সেলিম মোরশেদের সাক্ষাৎকার

কাজটা যে ঠিক হয়নি, তা বোঝানোর জন্যই পুরস্কারটি নিইনি

চার দশক ধরে কেবল ছোট কাগজেই লিখে আসছেন সেলিম মোরশেদ। সম্প্রতি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়ে এক বিতর্কের জেরে তা আবার প্রত্যাখ্যানও করেছেন আশির দশকের এই শক্তিমান কথাসাহিত্যিক। ছোট কাগজ আন্দোলন আর নিজের লেখালেখি নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

আলতাফ শাহনেওয়াজ:

সদ্য সমাপ্ত বইমেলায় সেলিম মোরশেদের সাহিত্য সংগ্রহ নামে রচনাসংগ্রহের প্রথম খণ্ড বেরিয়েছে আপনার। লেখালেখির চার দশকে পৌঁছে এই রচনাসংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে পুরোনো লেখার দিকে তাকিয়ে কী মনে হয়েছে?

সেলিম মোরশেদ: রচনাসংগ্রহ বের করতে গিয়ে জলধি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী নাহিদা আশরাফী আমাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। আসলে এই কাজ করতে গিয়ে নিজের পুরোনো লেখার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছে, আজ থেকে ৪০ বছর আগে গল্প–উপন্যাসের মধ্যে রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি বা সংস্কৃতির যেসব প্রসঙ্গ আনতাম, তা এখনো প্রাসঙ্গিক। কোনো কিছুই মৌলিকভাবে পাল্টায়নি। অনেক আগে যেসব লেখা লিখেছিলাম, রাষ্ট্র বা সমাজকে, আমার চারপাশকে যেভাবে ভেবেছিলাম, এখনো তা-ই দেখতে পাচ্ছি।

সেলিম মোরশেদের সাহিত্য সংগ্রহ
আলতাফ শাহনেওয়াজ:

০ বছর আগের রাজনীতি বা সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন, এটি দিয়ে কী বোঝাতে চাচ্ছেন?

সেলিম: তখন আমরা যাঁরা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, প্রায় সবার মধ্যেই নতুন কিছু তৈরির একটা তাগিদ ছিল। প্রচলিত গণমাধ্যমের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছোট কাগজ আন্দোলন, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলন, নতুন ধারার চিত্রকলার আন্দোলন—এসব আরকি। মানে সবকিছুতেই বিকল্প খোঁজার চেষ্টা। লেখালেখির ক্ষেত্রে তপন বড়ুয়া, সাজ্জাদ শরিফ, আহমেদ নকীব, মাসুমুল আলম; চলচ্চিত্রে মোরশেদুল ইসলাম, জাহেদুর রহিম অঞ্জন; চিত্রকলায় ঢালী আল মামুন বা শিশির ভট্টাচার্য্য—যাঁর যাঁর মাধ্যমে আমরা নতুন কিছু সৃষ্টি করতে চাইছিলাম। যে কারণে আমি বলি যে আমাদের সময়টা শুধু ছোট কাগজ আন্দোলনের কাল নয়। 

সে সময় আমি রাজনৈতিকভাবে বেশ সচেতন ছিলাম, আমার মধ্যে বিকল্প চিন্তাগুলো বেড়ে উঠেছিল। তাই ঢাকায় এসে আমার দেখাটা ছিল মূলত মূলধারার বাইরে থেকে। সব সময়ই মনে হয়েছে, লেখালেখি মানে সমাজের একধরনের সমালোচনা। আমার লেখার মধ্যে বাঙালি মুসলমানের ডিসকোর্স হাজির হয়েছে। এটি কী হতে পারে, তা আমার সাপলুডু খেলা উপন্যাসে আছে। বাঙালি ডিসকোর্সের প্রধান ধারায় বাঙালি মুসলমানকে চিত্রিত করা হয়েছে ‘কালচারালি মাইনোরিটি’ হিসেবে। তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’রা একপেশে ডিসকোর্স তৈরি করেছেন। বাঙালিত্বের একপেশে ডিসকোর্সকে তারা যখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে লাগল, তখন আরেক দল মানুষ এর থেকে বিযুক্ত বোধ করতে শুরু করল। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সবাই-ই বিভাজনের চক্রেই বন্দী থেকেছে।

আলতাফ শাহনেওয়াজ:

ড় কাগজে না লিখে সব সময় ছোট কাগজে লিখলেন কেন? 

