জাফর আহমদ রাশেদ: বইপত্রে লেখা হয় আপনার জন্ম ১৯৩৬ সালে। কিন্তু আপনি একবার আমাদের বলেছিলেন আপনার জন্ম আসলে আরেকটু আগে।
আল মাহমুদ: ’৩৬ সালে আমার জন্ম—এখন এটাই গ্রাহ্য আর কি। কিন্তু আমার বয়স আরেকটু বেশিই। দু-তিন বছর বেশি হতে পারে।
রাশেদ: আমরা জানি, ১১ জুলাই আপনি ৭৯-তে পা রাখছেন। প্রকৃতপক্ষে আপনি ৮০ পেরিয়ে গেছেন।
আল মাহমুদ: এই দুনিয়ায় ৮০ পার হওয়া কি সোজা কথা?
আরবানিটির বাইরে আসলে সুখ নেই। আমি ওখানে ছিলাম। সত্যিকারের সুখ নেই ওখানে। তাই ওখানে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেও কখনো হয়নি।
রাশেদ: যে জীবন পার হয়ে এলেন, তা নিয়ে আপনার উপলব্ধির কথা বলুন।
আল মাহমুদ: আমার তো ভালোই লাগছে। উপলব্ধির কথা যদি বলো, হ্যাঁ, উপলব্ধি আছে। দীর্ঘদিন পার হয়ে আসলাম। আমি ছিলাম ভ্রমণবিলাসী, ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতাম। এ কারণে মনে হয়, বহু রোদ্দুর ঝরছে, কখনো তুষারপাত হচ্ছে; মনে হয় বরফের মধ্য দিয়ে হাঁটছি; হেঁটে চলেছি ফুটপাত দিয়ে। এই দৃশ্য আমি ভুলতে পারি না। কারণ, আমি অনেক দেখেছি তো। ‘জগৎ ভ্রমিয়া দেখলাম’ বলে একটা কথা আছে না? সারা দুনিয়া আমি ঘুরে দেখেছি। পায়ে হেঁটে পার হয়েছি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় শহরগুলো।
রাশেদ: কোন শহরটা আপনার সবচেয়ে ভালো লেগেছে?
আল মাহমুদ: এটা বললে তো সীমাবদ্ধ করা হয়ে যাবে। তবু তুমি যখন বলছ, আমার মনে হয়-পারি, অর্থাৎ প্যারিস সবচেয়ে ভালো লেগেছে।
রাশেদ: আপনার দেখা প্রথম বড় শহর ঢাকা। ঢাকায় এলেন ১৯৫৪ সালে। তখন ঢাকা কেমন ছিল?
আল মাহমুদ: বলা হতো বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির গোলকধাঁধা হলো ঢাকা শহর। আমি সব সময় শহরপ্রবণ মানুষ। একটা কথা আছে না, যদি পড়ে কহর (মানে পায়ে যদি কহর পড়ে যায়) তবু ছেড়ো না শহর।
রাশেদ: শহর ছাড়লে কী হয়?
আল মাহমুদ: শহর ছাড়লে সুখ নাই। আসলে সুখ হলো শহরে। এটা উপলব্ধি করতে হবে। এটা মুখের কথার বিষয় নয়।
রাশেদ: মফস্বলে বা গ্রামে যারা থাকে, তাদের জীবনে সুখ নেই?
আল মাহমুদ: আরবানিটির বাইরে আসলে সুখ নেই। আমি ওখানে ছিলাম। সত্যিকারের সুখ নেই ওখানে। তাই ওখানে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেও কখনো হয়নি।
দেখতে তো সুন্দর ছিল না শোভা, কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো ছিল। খুব আকর্ষণীয় ছিল। বই লেনদেনের মাধ্যমে পরিচয়। বই দিয়ে সই। আর বিশিদির সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলছ? সত্যি কথা বলতে কি, সে তো আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমি তাকে জোর করে ধাক্কা মেরে পালিয়ে এসেছিলাম।
রাশেদ: আপনি যখন ঢাকা শহরে আসেন, তখন প্রতিষ্ঠা পাওয়া আপনার জন্য সহজ ছিল না।
আল মাহমুদ: না, সহজ ছিল না। লড়াই করতে হয়েছে। কেউ কি কারও জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়? দেয় না। প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। লেখালেখি করতে হয়েছে। সমস্ত হৃদয়-প্রাণ উজাড় করে আমি লেখার চেষ্টা করেছি। লেখাই আমাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
রাশেদ: আপনারা যখন লিখতে এলেন, তখন বাংলা কবিতায় তিরিশের আধুনিকতার ছায়া...
আল মাহমুদ: তোমাকে যদি আমি প্রশ্ন করি, আধুনিকতার বয়স কত? ধরে নিলাম এক শ বছর। কিন্তু তার পরে! আধুনিকতার কী হবে? আধুনিকতা আর থাকছে না। তবে কী থাকছে? শুধু কবিতা। কবিতাই থাকবে। তাকে আর আধুনিক বলার দরকার নেই। আমরা যা চেয়েছিলাম, সাহিত্য-শিল্পে সেটা যেভাবেই হোক, কিছু এসেছে।
রাশেদ: আপনার কবিতায় কিন্তু গ্রামজীবন, লোকায়ত জীবন—এগুলো আছে।
আল মাহমুদ: গ্রামজীবন ঠিক নাই, তবে লোকজ উপাদান আছে।
রাশেদ: আপনার সমসাময়িক লেখকেরা এটাকে কীভাবে নিয়েছিলেন?
আল মাহমুদ: তারা মোটামুটি গ্রহণ করেছিল। এটা গ্রাহ্য হয়েছিল।
রাশেদ: কেউ কেউ আপনাকে গ্রাম্য বা গেঁয়ো বলে তাচ্ছিল্য করেছেন।
আল মাহমুদ: এরা যা চেয়েছিল তা তো তারা অর্জন করতে পারেনি। বরং আমি যেটা বলেছি, তার কিছু-না-কিছু সত্য প্রতিভাত হয়েছে।
রাশেদ: আপনার কবিতা-গল্পে একটা বড় বিষয় ছিল নারী ও প্রেম। প্রেম ও নারী নিয়ে আপনার অনুভবের কথা বলুন।
আল মাহমুদ: আমার কবিতায়-সাহিত্যে একটা নারীভাবনা আছে। নারী বলতে কিন্তু আমি রক্ত-মাংসের নারী বোঝাচ্ছি। নারী নাকি দশ হাত শাড়িতে ঢাকা পড়ে না। নারী বলতে আমি কামনা-বাসনা-যৌনতা—এসব মিলিয়েই বুঝিয়েছি। আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না।
রাশেদ: ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ আপনার আত্মজৈবনিক উপন্যাস। এই বইয়ের নারী চরিত্রগুলো খুব আকর্ষণ করে। এই বইয়ের নারী চরিত্রগুলো নিয়ে বলুন।
আল মাহমুদ: অনেক দিনের কথা তো। হ্যাঁ, এদের জন্য আমার মধ্যে একটা কাতরতা আছে।
রাশেদ: শোভার কথা মনে আছে, যে আগরতলা চলে গেল? বিশিদির কথা?
আল মাহমুদ: দেখতে তো সুন্দর ছিল না শোভা, কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো ছিল। খুব আকর্ষণীয় ছিল। বই লেনদেনের মাধ্যমে পরিচয়। বই দিয়ে সই। আর বিশিদির সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলছ? সত্যি কথা বলতে কি, সে তো আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমি তাকে জোর করে ধাক্কা মেরে পালিয়ে এসেছিলাম।
রাশেদ: কেন?
আল মাহমুদ: কারণ, সে যেটা চায়, আমার কেন যেন মনে হয়েছিল, ঠিক না এটা।
রাশেদ: পরে কখনো আপনার মনে হয়েছে যে পালিয়ে আসা ঠিক হয়নি?
আল মাহমুদ: এটা তো তুমি খুব খারাপ কথা বললে।
রাশেদ: ওই উপন্যাসে যেসব কথা বলেননি বা বলতে পারেননি, তার দু - একটা আমাদের বলুন।
আল মাহমুদ: কামের বাসনা যেটা, তার কথা তো আমি কোনো লজ্জা - শরম না রেখেই সাহিত্যে বলেছি। কামের প্রাবল্য মানুষকে মনুষ্যত্ব দেয়। কামবাসনা থাকতে হবে। সোজাসুজি বললে, এটা হলো যুক্ত হওয়ার বাসনা।
রাশেদ: ফেসবুকে আপনার একটা লেখা পড়েছি। সেখানে আপনি লিখেছেন, ‘নিজের কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে বিচার করতে গেলে আমাকে কিছুতেই আমি একজন ভালো লোক বলে মনে করতে পারি না।’ কেন?
আল মাহমুদ: নিজে যখন নিজের মধ্যে অন্ধকারটা দেখি, তখন কী করে বলব আমি ভালো মানুষ?
রাশেদ: সেই অন্ধকারটা কী?
আল মাহমুদ: সে তো অনেক বিষয়। সন্ধ্যা - ভোরে আলোর বিনয়, সবাই মিলে গান ধরেছ, প্রেমের মতো আর কিছু নয়।
রাশেদ: আরেকটু পরিষ্কার করুন।
আল মাহমুদ: আমার মধ্যে কামনা-বাসনা আছে। শারীরিক মিলনের আকাঙ্ক্ষা আছে। আমি তো আর ধোয়া তুলসীপাতা না। আসলে মানুষের যে কামনা, সোজা কথায় যে যৌন-আকাঙ্ক্ষা, সেটা যদি না থাকত, তাহলে জীবনটা হতো লবণ ছাড়া পান্তার মতো।
রাশেদ: পৃথিবী বদলে যায়। বিশ্বাসও বদলায়। আপনার বিশ্বাস কি বদলেছে?
আল মাহমুদ: না, যেকোনো কারণেই হোক, আমার বিশ্বাস বদলায়নি। আমার ভেতরে যে বিশ্বাস ছিল, তার ওপর আমি অনেক পড়াশোনা করেছি। মার্ক্সবাদ নিয়েও পড়াশোনা করেছি। কিন্তু আমার ভেতর থেকে একজন আমাকে সব সময়ই বলত, প্রে, মানে প্রার্থনা করো।
রাশেদ: আপনার ‘জেলগেটে দেখা’ কবিতার দুটো লাইন শোনাই, ‘আমি কতবার তোমাকে বলেছি, দেখো/ মুষ্টিভিক্ষায় দারিদ্র্য দূর হয় না।/ এর অন্য ব্যবস্থা দরকার, দরকার সামাজিক ন্যায়ের।’ আপনি কি কোনো বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলছেন?
আল মাহমুদ: মুষ্টিভিক্ষায় দারিদ্র্য দূর হয় না। সামাজিক ন্যায়ের দরকার। এখানে তো বোঝাই যাচ্ছে।
রাশেদ: ‘সামাজিক ন্যায়’ বলতে কী বুঝব? ‘আমাদের ধর্ম হোক সম্পদের সুষম বণ্টন’?
আল মাহমুদ: কথাটা আসলে ঠিকই বলেছ। সম্পদের সুষম বণ্টন লাগবে। আমার তা-ই মনে হয়।
রাশেদ: ১১ তারিখ আপনার জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে মৃত্যু বিষয়ে একটু কথা বলি। আপনার সাম্প্রতিক কালের কবিতায় মৃত্যু নিয়ে কিছু কথাবার্তা দেখতে পাচ্ছি।
আল মাহমুদ: দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃত্যুর চিন্তা করব, এ ব্যাপারটা আমার নেই। আমার কবিতায় আমি মৃত্যুর বর্ণনা দিয়েছি। কেউ কি মৃত্যু থেকে ফিরে আসছে? তো মৃত্যু কী, সেটা কীভাবে বলা যায়? মৃত্যু, সমাপ্তি-এসব বিষয় আমি কেয়ার করি না। এসব নিয়ে আমি একেবারেই উদ্বিগ্ন নই।
রাশেদ: আপনার একটা গল্প আছে ‘জলবেশ্যা’। গল্পটার মূল বিষয় নিয়ে ‘তরঙ্গিত প্রলোভন’ নামে একটা কবিতাও আছে ‘সোনালী কাবিন’- এ। এই কবিতা ও গল্পের অভিজ্ঞতা আপনার কোথায় হয়েছিল?
আল মাহমুদ: আমাদের গ্রামের ওই দিকে লালপুর নামে একটা জায়গা আছে। লালপুর বাজারে আমি এই দৃশ্য দেখেছি।
রাশেদ : ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবিতাটা শোনাই। শুনে কবিতাটা নিয়ে কিছু বলুন।
আল মাহমুদ: এটা তো আমার ধারণা, ভালো কবিতা। খুবই ভালো লেখা। কবিতাটা যখন লিখছিলাম, তখন হৃদয় উজাড় করে লিখেছিলাম। শোনাও।
[‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ শুনতে শুনতে আল মাহমুদ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তাঁর চোখ মুছে দেওয়া হলো। তারপর তিনি বললেন] দ্যাখো কবিতা কী করতে পারে। কবিতার সংক্রাম থেকে মানুষ আত্মরক্ষা করতে পারে না। আসলে আজকে আমি অনেক আবেগাকুল হয়ে আছি।
রাশেদ: এখন আপনি আছেন কেমন?
আল মাহমুদ: ততটা ভালো না। বয়স হয়ে গেছে তো। বয়সের একটা ভার আছে।
রাশেদ: আপনি তো এখনো গল্প-উপন্যাস-কবিতা—সবই লেখেন। কিন্তু নিজের হাতে তো লিখতে পারেন না। যখন লিখতে ইচ্ছে করে তখন কী করেন।
আল মাহমুদ: কেউ-না-কেউ থাকে। আমি বলি, ওরা লিখে নেয়।