মুক্তিযুদ্ধ কি তবে ‘অব্যাহত’ আছে

সম্প্রতি মতিউর রহমানের সম্পাদনায় প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধ: প্রথম আলো একাত্তর শিরোনামে দুই খণ্ডের বই। গত ২৬ বছরে প্রথম আলোয় প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ–বিষয়ক লেখার সংকলন এই বই

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ একবার এবং একটাই হয়েছে। কিন্তু এর নানা ‘ফ্যাকড়া’ আছে। একেকজন তাঁদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মতাদর্শ অনুসারে মুক্তিযুদ্ধকে একেকভাবে দেখেন, দেখান এবং কখনো কখনো ব্যবহার করেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম আলোরও একধরনের অবস্থান আছে। প্রথম আলো মুক্তিযুদ্ধ বলতে কী বোঝে, একে কীভাবে দেখে, তার একটা পরিচয় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধ: প্রথম আলোয় একাত্তর বইয়ে। দুই খণ্ডে সংকলিত এই বইয়ের মুক্তিযুদ্ধসম্পর্কিত লেখাগুলো গত ছাব্বিশ বছরে বিভিন্ন সময় প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো সম্ভবত বাছাই করা লেখা।

মতিউর রহমান সম্পাদিত বই দুটিতে একটা নাতিদীর্ঘ ভূমিকা আছে। মুক্তিযুদ্ধকে প্রথম আলো কীভাবে, কোন চোখে দেখে, তার কিছুটা আভাস ওই ভূমিকায় পাওয়া যায়। ভূমিকায় সম্পাদক খুব স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এটি [মুক্তিযুদ্ধ] ছিল সার্বিক অর্থে একটি জনযুদ্ধ। শ্রেণি–গোষ্ঠী–সম্প্রদায়নির্বিশেষে পুরো জাতি এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল।...মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের কৃষক থেকে প্রভূত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের কর্ণধার পর্যন্ত এবং এর ভেতর বিচিত্র মানুষ ও গোষ্ঠী।’ এই দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বলে মনে করি। এতে করে মুক্তিযুদ্ধের ওপর সাধারণ মানুষের দাবি ও মালিকানাটা ‘নেই’ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়।

সম্পাদনা কোনো নিরীহ ব্যাপার নয়। এর মধ্যে পরিকল্পিতভাবে জারি থাকে সম্পাদকের নিজস্ব বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। সম্পাদিত বইয়ে সম্পাদক অন্যের লেখা সংকলনের মধ্য দিয়ে কিছু একটা বলতে চান। অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধ: প্রথম আলোয় একাত্তর গ্রন্থটির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধ যে কেবল কোনো দল, শ্রেণি, গোষ্ঠী বা কোনো দেশের একক কৃতিত্বের ফসল নয়, তা নানা লেখকের লেখাগুলোর ভেতর দিয়ে সম্পাদক ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।

গ্রন্থটির বিষয়বিন্যাস থেকে সহজেই ব্যাপারটা বোঝা যেতে পারে। প্রথম খণ্ড শুরু হয়েছে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস তুলে ধরার মধ্য দিয়ে। এর ইশারা অত্যন্ত স্পষ্ট। উনসত্তরের মূল ভিত্তি ছিল গণমানুষ। এরপর ওই খণ্ডে সংকলিত হয়েছে সম্মুখযুদ্ধের ইতিহাস। এই অংশে মূলধারার বড় বড় সম্মুখযুদ্ধের পাশাপাশি বেশ কিছু অজানা ও কম জানা সম্মুখযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার প্রচেষ্টা আছে। আছে বিচিত্র মানুষের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা। বেশ কিছু সাক্ষাৎকারও আছে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছে, তার ইতিহাসও লিপিবদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন লেখক-সাহিত্যিকের বয়ানে।

দ্বিতীয় খণ্ডের একটা বড় অংশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের বৈশ্বিক পরিসরকে তুলে ধরা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে আছে অন্তত ১১ জন বিদেশি প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা। আছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কিছু দুর্লভ দলিলের ভাষ্য। এ ছাড়া রয়েছে গণহত্যাবিষয়ক বেশ কিছু লেখা, শরণার্থীশিবিরের কিছু প্রামাণিক ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানবিষয়ক লেখাপত্র। এর ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এই বইয়ে একটা আলাদা বিস্তারের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা লক্ষ করা যায়।

সম্প্রতি একটি অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে যে সরকারের পতন ঘটেছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে সেই সরকারসংশ্লিষ্ট দল আওয়ামী লীগের একটি গভীর সম্পর্ক ছিল। এ কারণে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান অংশীজন (স্টেকহোল্ডার) হিসেবে নিজেদের দাবি করে আসছে। সেই মোতাবেক এই দল ও এর অনুসারী বুদ্ধিজীবী সমাজ বহুদিন ধরে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের একটা ঐতিহাসিক মহাবয়ানও নির্মাণ করেছে। ফলে অনেকে মনে করছেন যে এই দলের সরকারের পতনে স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধ ও তার বয়ান মুখ থুবড়ে পড়েছে। কোনো কোনো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে উপেক্ষা বা পাশ কাটানোর একটা প্রবণতাও কেউ কেউ লক্ষ করছেন। এ রকম একটি সময়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই সংকলনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক একটি তাৎপর্য আছে বৈকি। আবার এই বই এ সময় এই বার্তাও কি দেয় না যে মুক্তিযুদ্ধ কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়; বরং এটি সমগ্র দেশের মানুষের? এ কারণেই কি এ বইয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ হিসেবে দেখানোর একটি ব্যাকুলতা আছে!

