কবরীকে নিয়ে উপন্যাস লেখার ভাবনা মাথায় এল কীভাবে?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের তারকাদের মধ্যে কবরীর জীবন সবচেয়ে বর্ণময়। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখেন। বলা যায়, তাঁর শৈশবও পুরোপুরি কাটেনি তখনো। মিনা পাল নামের চট্টগ্রামের এক কিশোরী কবরী হয়ে উঠলেন, পরিণত হলেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের একজন হিসেবে। এটা খুব সহজ কাজ নয় একজন মানুষের পক্ষে। সে সময় কবরী, মানে মিনা পালের বাবা মেয়েকে অভিনয় করতে পাঠিয়েছিলেন পরিবারের আয়–উপার্জন বাড়ানোর কথা ভেবে। অভিনয়ে আসার এক বছরের মধ্যে সেই কিশোরীর বিয়ে হয়ে গেল চল্লিশোর্ধ্ব পরিচালক চিত্ত চৌধুরীর সঙ্গে। এই অসম বিয়ের তিক্ততা বহন করেও হাসিমুখে অভিনয় চালিয়ে গেছেন কবরী। বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। প্রেমে জড়িয়েছেন জহির রায়হানের মতো বড় পরিচালকের সঙ্গে। বিষয়টা গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। তারপর আবার ধরুন, নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা প্রেম যা–ই বলি না কেন, তা–ও ছুঁয়ে গেল তাঁকে। এত কিছুর পরও বারবারই তিনি ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু ভেঙে পড়েননি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। জড়িয়েছেন রাজনীতিতে। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে শামীম ওসমানের মতো মাফিয়ার সঙ্গে লড়তে হয়েছে তাঁকে। নির্বাচনে তাঁর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে জয়লাভও করেছেন। সব মিলিয়ে এমন চরিত্র কোনো ঔপন্যাসিকের জন্য খুবই কৌতূহলের। কবরীকে নিয়ে একটা সার্থক উপন্যাস লিখতে চেয়েছি। আর তা ছাড়া, কবরী চট্টগ্রামের মেয়ে। তিনি যেখানে জন্মেছেন, বেড়ে উঠেছেন, সেসব জায়গা আমার চেনা। তাই সেসব তুলে আনা সহজ হয়েছে। তবে কতটুকু কী হয়েছে, তা পাঠকই বলবেন।
মুনির: নার্গিস, আশালতা, কবি ও রহস্যময়ী—এরপর আরও এক নারীর জীবনভিত্তিক উপন্যাস লিখলেন। পাঠক কেন এই উপন্যাস পড়তে চাইবেন?
বিশ্বজিৎ: এটি আমার ১৬ বা ১৭তম উপন্যাস। খেয়াল করলে দেখবেন, আমার সব উপন্যাসেই নারী একটা বড় অংশজুড়ে আছে। নার্গিস বা আশালতায়ও নারীর সংগ্রাম, বঞ্চনা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বিষয়টি এসেছে। মনে হয়েছে, মানবজীবনের সমগ্রতাকে ছুঁতে হলে নারীর পৃথিবীকে বুঝতে হবে। কবরীও সেই অর্থে আমাকে ভাবিয়ে তুলেছেন। আর যদি উপন্যাসের একটু ‘হিন্টস’ বা ‘সূত্র’ জানতে চান, তবে বলি, এখানে বাস্তবের চরিত্রের সঙ্গে অনেক কাল্পনিক চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে। আমি চেষ্টা করেছি, এটা যাতে কেবল ডকুমেন্টেশন বা প্রামাণ্য দলিল না হয়ে যায়। উপন্যাসে এক তরুণ সাংবাদিককে হাজির করা হয়েছে। তার সঙ্গে কবরীর একধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্কের সূত্র ধরে কাহিনি এগোয়।
