সময়ের স্রোতোগাথা জীবন সত্য

আনোয়ারা সৈয়দ হকছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ অবলীলায় অনেক লেখককেই লেখালেখির খোরাক জুগিয়েছে। সাহিত্যকে আধার করে ইতিহাসকে টিকিয়ে রাখার এই কেতা খুব বেশি অভিনব না হলেও রণজিৎ গুহের মতো পণ্ডিতও এর কেজো দিকের তারিফ করে বিস্তর লিখেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির আত্মপরিচয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে মহীয়ান ঘটনা। একাত্তর–পরবর্তী সময়ে ঢাকার সাহিত্য-বাজারে যাঁরা নিজেদের লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, প্রায় প্রত্যেকের নেপথ্যে জ্ঞাতসারে হোক কিংবা অজান্তে, চালচিত্রের মতো এসে দাঁড়িয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ’। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে উপন্যাস রচনার একটি বিশেষ ক্ষেত্রও তৈরি হয়ে গেছে। ‘মুখ ও মুখোশ’ শব্দবন্ধটি মনে রেখে এগুলোর অনেকটিকে আমরা ‘মুখোশ’-এর খাতায় ফেললেও আনোয়ারা সৈয়দ হকের উপন্যাস সময় বহিয়া গেল নিঃসন্দেহে ‘মুখশ্রী’ হিসেবেই স্বীকৃত হবে।

উত্তেজনায় টান টান এ উপন্যাসে আনোয়ারা সৈয়দ হক প্রকর্ষ ও পরাক্রমে পাকিস্তানি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মুখোশ খুলে দেওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের এক জটিল কালপর্বের ইতিহাসসম্মত সাহিত্যিক ভাষ্য নির্মাণ করতে পেরেছেন। উপন্যাসটির কালপরিসর তিন বছরের কিছু কম সময়। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য পাস করা চিকিৎসক সানজিদার সাতকাহন ইতিহাসের গলি থেকে পাঠককে নিয়ে যায় রাজপথে। ছয় দফা, আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র বীক্ষণ—সবই আছে এখানে। এ উপন্যাসে লেখক পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষের ওই সময়ের সংগ্রামকে নির্মোহভাবে উপস্থাপন করেছেন। ফলে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, উপন্যাসটি একাত্তর সম্বন্ধে আমাদের জানাশোনার, গ্রহণ-বর্জনের রীতি-পদ্ধতি মেনেই জাতিগত ঐতিহাসিক চাহিদাকে পূরণ করতে পারবে।

পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ডাক্তার সানজিদা আর পাকিস্তান অবজারভার-এর সাংবাদিক মফিজের একান্ত আটপৌরে দাম্পত্য জীবনের ঘরোয়া কথাবার্তা দিয়ে উপন্যাসটির সূচনা। পাকিস্তান এয়ারফোর্সে চাকরি পেয়ে বংশালের বাসা থেকে গ্রিনরোডের বাসায় এসে হয়তো ক্ষণিক সুখের সন্ধান পেয়েছে তারা, কিন্তু তবু কোথায় যেন অস্বস্তি রয়েই যায়। সেই অস্বস্তির কারণ খুঁজলে দেখা যাবে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই যে বৈষম্য ছিল, তার রূপ কতটা প্রকট! সানজিদা পশ্চিম পাকিস্তানে ট্রেনিং করতে গিয়ে আবিষ্কার করে, সেখানকার রাস্তাঘাট আপেল দিয়ে সয়লাব; অথচ একই রাষ্ট্রের অপরাংশে সেটা রীতিমতো দুর্লভ। অন্যান্য কোর্সমেট যেখানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হয়ে রীতিমতো তুবড়ি ছোটাচ্ছে, সেখানে স্রেফ বাঙালি হওয়ার কারণে প্রমোশন দেওয়া হয়নি মেজর আকরামকে। সামরিক বাহিনী, জনপ্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য—প্রতিটি ক্ষেত্রে এ রকম বৈষম্যের শিকার পূর্ব বাংলার মানুষেরা। প্রসঙ্গত বলা যায়, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম ছিল; কিন্তু ১৯৬৯ সালে এই ব্যবধান দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে। এখানেই শেষ নয়, বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার ৭০ শতাংশ, কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যয়ের ৮০ শতাংশ এবং সামরিক ব্যয়ের ৯০ শতাংশ পেত পশ্চিম পাকিস্তান। এই অর্থনৈতিক পীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধেই ছয় দফা উত্থাপিত হয়, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছিল। সানজিদা আর মফিজের দৈনন্দিন ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি যেমন এসেছে, তেমনি পাওয়া যাবে সে সময়ের মানুষের জীবনচিত্র।

উপন্যাসটিতে মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় বিষয়ভিত্তিক ঘটনা, যুদ্ধ বা যোদ্ধাদের অসীম বীরত্বগাথা অথবা বিজয়োল্লাস নয়; বরং অন্তিমে এসেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বন্দিনী কতিপয় নারীর লাঞ্ছনা-অত্যাচারের করুণ চিত্র। কর্মসূত্রে মোহাম্মদপুরে গিয়ে বদর রোড থেকে নূরজাহান রোড, সেখান থেকে ইকবাল রোড এবং আরও আরও অনেক সড়কের গোলকধাঁধা অতিক্রম করে জীবনের রাজপথের সন্ধান পেয়েছিল সানজিদা; কিন্তু অন্ধকার, সর্পিল পথ পাড়ি দিয়ে স্কোয়াড্রন লিডার দিলদারের বাসায় রোগী দেখতে গিয়ে সেই নরকপুরীতে তরুণী কণ্ঠের গোঙানি শুনে তার উপলব্ধি তাকে নিশ্চল ছবিতে রূপান্তরিত করে। উপন্যাসে এর বেশি আর কিছু উন্মোচিত করেননি লেখক। হয়তো করার দরকার নেই বলেই।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন বাঙালি জাতিসত্তা অর্জনের দীর্ঘ ইতিহাসের গর্বিত সম্পদ। বাংলাদেশকে একটি আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত করাই ছিল লক্ষ্য। সেই সময়ের বাস্তবতায় কী কী চেয়েছিল মানুষ, কেমন ছিল তাদের আকাঙ্ক্ষা? এগুলোই আখ্যানের আকারে ফুটে উঠেছে সময় বহিয়া গেল–তে। পড়তে পড়তে মনে হয়, উপন্যাসের ঘটনাবলি আরেকটু বিস্তৃত হলে কি আরও বেশি ভালো লাগত?

সময় বহিয়া গেল

আনোয়ারা সৈয়দ হক

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০২৪; প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল; ১৬৮ পৃষ্ঠা;

দাম: ৪৫০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com

এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে