সংকীর্ণ হতে হতে বাংলা সাহিত্য এখন কোথায় যে গেছে

মোহাম্মদ রফিকের এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর তাঁর ৭৫তম জন্মদিনে, কবির উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের বাসায়। সেদিন নিজের কবিতার যাত্রাপথ ও সাহিত্য নিয়ে খোলামেলা অনেক কথা বলেছিলেন তিনি। অপ্রকাশিত এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শিমুল সালাহ্উদ্দিন

মোহাম্মদ রফিক। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
প্রশ্ন:

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আমাদের কীর্তিনাশা, গাওদিয়া, কপিলার কবির আজ ৭৫তম জন্মদিন, স্যার। আপনার গুণগ্রাহীরা এসেছেন। সব মিলিয়ে কেমন আছেন?

রফিক: এই তো ভালো, তুমি বইয়ের নাম বলতে গিয়ে, এ কোন বেহুলার নাম বললে না কেন?

প্রশ্ন:

শিমুল: ওহ স্যার! এ কোন বেহুলার নাম অবশ্যই বলা উচিত ছিল।

রফিক: শোনো, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ চারটে বই যদি ধরো, তাহলে সেগুলো হলো—কীর্তিনাশা, কপিলা, নোনাঝাউ আর এ কোন বেহুলা।

প্রশ্ন:

শিমুল: এই তালিকায় মানব পদাবলি রাখবেন না?

রফিক: মানব পদাবলি আছে আরকি! তারপর আছে ধরো, মেঘে এবং কাদায় আছে।

প্রশ্ন:

শিমুল: আর রূপকথা কিংবদন্তি?

রফিক: রূপকথা কিংবদন্তি এখন আর আমার অত ভালো লাগে না, কিন্তু গাওদিয়া আছে, ওহ, মৎস্যগন্ধাও আছে।

মনে হলো, আমার একটা আর্কিটাইপ দরকার; কারা বাঙালি আর্কিটাইপাল, তাদের দরকার। তখন আমার ভেতর ধীরে ধীরে বেহুলা, মহুয়া—এসব চরিত্র কাজ করতে শুরু করেছে।
—মোহাম্মদ রফিক
প্রশ্ন:

শিমুল: তো স্যার, আজ আপনি নটআউট সেভেনটি ফাইভ। সেঞ্চুরি হবে আশা করি।

রফিক: তা হবে না।

প্রশ্ন:

শিমুল: ষাটের দশকে যে স্বপ্ন নিয়ে আপনারা লেখা শুরু করেছিলেন, তখন আসলে কী চিন্তা নিয়ে শুরুটা হয়েছিল?

রফিক: যখন আমরা শুরু করি, তখন একধরনের বিচ্ছিন্ন মানসিকতা কাজ করেছে আমাদের মধ্যে, একেকজন একেক রকমের চিন্তাভাবনা করেছে, তখন পর্যন্ত কবিরা সবাই রবীন্দ্রবেষ্টিত, তার মধ্যে যতটা আলাদা হওয়া যায়। বিষয়টা আমার বৈশাখী পূর্ণিমা পড়লেই বুঝতে পারা যাবে। আমাদের মধ্যে মূল পরিবর্তনটা করেছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে পুরো পাল্টে দিয়েছে। আমার ক্ষেত্রে অন্তত পাল্টেছে। যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার পর হঠাৎই আমার ভেতরে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হলো। আমি তখন আমার ছেলেবেলা, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি—এসব নিয়ে ভাবতে থাকলাম।

