রবীন্দ্রনাথ ও ডি এল রায়: একটি ‘চিড় ধরা’ সম্পর্কের বয়ান

১৮ জুলাই ছিল কবি ও নাট্যকার ডি এল রায়ের জন্মদিন। এই লেখক ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক। রবীন্দ্রনাথ ও ডি এল রায়ের মধ্যে প্রথম দিকে সুসম্পর্ক থাকলেও পরের দিকে রবি ঠাকুরের কট্টর সমালোক হিসেবে আবির্ভূত হন ডি এল রায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ডি এল রায়ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বয়সে দুই বছরের ছোট। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একাধারে কবি, গীতিকার ও নাট্যনির্মাতা। রবীন্দ্রনাথের পরিচয় নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই।

রবীন্দ্রনাথ শহরের মানুষ। কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্ম। দ্বিজেন্দ্রলালও শহরের মানুষ। কলকাতার একটি উজ্জ্বল মফস্‌সল শহর কৃষ্ণনগরে  তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘ডি এল রায়’ নামে সাহিত্য ও ইতিহাসে পরিচিত। কাছের লোকেরা তাঁকে ‘দ্বিজু বাবু’ নামেও সম্বোধন করতেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথও বলতেন দ্বিজু বাবু।

রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো ছিল না, এটা খুঁজে বের করতেই আমরা যেন বেশি উৎসাহী। যেকোনোভাবে হোক, এই মহান দুই পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের অধঃপতন প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই যেন আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। এটা ঠিক যে জীবনের একটা সময়ে তাদের মধ্যে কিছু বিষয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল। নানা লেখাপত্র সে বিষয়ে সাক্ষ্য দেয় বটে।

একটা সৌহার্দ্যের সম্পর্ক দীর্ঘকাল বজায় থাকা সত্ত্বেও বাংলা কাব্যসাহিত্যের নক্ষত্র ডি এল রায়কে দুর্ভাগ্যবশত বাঙালি মনে রেখেছে ‘রবীন্দ্রসমালোচক’ হিসেবে।

পাঁচ শর মতো গান রচনা করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। ‘ধনধান্যপুষ্পভরা, ‘আমরা এমনি এসে ভেসে যাই’, ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সংগীত ভেসে আসে’—এসব তাঁর রচনা। তাঁর গানের মধ্যে প্রেমের, হাসির ও স্বদেশি গানই মুখ্য। এর মধ্যে সুর পাওয়া গেছে নাকি মাত্র ১৩২টি গানের। ডি এল রায় নাটক লিখেছেন ২১টি। ইতিহাসাশ্রিত, প্রহসন, সামাজিক, পুরাণাশ্রিত। গান-কবিতা মিলিয়ে তাঁর বইয়ের সংখ্যা কম নয়।

১৮ জুলাই ছিল ডি এল রায়ের জন্মদিন। এই ব্যক্তির নাতিদীর্ঘ জীবনের পশ্চাৎপট ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ফিরিস্তির যৎসামান্য হাজির করা যাক।

প্রথম দিকে তাঁদের সম্পর্ক এতটাই সহজ–সরল ছিল যে এই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ই রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর এক আত্মীয়ের চাকরির ব্যাপারে সুপারিশ পর্যন্ত করেছিলেন। একজন কবির সুপাারিশপত্র নিশ্চয়ই আর দশজনের মতো হবে না। অনবদ্য রসভরা পদ্যে লেখা ছিল সেটি। ডি এল রায় এভাবে লিখেছিলেন:

‘শুনছি নাকি মশায়ের কাছে

অনেক চাকরি খালি আছে—

দশ-বিশ টাকা মাত্র মাইনে

দু–একটা কি আমরা পাইনে?’

কী অসাধারণ! এরপর ডি এল রায় লিখলেন যাঁর জন্য সুপারিশ করছেন তাঁর নাম, পরিচয়-সাকিন। এমনকি দেখতে কেমন, যোগ্য কি আছে।

‘ইন্দুভূষণ সান্যাল নাম,

আগ্রাকুণ্ডা গ্রাম ধাম,

–চাপড়া গ্রামের অপর পারে

এক্কেবারে নদীর ধারে।

নাইবা থাকুক টাকা কৌড়ি,

–চেহারাটা লম্বা চৌড়ি।

কুলীন ব্রাহ্মণ,—মোটা পৈতে,

ইংরেজিটাও পারেন কইতে।’

ডি এল রায়ের সুপারিশে রবীন্দ্রনাথ সেই ইন্দুভূষণ সান্যালকে চাকরি দিয়েছিলেন কি না, সেটা মুখ্য নয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর যে মজার সম্পর্ক ছিল, এ চিঠি তা–ই প্রমাণ করে।

২.

দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনীকার দেবকুমার রায়চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, ১৯০৪ সালে দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ৫ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে প্রথম ‘পূর্ণিমা মিলন’ উৎসবের আয়োজন করা হয়। সেই উৎসবের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সাহিত্যিকী পৌর্ণমাসী সম্মিলন’।

জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। কি চমৎকার সন্ধ্যা! আমন্ত্রিত হয়ে সেদিন ওই বাড়িতে এসেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ফাল্গুনের সেই ফাগের খেলায় সবাই প্রাণখুলে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। গানে-কথায় মুখর হয়ে উঠেছিল দ্বিজু বাবুর বাড়ির ওই প্রাঙ্গণ। রঙ্গে ব্যঙ্গে সবাই আনন্দ উপভোগ করেছিলেন; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেদিন একটু আড়ষ্ট ছিলেন। কেন জানি নিজের মনকে ওই অনুষ্ঠানের সঙ্গে একাত্ম করতে পারছিলেন না। এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু দ্বিজু বাবু তো ছাড়বার পাত্র নন। দ্বিজেন্দ্রলাল নিজেই রবীন্দ্রনাথের আপাদমস্তক রঙিন করে তুলেছিলেন মুঠো মুঠো ফাগ লাগিয়ে। কী চেহারা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সেদিন! কিন্তু দ্বিজু বাবুর এই কাণ্ডে তিনি এতটুকু বিরক্ত হননি। মধুর কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আজ দ্বিজুবাবু শুধু যে আমাদের মনোরঞ্জনই করেছেন তা নয়, তিনি আজ আমাদের সর্বাঙ্গ-রঞ্জন করলেন।’

বিখ্যাত কবিতা ‘সোনার তরী’কে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিলেন  দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘কাব্যের অভিব্যক্তি’ নামের এক প্রবন্ধে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, ‘কৃষক ধান কাটিতেছেন বর্ষাকালে, শ্রাবণ মাসে। বর্ষাকালে ধান কেহই কাটে না; বর্ষাকালে ধান রোপণ করে।’ এ–ও লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা নাকি ততটা গভীর নয়।

৩.

চাকরি জীবনে দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন ইংরেজ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সারা চাকরি জীবনে বিশেষ পদায়ন তাঁর হয়নি। এর অবশ্য যৌক্তিক কারণ ছিল। বলা হয়ে থাকে, জনগণের সুবিধার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়ে তিনি ইংরেজের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। সরকারি দায়িত্বে থাকাকালে তাঁর একখানা বজরা ছিল। মাঝেমধ্যে এই বজরায় পার্টি দিতেন দ্বিজু বাবু। এ রকম একটি পার্টিতে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন। তৎকালীন সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতির লেখায় এ রকম একটি পার্টির উল্লেখ পাওয়া যায়। সেটা ১৯০২ সালের কথা। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখেছেন, ‘কথা ছিল এখান থেকে বরাবর খড়দা (খড়দহ) পর্যন্ত গিয়ে সেখানে একটা বাগানে আহারাদি করা যাবে এবং তারপর ধীরে সুস্থে ফেরা যাবে। বজরা রওনা হল। রবিবাবুও এ পার্টিতে ছিলেন। হঠাৎ খুব মেঘ করে এল ঝড় এবং বৃষ্টি। এ দিকে বাজে তখন প্রায় এগারোটা।’

বজরা তখন ব্যারাকপুরে লাটসাহেবের বাড়ির বাগানের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখছেন, ‘সেখানেই নেমে পড়া সাব্যস্ত হল। কিন্তু রাতের ওই দুর্যোগে একখানিও গাড়ি পাওয়া গেল না। অনন্যোপায় হয়ে সেই ঘোর অন্ধকারে পদব্রজে খড়দহ যাত্রা এবং সেই বাগানের আবিষ্কার। রাত্রে যৎসামান্য আয়োজন। প্রত্যুষে উঠেই যে যার মতো ট্রেনে করে কলকাতায় ফিরে আসা গেল। দুজন মহাকবি অম্লান বদনে এই সব অসামান্য কষ্ট সহ্য করেছিলেন এবং হাস্যামোদ, কবিত্ব ও রসিকতার অফুরন্ত প্রবাহে সেই দারুণ দুশ্চিন্তা ও ক্লেশকে আনন্দময় করে রেখেছিলেন। দুই কবির মধ্যে এ সময় খুব সম্প্রীতি ছিল এবং তাঁদের বন্ধুত্ব সম্বন্ধটাও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।’

সেই বছরই (১৯০২) দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘মন্দ্র’ প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এই কাব্যের প্রশংসা করে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় লিখলেন, ‘ইহা নূতনতায় ঝলমল করিতেছে এবং এই কাব্যে যে ক্ষমতা প্রকাশ পাইয়াছে তাহা অবলীলাকৃত ও তাহার মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবল আত্মবিশ্বাসের একটি অবাধ সাহস বিরাজ করিতেছে। সে সাহস কি শব্দ নির্বাচনে, কি ছন্দো-রচনায়, কি ভাবনায়—সে সর্বত্র অক্ষুণ্ণ।’

রবীন্দ্রনাথ আরও লিখলেন, ‘কবিতাগুলির মধ্যে পৌরুষ আছে। ইহার হাস্য, বিষাদ, বিদ্রুপ, বিস্ময় সমস্তই পুরুষের—তাহাতে চেষ্টাহীন সৌন্দর্যের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সরলতা আছে!’