মুক্তিযুদ্ধের মতো বড় ঘটনাকে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে। কোনো গোষ্ঠী বা দল একে তাদের খোপে ঢোকানোর চেষ্টা করতে পারে। তাতে মুক্তিযুদ্ধের কিছু যায়–আসে না। বাস্তবতা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে মহত্তম কোনো ইতিহাস বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর নেই। এই জনগোষ্ঠীর মহত্তম অর্জন বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই অর্জিত। এই জাতি ভারত ও পাকিস্তানের দ্বারা বরাবরই জাতিগত হেয়তার শিকার ছিল। উভয়ই ‘বাঙালিদের নিচু ভূমির নিচু জাতের মানুষ’ মনে করত। অ্যাডাম জোনস এই বইয়ে খুব স্পষ্টভাবে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে ‘পাকিস্তানি জেনারেলরা চিরদিনই বাঙালিদের নিচু চোখে দেখত। এমনকি তাদের দৃষ্টিতে বাঙালিরা ছিল মনুষ্যেতর জাতি’। ‘নামহীন, গোত্রহীন’, ‘বাপে না জিজ্ঞাসে, মায়ে না সম্ভাষে’ গোছের একটি জনগোষ্ঠী যতটুকু মর্যাদা অর্জন করেছে, তা প্রায় এককভাবে এই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই। মুক্তিযুদ্ধের এই তাৎপর্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধ: প্রথম আলোয় একাত্তর বই দুটি বিশেষ সহায়ক হবে।

বইয়ের নামের প্রথম দুই শব্দবন্ধ ‘অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধ’-এর ওপর সচেতন পাঠকের চোখ আটকে যেতে পারে। মনে হতে পারে, এটা আবার কেমন কথা! মুক্তিযুদ্ধ তো হয়ে গেছে ১৯৭১ সালে। এই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা কীভাবে ‘অব্যাহত’ থাকে! তবে বইটি কি এই বার্তা দিতে চেয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম এখনো জারি আছে! এভাবেই কি বইটি মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ঘটানো বাংলাদেশের মানুষের সব আন্দোলন-সংগ্রামকে মুক্তিযুদ্ধেরই ‘এক্সটেনশন’ মনে করছে!

স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া অন্য কোনো অর্থেই তো আমরা মুক্তিযুদ্ধের ফসল ঘরে তুলতে পারিনি। ব্যাপারটা যে কেউই বুঝতে পারেন। রাষ্ট্রের মধ্যে সাধারণ মানুষের মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন কতটুকু আছে? মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন হওয়ার পরও অ-মুক্তির ব্যাপারটা উপলব্ধি করার জন্য একাত্তরকে সামগ্রিকভাবে বোঝার দরকার আছে বলে মনে করি। পেছন ফিরে দেখার দরকার আছে, কেন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল! কেন সাধারণ মানুষ মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বুকে মাইন নিয়ে শত্রুশিবিরে ভাবলেশহীনভাবে ঢুকে পড়েছিল! উপলব্ধির দরকার আছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাটা কী ছিল? এটি যে সমগ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির ব্যাপার ছিল, তা অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধ: প্রথম আলোয় একাত্তর বই দুটি পাঠকদের বুঝতে সাহায্য করবে।

বইয়ের লেখকতালিকা নিয়ে কিছু কথা বলে শেষ করা যাক। বাংলাদেশে যাঁরা অবিসংবাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও ‘প্রগতিশীল’ লেখক-বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও চিহ্নিত, তাঁদের লেখা বেশি স্থান পেয়েছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় সক্রিয় কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে ভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শকে লালন করেন, এমন লেখক-চিন্তকদের লেখা তুলনামূলক কম সংকলিত হয়েছে। ভবিষ্যতে কোনো সংস্করণে ভিন্ন কণ্ঠস্বরের লেখক-চিন্তক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের লেখা আরও কিছুটা গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দিলে সংকলনটি আরও ঋদ্ধ, বহুস্বরিক ও সম্পন্ন হয়ে উঠবে বলে মনে করি।

তবু ‘মুক্তিযুদ্ধ: কী পেয়েছি কী পাইনি’, ‘মুক্তিযুদ্ধ: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’, ‘মুক্তিযুদ্ধের অপূর্ণ প্রত্যাশা’ শিরোনামের লেখাগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী বাংলাদেশকে অনেক দূর পর্যন্ত নির্মোহভাবে দেখার যে প্রচেষ্টা, তা সংকলনটিকে অনেকখানি বিশ্বস্ত করে তুলেছে। মঈদুল হাসানের একাধিক লেখা, মতিউর রহমানের ‘স্বাধীনতার পথে ছাত্র আন্দোলন’, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের ‘ভুট্টোর বয়ানে অসহযোগ আন্দোলন’, সাজ্জাদ শরিফের নেওয়া এ কে খন্দকারের সাক্ষাৎকার, মিজানুর রহমান খানের অন্বেষণী রচনা, বিদেশি প্রত্যক্ষদর্শীদের রচনাগুলো এবং আরও আরও নানা লেখার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অখ্যাত-অজ্ঞাত-বিতর্কিত অনেক অধ্যায়ের উন্মোচন সংকলনটিকে একটি ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চর্চায় অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধ: প্রথম আলোয় একাত্তর সংকলন দুটি অনেক নতুন খোরাকের জোগান দেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধ: প্রথম আলোয় একাত্তর 

প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড

সম্পাদক: মতিউর রহমান

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৫;
প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল;প্রথম খণ্ড: ৩৪৪ পৃষ্ঠা ও দ্বিতীয় খণ্ড: ৩৫২ পৃষ্ঠা; দাম: প্রথম খণ্ড ৭০০ টাকা ও দ্বিতীয় খণ্ড ৭০০ টাকা।

বই দুটি পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে