ আমৃত্যু কলকাতাবাসী হলেও বরিশালের প্রকৃতির আবহের বাইরে যেতে পারেননি। পণ্ডিত ও ‘আত্মঘাতী বাঙালি’র লেখক নীরদ চন্দ্র চৌধুরীও কানাডার অন্টারিও হ্রদের সামনে দাঁড়িয়ে লিখতে বাধ্য হন, ‘প্রবাসে জল দেখিলে দেশের কথা মনে পড়ে।’ তাঁর আদি নিবাস কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায়। রণজিৎ গুহও এই ৭৬ বছর বয়সে তাঁর ছাত্র অধ্যাপক আহমেদ কামালের কাছে আক্ষেপ করেন, ‘বরিশালের নদীতে কয়েক মাস নৌকায় ঘোরার স্বপ্ন আজীবন লালন করে এসেছি, সেই স্বপ্নসাধ কি আর পূরণ হবে?’ তিনিও মাইকেল মধুসূদনের মতোই ঠিক করেছেন, শেষ বয়সে বাংলায় ছাড়া আর লিখবেন না। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দুটি বই, ‘কবির নাম ও সর্বনাম’ এবং ‘ছয় ঋতুর গান’। প্রথম বইটির জন্য ২০০৯ সালের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। আর এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ৪৫তম সমাবর্তনে তিনি পেলেন সম্মানের উপাধি।
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে ফুসফুসে ক্যানসার নিয়ে হয়তো বা মৃত্যুর দিকেই যাচ্ছেন বাংলার এই কৃতী সন্তান। মরার আগে আরও পাঁচ বছর বাঁচতে চান, যাতে বাংলায় আরও লিখতে পারেন, যাতে একবারের জন্য হলেও তাঁর জন্মভূমি বরিশালের নদীতে কয়েক মাস ঘুরে বেড়াতে পারেন। ভাবি, নিজ দেশের সত্যিকার ইতিহাস রচনার এই বিপুল সাধনা, জ্ঞানের সমুদ্রের মধ্যে এই ভেলা ভাসানো কি খুব গভীরভাবে দেশে ফেরারই যাত্রা? যে দেশের নাম বাংলাদেশ, যার একটি গ্রামের নাম সিদ্ধকাঠি আর যার এক দেশছাড়া সন্তানের নাম রণজিৎ গুহ।
প্রথম প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০০৯