কারও কারও মতে, রবীন্দ্রনাথ একটু বেশিই প্রশংসা করেছিলেন। শুধু এই বইটি নয়, ডিএল রায়ের একাধিক রচনার পযালোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

৪.

মোটামুটি সব গবেষক একমত যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সম্পর্কে অম্লতার সূচনা হয়েছিল কবিগুরুর বিখ্যাত কবিতা ‘সোনার তরী’ দিয়েই। আর এক্ষেত্রে নাকি উভয় পক্ষের ভক্তকুলের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ডি এল রায়কে যে যা বলত, সবই তিনি একপ্রকার বিশ্বাস করতেন। তাঁর চরিত্রের ধরন এমনই ছিল।

‘সোনার তরী’ কবিতায় রবিঠাকুর লিখেছিলেন—

‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।

কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।

রাশি রাশি ভারা ভারা

ধান কাটা হল সারা,

ভরা নদী ক্ষুরধারা খর পরশা।

কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।’

বিখ্যাত কবিতা ‘সোনার তরী’কে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিলেন  দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘কাব্যের অভিব্যক্তি’ নামের এক প্রবন্ধে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, ‘কৃষক ধান কাটিতেছেন বর্ষাকালে, শ্রাবণ মাসে। বর্ষাকালে ধান কেহই কাটে না; বর্ষাকালে ধান রোপণ করে।’ এ–ও লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা নাকি ততটা গভীর নয়।

কবিগুরুর ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যনাট্য (১৮৯২ সালে রচিত) সারা বাংলায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কিন্তু ব্যাপারটা ভালো লাগল না। উল্টো তিনি রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ তুললেন। তখন ব্যাপারটা চারদিকে খুব বিতর্ক তৈরি করেছিল।

বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে ব্যঙ্গ করে ডি এল রায় লিখেছিলেন, তাঁর জীবনের শেষ প্রহসন আনন্দ বিদায়। সে নাটক অভিনয়ের সময়ে প্রবল দর্শক-প্রতিক্রিয়ায় তাঁকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল গোপনে রঙ্গমঞ্চের পেছন দিয়ে। এই নাটকের দ্বিতীয় মঞ্চায়ন আর হয়নি।

অবশ্য দ্বিজু বাবুকেও ছেড়ে কথা বলেননি রবীন্দ্র অনুরাগীরা। ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একজন মন্তব্য করেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের যশঃ-সূর্য্যের কালমেঘরূপ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় “সাহিত্য” আকাশে উদিত।’

‘আনন্দ বিদায়’ (১৯১২) লেখার পরের বছরই (১৯১৩) দেহ রাখেন ডি এল রায়। আর ওই বছরই নোবেল পুরস্কার পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘দেশ’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় স্বর্গীয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্মরণসভার জন্য কবিগুরুর থেকে লেখা চেয়েছিলেন। রবিঠাকুর প্রত্যুত্তরে লিখেছিলেন, ‘এ কথা সর্বজনবিদিত যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দীর্ঘকাল ধরে নিরবচ্ছিন্ন তীব্রতার সঙ্গে আমার সম্বন্ধে কটূক্তি বর্ষণ করে এসেছেন...তাঁর সম্বন্ধে আমার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু তবু যদি তাঁর স্মরণ সভায় প্রশস্তিবাদ করতে যাই, সেটা আমার পক্ষে দাক্ষিণ্যের অহংকার প্রকাশের মতো দেখাবে। তিনি বেঁচে থাকলে সেটা তাঁর প্রীতিকর হতো না।...’

শেষ কথা হলো, আনন্দ বিদায় লেখা এবং দর্শক প্রতিক্রিয়ায় মুষড়ে পড়েছিলেন ডি এল রায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি নিয়ে অনুশোচনাও করতেন। বাবার অনুশোচনার কথা উঠে এসেছে ছেলে প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায়ের লেখাতেও।

তথ্যসূত্র: ‘দ্বিজেন্দ্রলাল’, দেবকুমার রায়চৌধুরী, ‘স্মৃতিচারণা’ দিলীপকুমার রায়