সেলিম: বড় কাগজে লেখার বিষয়টা সেভাবে আমাদের মধ্যে ছিল না। প্রথম থেকেই চাওয়া ছিল আলাদা কিছু করব। গেল শতকের মধ্য আশিতে এটা প্রথম শুরু হয়েছিল কবি সাজ্জাদ শরিফের হাত ধরে, ছোট কাগজ গাণ্ডীব-এর মাধ্যমে। আশির দশকের কবিরা একটা ইশতেহার দিয়ে বললেন যে কবিতাকে আমরা এভাবে দেখতে চাই। তখন একটা যুগ তৈরি হলো বলা যায়। এটা মোটেও সংকীর্ণ ছিল না।

তো এরপর আমরা যখন দীর্ঘদিন এই চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম, সে সময় প্রশ্ন উঠেছিল, কেন আমরা বড় কাগজে লিখছি না। জনে জনে উত্তরটা দেওয়া গেল না বলে আমি পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনো শুয়োরের গোঁ নামে মূলধারার গণমাধ্যমের সংকট নিয়ে একটা বই লিখলাম। মূলত তখন যে ধরনের লেখালেখি হচ্ছিল, এর বাইরে গিয়ে আমরা নতুন কিছু লিখতে চেয়েছিলাম।

নিজের কথা বললে, আমার তখন বিষয়বস্তু আর প্রকরণগত দেখাটা ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। দেখা ভিন্ন হলে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি আর কাঠামোর মধ্যে তাকে আঁটানো কঠিন হয়। ফলে আমাদের সিনট্যাক্স, ফর্ম, দেখা—এগুলোর সঙ্গে অন্যদের বড় ব্যবধান তৈরি হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এসব কারণে বড় কাগজ বা মূলধারার গণমাধ্যমে আর লেখা হয়ে ওঠেনি। ছোট কাগজকেই যথাযথ স্থান বলে মনে হয়েছিল। তবে একেবারে আদাজল খেয়ে, ঘোষণা দিয়ে চিরকালের জন্য লিখব না, এমনও নয়। মনে হয়েছিল, মূলধারার গণমাধ্যম আমাকে নিতে পারবে না, আমিও তাদের খোরাক দিতে পারব না। 

আলতাফ শাহনেওয়াজ:

পনার লেখার মধ্যে এমন কী বিষয় আছে, যার জন্য মনে হয়েছে, মূলধারার গণমাধ্যম আপনাকে নিতে পারবে না। 

সেলিম: একধরনের শিল্প আছে যা পাঠককে কেবল বিনোদনই জোগায়। আবার শিল্পেরই আরেকটা অংশ আছে, যার নাম ‘এসথেটিক প্লেজার’ বা নান্দনিক আনন্দ। নিজের লেখাকে আমি কেবল পাঠককে বিনোদিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে লিখতে পারিনি। আমার লেখায় প্রবলভাবে চিন্তা হাজির থাকে, চরিত্র চিত্রণের মধ্যে থাকে বিষণ্নতার আবহ। ব্যতিক্রমটা হলো, অন্যদের একটা পেশা আছে। কিন্তু এ জীবনে থিতু হয়ে আমি কোনো চাকরি করতে পারিনি। ফলে লেখালেখিই আমার কাছে একমাত্র কাজ, কোনো দ্বিতীয় বিকল্প নয়। 

আলতাফ শাহনেওয়াজ:

মাদের যাঁরা বড় কাগজে লিখেছেন, ধরা যাক, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, তাঁদের মধ্যে কি এসব ছিল না?

সেলিম: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিন্তু বড় কাগজে খুব বেশি লেখেননি। সৈয়দ শামসুল হকই সে অর্থে বড় কাগজ আর ছোট কাগজে ভারসাম্য রেখেছেন, অনেকাংশে হাসান আজিজুল হকও তা–ই। একজন লেখককে নানান ধারায় কাজ করতে হয়, সৈয়দ হক বিচিত্র ধারায় কাজ করেছেন। এ ছাড়া আর যাঁরা, এমনকি আমাদের সমসাময়িক অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখক আছেন, যাঁরা বড় কাগজে লিখেছেন, লিখছেন। আসলে সবারই নিজস্ব পথ থাকে। আমারও আছে। যে যেভাবে এবং যে পরিসরে কথা বলতে চায় সেভাবেই তা করবে। আমি আমার যে কথাটা বলতে চাই, বড় কাগজে সেটা পারব না। হয়তো সে জন্যই বড় কাগজে লিখিনি। একজন লেখক তো বলার ভাষাটাই আজীবন খুঁজে বেড়ান। জনরুচির কাছে যে ভাষাটা নিয়ে যেতে হয়, আমি নিজে সেই ভাষায় লিখতে চাই না কিংবা হয়তো পারিও না।

সেলিম মোরশেদ
ছবি: কবির হোসেন
আলতাফ শাহনেওয়াজ:

ছোট কাগজে যখন লিখতে শুরু করেছেন, সেই সময়ে এবং তার অনেক পরেও, আমাদের দেশে যখন কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠীর মতো সাহিত্যের শক্তিশালী কোনো প্রতিষ্ঠানই গড়ে ওঠেনি, তখন আপনার কেন মনে হয়েছিল যে বড় কাগজ জনরুচিকেই প্রাধান্য দেয়?

সেলিম: বাস্তবতা হলো, তখন সেই প্রতিষ্ঠান হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল। সেভাবে প্রভাবশালী না হওয়ার পরও সত্যিকার অর্থে মূলধারার প্রতিটি গণমাধ্যমই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। আমার একটা গল্প আছে ‘সখীচান’ নামে। সখীচান হলো ডোম গোত্রের। নিজের চেষ্টায় সে তার শ্রেণি উত্তরণ ঘটাতে চেয়েছে। পারেনি। একইভাবে ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ গল্পে পুলিশ বা রাষ্ট্রকাঠামো যারা এই গল্পের হেমাঙ্গিনীর মতো চরিত্রকে তৈরি করেছে, তারা তাকে সাপ খেতে বাধ্য করেছে। এসব লেখার পর আধিপত্যের মধ্যে থাকা গণমাধ্যমে এগুলো আমি কীভাবে ছাপতে দিই? বিষয়টা আমাকে একটা নৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেয়।

পশ্চিমবঙ্গের মফস্​সলের একজন লেখক কলকাতায় না গিয়েও দিব্যি লেখক হয়ে উঠতে পারেন ছোট কাগজের শক্তির জোরে। আমাদের এখানে অবস্থাটা উল্টো। এখানে ছোট কাগজগুলো কোনোরকমে নিশ্বাস নিয়ে টিকে আছে। 

আলতাফ শাহনেওয়াজ:

সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ছোট কাগজ আন্দোলন ঠিকমতো বিকশিত হতে পারল না কেন?

সেলিম: পশ্চিম বাংলার সঙ্গে আমাদের একটা তফাত হলো, তারা আনন্দবাজার পত্রিকাদেশ নিয়ে সংস্কৃতিক লড়াইয়ে বেশি লিপ্ত। আর আমাদের এখানে বড় বা ছোট কাগজ—দুই কাগজের ভেতরেই দেখেছি, কোথায় যেন তারা নিজেরাই একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ধারক হয়ে ওঠে। বিশেষত বিগত বছরগুলোয় বেশির ভাগ ছোট কাগজও গত সরকারের বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানই বিশ্বাস ও ধারণ করে গেছে। আমাদের এখানে এই এক জায়গায় বড় কাগজ আর ছোট কাগজের মধ্যে বিস্ময়কর মিল। তবে আমি ছোট কাগজকে দেখতে চাই গণমানুষের পক্ষে রাজনৈতিক সক্রিয়তার জায়গা থেকে। আসলে ছোট কাগজ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আজীবন আমি সাহিত্যের একটা সমাজ বানাতে চেয়েছি।

আলতাফ শাহনেওয়াজ:

আপনার লেখালেখির শুরুর কথা জানতে চাই।

সেলিম: আমার লেখালেখির শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। গণমুক্তি নামে একটা পত্রিকায় ১৭ বছর বয়সেই লিখতে শুরু করেছিলাম। সাহিত্যে আসার পেছনে পরিবারের একটা ভূমিকা ছিল। আমার বড় বোন গান করতেন, খুলনা বেতারের শিল্পী ছিলেন। সে সময় তাঁকে কয়েকটি গান লিখে দিয়েছিলাম। লিখেছিলাম কিছু কবিতা আর ছড়াও। তবে কীভাবে গল্প লিখতে শুরু করলাম, আজ আর মনে নেই। 

যশোরে যখন আমি ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, তখন শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম কবি আজিজুল হককে। পঞ্চাশের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি তিনি। স্যার আমাকে বললেন, বাংলাদেশে এমন একজন লেখক ও সম্পাদক আছেন, যাঁর হাত দিয়ে যদি কারও গল্প ছাপা হয়, সে লেখক হয়ে ওঠে; তিনি হলেন দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীব। স্যারের কথা শুনে আমি তাঁকে যশোর থেকে ডাকে একটা গল্প পাঠালাম। সেটা ছাপা হলো। এরপর সচিত্র সন্ধানীতে আরেকটা গল্প। বড় কাগজে লেখা বলতে এটুকুই। 

আলতাফ শাহনেওয়াজ:

বললেন, থিতু হয়ে কোনো চাকরি করেননি। জীবিকা নির্বাহের জন্য তবে কী কী করেছেন?

সেলিম: ইন্টারমিডিয়েট শেষে যশোর থেকে ঢাকায় আসার পর ভিডিও গাইড নামে একটা পত্রিকায় ফিচার সম্পাদক হিসেবে চাকরি করেছিলাম। পরে এই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হলাম। এর পরে বর্তমান দৈনিক নামে একটা পত্রিকা বের করতাম। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে ছিল অফিস। এই পত্রিকায় কাজের সময় আহমদ ছফার সঙ্গে দারুণ কিছু স্মৃতি আছে আমার। আজিজ মার্কেটে আমি আর ছফা ভাই পাশাপাশি বসতাম, দুজনে একই টেলিফোন ব্যবহার করতাম। এ সময় একদিন তাঁকে বলেছিলাম, আপনি উত্তরকে দক্ষিণ করতে পারেন। কথা শুনে ছফা ভাই বললেন, ‘আমি উত্তরকে কেবল উত্তরই করতে পারি, ১৯৭১ যেমন একাত্তরই।’ ওই পত্রিকাও বন্ধ হয়ে গেল। তারপর অনেক জায়গায়ই কাজ করেছি। একপর্যায়ে যশোরে নিজের বাড়িঘরও বিক্রি করে দিয়েছি। এখন একচিলতে থাকার জায়গা আছে শুধু।

আলতাফ শাহনেওয়াজ:

আপনার ছেলে সঞ্চয় প্রথম ছিলেন শূন্য দশকের সম্ভাবনাময় কবি। ২০০৩ সালে হঠাৎ মারা যান। 

সেলিম: সঞ্চয় মারা গিয়ে আমাকেই আসলে মেরে গেছে। আমার জীবনে অসংখ্য এলোমেলো ব্যাপার আছে। আমি বিশৃঙ্খল, তবে উচ্ছৃঙ্খল নই। জীবনের প্রতি সত্যিই আমার আর কোনো টান নেই। কোনোমতে জীবনটা টেনে নিচ্ছি, এটুকুই। লেখা ছাড়া জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই আর কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। এখন কিছুতেই কিছু যায়-আসে না আমার।

আলতাফ শাহনেওয়াজ:

কথাসাহিত্যে এ বছর বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এরপর অন্য দুজনের পুরস্কার নিয়ে বিতর্কের জেরে ঘোষণা দিয়ে পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থানে থেকে বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানের তরফে পুরস্কার পাওয়া, কেমন বোধ হয়েছিল? 

সেলিম: আমি তখন যশোর শহরের বাড়িতে। কবি নান্নু মাহমুদের সঙ্গে আলাপ করতে করতে গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। ফোন ছিল বন্ধ। সন্ধ্যার পর শহরে ফিরে ফোন খুলতেই খবরটা পাই। দেখলাম, যশোরের শিল্পী-সাহিত্যিকেরা খুব খুশি। প্রতিশিল্প ছোট কাগজের সম্পাদক মারুফুল আলমসহ অনেকেই ওই সন্ধ্যায় এলেন ফুল নিয়ে। সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছেন। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি তখনো। সত্যি বলতে, পুরস্কারের তালিকা দেখে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠান না অপ্রতিষ্ঠান, প্রথমে এসব মনে হয়নি। মনে হয়েছিল, গত ৪০ বছরে পুরস্কারের এত ভালো তালিকা আর দেখিনি। 

কিন্তু সেটা নিয়েও যখন কথা উঠল, তখন আমার মনে একটা জিনিসই চলছিল যে এখানে ভয়ংকর বিপজ্জনক রাজনীতি চলছে, যাঁরাই বিতর্ক তুললেন আরকি। যদিও আমাকে নিয়ে কথা ওঠেনি, তাতে কী? যে বিচারকমণ্ডলী আমাকে মর্যাদা দিলেন, তাঁদেরই যদি প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়, তাহলে আমার মর্যাদা আর থাকল কোথায়! তখন মনে হলো, ভবিষ্যতে আমাকে কথা বলতে হবে। এটা গ্রহণ করলে কথা বলা যাবে না। কাজটা যে ঠিক হয়নি, তা বোঝাতে গেলে আমার প্রধান কাজ হবে এ পুরস্কার অস্বীকার করা। সবাই বলেছে, দুটো দিন অপেক্ষা করেন। আমি করিনি।

সেলিম মোরশেদ
ছবি: কবির হোসেন
আলতাফ শাহনেওয়াজ:

রচনাসংগ্রহ বেরোল। লেখালেখি নিয়ে সামনের দিনগুলোয় আপনার পরিকল্পনা কী? 

সেলিম: মাথায় যে লেখাগুলো রয়েছে, সেগুলো শেষ করতে পারাটাই এখন আমার কাছে জরুরি। দীর্ঘ একটা উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা আছে।

আলতাফ শাহনেওয়াজ:

বর্তমানে ছোট কাগজ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

সেলিম: সারা দুনিয়ায় ছোট কাগজ দুটি কারণে হয়। এক হলো সাম্যবাদী আন্দোলন যখন মুখ থুবড়ে পড়ে, সে সময় যে কথাগুলো বলার থাকে, তা ধারণ করে ছোট কাগজ গড়ে ওঠে। আর যখন পৃথিবীর সব মূল্যবোধের ক্ষতি হয়, তৈরি হয় অবিশ্বাস, তখন আরেক রকম ছোট কাগজ গড়ে ওঠে।

অনেক সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে ছোট কাগজের একটা সম্পর্ক গড়া উচিত ছিল; আগামীর দিনগুলোয় যা এমনিই হয়ে যাবে। কিন্তু ছোট কাগজের সম্ভাবনা তো বন্ধ হয়নি। এখন মানুষের দেখা ও জানার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। একসময় এটা যৌক্তিক পর্যায়ে আসবে। আর এই জায়গায়ই আমি ছোট কাগজের সম্ভাবনা দেখতে পাই। তবে রাজনীতির বিকল্প ধারা গড়ে না উঠলে বিকল্প সাহিত্যও যে হবে না, সে কথাও সত্য।