সব জীবনভিত্তিক উপন্যাসেরই স্রেফ প্রামাণ্য দলিল হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। পাশাপাশি কাহিনির সত্যাসত্য তুলে ধরারও দায় থাকে। এই দুইয়ের ভেতর ভারসাম্য রক্ষা করা আসলেই কঠিন। তবে আমি দুই বছর ধরে এই উপন্যাস নিয়ে কাজ করছি। মৃত্যুর আগে কবরীর সঙ্গে সরাসরি কথাও বলেছি অনেকবার। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মুর্তজা বশীরের আত্মজীবনী পুরোটা পড়ে কবরী আর জহির রায়হান সম্পর্কে কেবল দুই লাইন তথ্য পেয়েছি। সেটুকুকে কাহিনি আকারে সাজিয়ে অনেক বিস্তৃত করতে হয়েছে। অনেক বিষয়ে কবরীর স্বজনদের হয়তো প্রশ্ন থাকবে। কিন্তু বুঝতে হবে যে এটা ‘ফিকশন’। আমাকে কবরীর মনের জগৎকেও উন্মোচন করতে হয়েছে। তাই এটা স্রেফ ডকুমেন্টেশন বা লিখিত জীবনী নয়।
মুনির: কবরীর চরিত্রের কিছু উজ্জ্বল দিক নিয়ে বলুন।
বিশ্বজিৎ: গ্ল্যামার আর খ্যাতির ভেতর থেকেও কবরী ছিলেন ব্যক্তিত্ববান ও প্রজ্ঞাময়ী। তিনি যখন সিনেমায় আসেন, তখন সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। পরে এসএসসি পাস করেছেন। কিন্তু লেখাপড়া ও জ্ঞানের সাধনার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল প্রবল। সেই সূত্রে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, খান আতাউর রহমানের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল তাঁর। এমন সামাজিক পরিসরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, যা তাঁর সমসাময়িক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে বিরল। ভেবে দেখুন, অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেও জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। কাজ করেছেন নারী অধিকার নিয়ে, রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন, দেশে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেরও আয়োজন করেছেন। সব মিলিয়ে কবরী এক অনন্য মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।
কবরীর সূত্রে এই উপন্যাসে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের ভেতরকার ছবি এসেছে কি?
বিশ্বজিৎ: পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সুবর্ণ যুগ ছিল বলা যায়। সে সময় চলচ্চিত্র নিয়ে মানুষের উন্মাদনারও কমতি ছিল না। একটা ঘটনার কথা বলি। একবার কবরীসহ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একটি দল যশোরে গেল শুটিংয়ে। সেখানে যে বাড়িতে শুটিং চলছিল, সে বাড়ির চারপাশে ভিড় জমে গিয়েছিল। এমনকি শুটিংয়ের সময় যে রাস্তায় কবরী হেঁটেছেন, পরে তার নাম হয়ে গিয়েছিল কবরী রোড। সব মিলিয়ে দেশের শিল্পজগতের এক বিশাল অধ্যায় ছিল সেটা।
কিন্তু আফসোসের বিষয়, চলচ্চিত্র অঙ্গনের এই ছবি এর আগে কোনো উপন্যাসে আসেনি। এই উপন্যাসে তা বিস্তৃত পরিসরেই এসেছে। এখানে অনেক অভিনেতা, অভিনেত্রী, পার্শ্বচরিত্র, পরিচালককে পাওয়া যাবে। পাঠক নতুন করে আবিষ্কার করবেন তাঁদের চেনা–জানা চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোকে।
সবচেয়ে বড় বিষয়, কবরী যখন খ্যাতির মধ্যগগনে, তখনই তাঁর ব্যক্তিজীবনে নানা বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি দাঁতে দাঁত চেপে সেসব সয়ে গেছেন। চোখের জল আড়াল করে হেসেছেন। ‘মিষ্টি মেয়ে কবরী’ বলে মানুষ তাঁকে জেনেছেন। কিন্তু এর আড়ালে যে অকথিত বেদনা, তা অনেকেই জানতেন না।
উপন্যাস
কবরী
বিশ্বজিৎ চৌধুরী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা