চীনা অনুবাদক দং ইউ ছেনের সাক্ষাৎকার

‘বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ আছে চীনের’

চীনা ভাষায় রবীন্দ্র–রচনাবলীর অনুবাদক দং ইউ ছেন। বেইজিং ফরেন ইউনির্ভাসিটির সেন্টার ফর সাউথ এশিয়া স্টাডিজের সাবেক অধ্যাপক তিনি। এখন কাজ করছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী নিয়ে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট পাওয়া এই অনুবাদক সম্প্রতি এসেছিলেন বাংলাদেশে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম:

বাংলা ভাষাকে আপনি চীনের মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্র–রচনাবলী অনুবাদ করেছেন চীনা ভাষায়। কীভাবে এই অনুবাদের কাজে যুক্ত হলেন?

দং ইউ ছেন: সরকারি বৃত্তি নিয়ে গত শতকের ষাটের দশকে লেনিনগ্রাদে পড়তে গিয়েছিলাম প্রাচ্যবিদ্যা বিভাগে। সেখানেই আমার বাংলা শেখার শুরু। তবে এরও আগে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুতোষ রচনা পড়েছিলাম রুশ ভাষায়। মূলত তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের লেখা আমাকে মুগ্ধ করত। সেই মুগ্ধতা এখনো সমানভাবে রয়েছে। বলা যায়, যেন তাঁকে নিবিড়ভাবে জানতে গিয়েই আরও বেশি বাংলার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তবে এই প্রক্রিয়া বিভিন্ন ধাপে ঘটেছে।

আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাষার প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে শেখান। চীনের সরকারি গণপ্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত ১৮ খণ্ডের রবীন্দ্র–রচনাবলীর প্রধান সম্পাদক ছিলাম আমি। চীনের গণপ্রকাশনালয়ের প্রধান সম্পাদক আমাকে খুঁজে বের করে এই কাজের সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মোট ১৫ জন অনুবাদক মিলে প্রায় সাত বছর ধরে অনুবাদের কাজ সম্পন্ন হয়েছিল ২০১৫ সালে। চীনের মানুষ এখন চীনা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পড়তে পারছেন। এতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চীন দেশের মানুষের আরও আপন হয়েছেন বলে আমি মনে করি।

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম:

চীনা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের কাজ আগেও অনূদিত হয়েছে। এত বিপুল পরিসরে আবার রবীন্দ্র–রচনাবলী অনুবাদের কথা কেন ভেবেছিলেন?

দং ইউ ছেন: দেখুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে কাজগুলো চীন দেশে অনূদিত হয়েছে, সেগুলো সরাসরি বাংলা থেকে নয়। রুশ ভাষা অথবা হিন্দি থেকে চীনা ভাষায় অনূদিত। এর ফলে কী হচ্ছে, সাহিত্যকর্মটি যখন আরেকটি ভাষা হয়ে ঘুরে চীনা ভাষায় অনূদিত হচ্ছে, তখন সেই সাহিত্যের মূলের সঙ্গে পাঠকের আরও দূরত্ব বাড়ছে। যেহেতু আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজ নিয়ে প্রভাবিত এবং বাংলা জানি, তাই মনে হয়েছে, এত বড় মাপের সাহিত্যিকের কাজ সরাসরি তাঁর লেখা ভাষা থেকেই চীনা ভাষায় অনুবাদ করা প্রয়োজন। তাঁর নৌকাডুবি আমার প্রিয় উপন্যাস।

এটা ঠিক যে আগেও সরাসরি বাংলা থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদ হয়েছে কিছু কিছু। একজন দীর্ঘদিন শান্তিনিকেতনে থেকে বাংলা শিখেছিলেন। তিনি ভালো অনুবাদ করেছিলেন। তবে সে কাজে সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যাবে না। একটি উপন্যাস অথবা কয়েকটি ছোটগল্পে অনুবাদ হয়েছে। এ জন্যই মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।

 রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে চাইলে, অনুভব করতে চাইলে তাঁর রচনাবলি পড়া জরুরি। তাই এই রচনাবলি চীনা ভাষায় অনুবাদের জন্য আমার নিজেরও ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিল যথেষ্ট। পাঠকের হাতে যখন তুলে দিতে পেরেছি, সে সময়ের আনন্দ বলে বোঝানো যাবে না।

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম:

রবীন্দ্র–রচনাবলী নিয়ে কাজ করার সময় বাংলাদেশের অনুবাদকদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা নিতে হয়েছিল?

দং ইউ ছেন: প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো সহযোগিতা নিতে হয়নি। এটা চীন সরকার তাঁর গণপ্রকাশনালয় থেকে প্রকাশ করেছিল। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেকেই সহযোগিতা করেছিলেন বাংলাদেশের। তাঁদের মধ্যে বাংলা একাডেমির তখনকার মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সহযোগিতার কথা উল্লেখ করতেই হবে। তিনি বিভিন্ন বইপত্র দিয়েছেন আমাদের বিভিন্ন সময়ে।  

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম:

চীন–বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে সাহিত্য কীভাবে সেতুবন্ধন রচনা করতে পারে? বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিনিময় নিয়ে চীন সরকার কিছু ভাবছে কি?

দং ইউ ছেন: চীন আর বাংলাদেশের মধ্যে সাহিত্যের দিক থেকে যোগাযোগ খুব কম। দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সংস্কৃতিগত ভাববিনিময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে চীনের পরিকল্পনাও আছে মনে হয়। বাংলাদেশে নিয়োজিত চীনা রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারে আগ্রহী মনে হয়েছে। আমাকে তেমনই বলেছেন। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ, ভালো লেখা চীনা ভাষায় অনূদিত হওয়া প্রয়োজন এমন প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন রাষ্ট্রদূত।  সম্পর্কোন্নয়নে দুই দেশের উল্লেখযোগ্য লেখকদের কাজ দুই ভাষাতেই অনুবাদ হতে হবে বলে আমি মনে করি।  

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম:

বাংলা ভাষার আর কোন কোন সাহিত্যিকের কাজ নিয়ে আপনার আগ্রহ আছে? এরপর কী অনুবাদ করবেন?    

দং ইউ ছেন: শরৎচন্দ্র অনেক পড়েছি। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আমার খুব প্রিয়। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় বাংলা ছাড়াও আরবি ও ফারসি শব্দ আছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ‘সংস্কৃত’ শব্দ পাওয়া যায়। আমি রুশ ভাষা জানি; কিন্তু এই শব্দগুলো তো বুঝতে পারি না। তখন অভিধানের সহযোগিতা নিয়ে পড়ি।

আমার এক বন্ধু নজরুল ইসলামের কবিতা দুই খণ্ডে চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছিল। আমি আপনাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১০০টি কবিতা চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছি। তবে এখনো প্রকাশিত হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কয়েকটি উপন্যাস অনুবাদ করেছি। 

এরপর রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জি নিয়ে কাজ করব। যেমন কোন কোন সময় রবীন্দ্রনাথের বড় বড় উল্লেখযোগ্য কাজ কী হয়েছে অথবা তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কী ঘটেছে, সেসব তালিকা নিয়ে এই বর্ষপঞ্জি। সেটা বাংলা থেকে চীনা ভাষায় লিখব। এবার নজরুল ইসলামের ওপর বেশ কিছু বই কিনলাম বাংলাদেশ থেকে। আমি নজরুলের জীবনী নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী।

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম:

এবারের বাংলাদেশ সফরের কারণ কী?

দং ইউ ছেন: একেবারেই ব্যক্তিগত ভ্রমণ। ২০০৮ থেকে এই ২০২৫ সালের মধ্যে আমি এবার দিয়ে নবমবার বাংলাদেশে এলাম। এবারের বইমেলায় অ্যাডর্ন পাবলিকেশনস থেকে কনফুসিয়াসের কথোপকথন নামে অনুবাদের বই প্রকাশিত হয়েছে। বইমেলার জন্যই আসা।

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম:

হ্যাঁ, আপনাদের যৌথ অনুবাদের বই। একই বিষয়ে বাংলাদেশে আগেও অনেক বই হয়েছে। এ বিষয়টিই কেন বেছে নিলেন?

দং ইউ ছেন: কনফুসিয়াসের দর্শন সব সময় সমকালীন। তিনি কখনো পুরোনো হন না। তরুণ প্রজন্মের কাছে কনফুসিয়াসের ভাবনা পৌঁছে দিতে চেয়েছি। কাজটি আমার কাছে জরুরি বলে মনে হয়েছে।

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম:

বাংলাদেশের কোথায় কোথায় গেলেন?

দং ইউ ছেন: এবার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। কুয়াকাটায় সমুদ্র দেখলাম আর চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম অনেক পুরোনো শহর দেখতে। টাঙ্গাইলের দিকে একটা গ্রামে গিয়ে খুব ভালো লেগেছে।

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম:

বাংলাদেশের কনফুসিয়াস সেন্টারে গিয়েছিলেন। রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও দুটি সেন্টার চালু হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে।

দং ইউ ছেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফুসিয়াস সেন্টারে গিয়েছিলাম। আমিও শুনেছি দুটি সেন্টার হতে পারে। তবে আমি একেবারেই ব্যক্তিগত ভ্রমণে পর্যটক হিসেবে এসেছি এবার। আমার বই প্রকাশিত হয়েছে।

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম:

এরপর বাংলাদেশে কবে আসবেন?

দং ইউ ছেন: চাং ছ্যুং মিন নামে  আমার একজন বন্ধুর কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা মূল ৪৬টিসহ অনেকগুলো ছবি আছে। ছবিগুলো নিয়ে প্রদর্শনী হওয়ার কথা আছে। আমার বন্ধুর ইচ্ছা, প্রদর্শনী বাংলাদেশে হোক। দুই বছর আগে ছবিগুলো নিয়ে চীনে একবার প্রদর্শনী হয়েছিল। তখন সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। এই প্রদর্শনী বাংলাদেশে আয়োজন করা সম্ভব হলে আমি হয়তো অল্প সময়ের মধ্যেই আবার আসব।  

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম:

বাংলাদেশ–চীন সম্পর্ক ভবিষ্যতে কেমন হবে বলে মনে হয়?

দং ইউ ছেন: আমার মনে হয়, দুই দেশের সম্পর্ক সামনে আরও অনেক ভালো হবে। সাংস্কৃতিক সৌহার্দ্য বাড়বে।