ষাটের দশকে আমি যত না লেখালেখির লোক ছিলাম, তার চেয়ে বেশি ছিলাম রাজনীতির লোক। এটা করে এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম, যেটাকে তুমি বলতে পারো সংকট। আমার বাবাও খুব বড় চাকরি করতেন না। সুতরাং টাকাপয়সার একটা ভীষণ সংকট দেখা দিল। কিছু একটা করতে হবে। সে সময় আমি একটা চাকরি নিলাম, সেটা একটা ব্যাংকে, আজ যেটা সোনালী ব্যাংক, সেখানে—ওয়াপদা শাখায়। কিন্তু আমার পক্ষে কি চাকরি করা সম্ভব ব্যাংকে! খুব বেশি দিন সম্ভব হয়নি। মাস ছয়েক পরে ভাগলাম। তুমি যদি সেই সময়ে লেখা আমার ধুলোর সংসারে এই মাটি পড়ো, বুঝবে, বৈশাখী পূর্ণিমা থেকে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। এটা আমার মানসিক পরিবর্তন, অস্তিত্বের পরিবর্তন। একসময় আমার মধ্যে যে প্রতীতি হলো যে বাংলাদেশের মানুষকে বুঝতে হলে আসলে নদীকে বুঝতে হবে, এটাই এ দেশের মানুষের লাইফলাইন। এ কারণে এখানে নদীই জনজীবন তৈরি করে, নদীই ভাঙে। মানে নদীই মূল ব্যাপার। কিন্তু নদী নদী করলে তো শুধু চলবে না, মানুষকে আনতে হবে। তুমি দেখবে যে আমার কীর্তিনাশায় বিভিন্ন মানবচরিত্র ঢুকে গেছে—পতিতা, তাঁদের প্রেম থেকে শুরু করে নানা পেশার জনমানুষ। কিন্তু তখন আমার মনে হলো, আমার একটা আর্কিটাইপ দরকার; কারা বাঙালি আর্কিটাইপাল, তাদের দরকার। তখন আমার ভেতর ধীরে ধীরে বেহুলা, মহুয়া—এসব চরিত্র কাজ করতে শুরু করেছে। এসব তখনকার কাব্যভাষায় যতটা আনতে পারা যায়, চেষ্টা করেছি। তবে তখনো আমার মধ্যে প্রচণ্ড একটা আশাবাদ কিন্তু তৈরি হয়নি। এ জন্য তুমি কীর্তনাশার শেষের দিকের কবিতায় দেখবে যে আমি লিখছি, ‘খালের ওপারে নুয়ে আছে আশশাওড়া/ কেন এইভাবে নুয়ে আছে, সে কী জানে।’ তারপর ওখান থেকে মানুষের শ্রম-ঘাম-মুক্তির মন্ত্রণা—এইগুলো সম্পর্কে আমার বোধোদয় হলো। অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার বিষয়টি আবারও মাথায় কাজ করতে শুরু করল।

প্রশ্ন:

শিমুল: মানুষের মুক্তির স্বপ্ন।

রফিক: এগজ্যাক্টলি। এর মধ্যে আমার ব্যক্তিজীবনে অনেক ওলটপালট ঘটে গেছে। এরপর তুমি যদি গাওদিয়া পড়ো, দেখবে, ধীরে ধীরে একটা শ্রমভিত্তিক সমাজের ব্যাপারটা ক্রমেই আসছে। তারপরের বই হলো স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময়। সেখানে দেখবে, বৃহত্তর রাজনীতি; গাওদিয়ায় যা নেই।

প্রশ্ন:

শিমুল: এরপর তো কপিলা...

রফিক: হ্যাঁ। কপিলা লেখার সময় আমি কিন্তু বাংলাদেশের আরও বৃহত্তর জীবনের মধ্যে ঢুকে গেছি।

প্রশ্ন:

শিমুল: কপিলায় তো আপনি প্রচুর পুরাণ ব্যবহার করেছেন মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে।

রফিক: হ্যাঁ,গীতিকার ফর্ম আমি নিয়েছি। সঙ্গে আর্কিটাইপ নির্মাণের বিষয়টা ভীষণভাবে কাজ করেছে। এর সঙ্গে আমাদের শ্রমজীবী নারীর চরিত্র, দেহব্যবসা যাঁরা করেন, তাঁরা, ওখানে একটা পতিতার ক্যারেক্টার আছে দেখবে।

প্রশ্ন:

শিমুল: ও মাসি, তুই পোড়ামুখী, জবাব না দি কানতে বইলি—

রফিক: একদম। সেই পতিতার কিন্তু বিরাট ভূমিকা আছে। তত দিনে আমি একটা বিশ্বাসে পৌঁছেছি যে নারীর জাগরণ ছাড়া আমাদের মুক্তি বা জাগরণ সম্ভব নয়। তারপর দেখবে, ধীরে ধীরে একটা আন্তর্জাতিকতা কপিলার মধ্যে আসছে। কপিলার এই আন্তর্জাতিকতা কিন্তু স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময়তে এসে স্পষ্ট। আবার মেঘে এবং কাদায় যখন লিখলাম, তখন এর মধ্যে ইতিহাসভিত্তিক ব্যাপারস্যাপার আছে। দাঙ্গা আছে। আমার তখন মনে হলো, আমার একটা সার্কেল শেষ, ওই সময়ের বৃত্তভ্রমণ শেষ।

এরপর আমি নানা জটিলতায় বহুদিন লিখতে পারিনি। এর মধ্যে ভোলায় একটা ঘটনা ঘটল—সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। গেলাম ওখানে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে মিশলাম। পরে আবার আমার মধ্যে একটা মানসিক পরিবর্তন শুরু হলো। বস্তুত এরই ফল হলো রূপকথা কিংবদন্তি। রূপকথা কিংবদন্তি আর মাতি কিসকু—এই বই দুটি পুরোপুরি কাব্যিক ভাষা অর্জন করেছে বলে আমার মনে হয় না।

প্রশ্ন:

শিমুল: আপনার কোন বই থেকে আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত যে কাব্যভাষা, সেটা অর্জন করলেন?

রফিক: আমার কাঙ্ক্ষিত কাব্যভাষা বলতে পারো, কীর্তিনাশা থেকেই আমি অর্জন করেছি।

প্রশ্ন:

শিমুল: আপনার পরে যাঁরা লিখতে এসেছেন, বিশেষত তরুণ লেখকদের উদ্দেশে কিছু বলার আছে?

রফিক: বলব যে মাটির দিকে তাকাও, পাখির দিকে তাকাও, তাকাও আকাশের দিকে। তুমি কোনো গণ্ডিবাঁধা অঞ্চলের নও, তুমি এই ব্রহ্মাণ্ডের। ব্রহ্মাণ্ডের দায়ভার তোমাকে বুঝতে হবে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এটা করে দেখিয়েছেন। তারপর কী করে যেন বাংলা সাহিত্য সংকীর্ণ হতে শুরু করল। বাংলা সাহিত্য এখন সংকীর্ণ হতে হতে কোথায় যে গেছে! কবিতা নিয়ে অনেক বলেছি। এবার গদ্য বিষয়ে বলি। আমাদের দেশে এখন গদ্যের খুব নাকি রমরমা! কী রমরমা, আমি বুঝি না। সব উপন্যাস তো শুধু কাহিনি! কে বলেছে, কোথায় বলেছে যে উপন্যাস শুধু কাহিনি! কাহিনি থাকতে পারে, কিন্তু শুধু কাহিনিই তো উপন্যাস নয়, এর আরও অনেক বিস্তৃত জায়গা তথা ল্যান্ডস্কেপ ধরার কথা। তুমি রবীন্দ্রনাথের গোরা পড়ো, তলস্তয়–দস্তয়েভস্কি পড়ো, টমাস মান—পৃথিবীর বড় বড় ঔপন্যাসিককে পড়ো। দেখবে, উপন্যাস কী বিরাট জিনিস! ওখানে কাহিনি একটা ব্যাপার, কিন্তু কাহিনিসর্বস্বতাই প্রধান নয়। কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ উপন্যাসই এখন কাহিনিসর্বস্ব। এগুলো হলো পশ্চিম বাংলার পূজা সংখ্যার প্রভাব।

পূজা সংখ্যা বিক্রি হতে হবে, সুতরাং উপন্যাসের নামে লেখো কাহিনি। বাংলা উপন্যাস কি কাহিনিসর্বস্ব ছিল? বিভূতিভূষণের আরণ্যক–এর কাহিনি কী? পথের পাঁচালী কি অপুর জীবনী, না পথের পাঁচালি? আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পরও আমরা দেখি না।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা কিন্তু শশীর কাহিনি নয়। শশীর গল্প এখানে আছে, তবু এটা পুতুলনাচের ইতিকথা।