সত্যিকারের স্বাধীনতা পেতে হলে কী করতে হবে

বার্ট্রান্ড রাসেল (১৮ মে ১৮৭২—২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০)

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সময়ে প্রতিদিন শত শত ফেক নিউজ, ভুল তথ্য আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দরিয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা। আমাদের নৈতিকতা, সত্যের ক্ষমতা সব যেন তলানিতে ঠেকেছে। পৃথিবীর আদিমতম যুদ্ধ হলো সত্যের সঙ্গে মিথ্যার লড়াই। সত্য কী? মিথ্যাই–বা কোনটি? বহুকাল ধরেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে মানুষ। সমস্যাটি পুরোনো হলেও এর সমাধান সহজ; এবং সব সময় প্রাসঙ্গিক। আমাদের সত্য-মিথ্যার জট পাকানো ভাবনাকে পরিষ্কার করতে প্রয়োজন কেবল যুক্তি ও চিন্তার স্বচ্ছতা এবং স্বাধীনতা। এটি ছাড়া মানুষের জীবনে প্রকৃত অগ্রগতিও অসম্ভব। 

দার্শনিক ও নোবেলজয়ী লেখক বার্ট্রান্ড রাসেলের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি মূলত যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী। ঈশ্বর ও ধর্মের প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন তিনি। তবে তা নিতান্ত নাস্তিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং একটি যুক্তিনির্ভর সমাজ গড়ে তোলার তাগিদ থেকে। নৈতিকতা নিয়ে তাঁর আলোচনা থেকেও এ কথা স্পষ্ট যে তিনি মানুষের স্বাধীনতা এবং তার প্রয়োজনীয়তার পক্ষে ছিলেন।

বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখা ফিলোসফিক্যাল অ্যাসেস বইটি দার্শনিক প্রবন্ধাবলি নামে বাংলা অনুবাদ করেছেন আমিনুল ইসলাম ভুইয়া। মূল বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১০ সালে। এ বই লেখকের চিন্তার গভীরতা আর দার্শনিক অবস্থানকে জানান দিয়েছে স্পষ্টভাবেই। সাতটি প্রবন্ধের প্রতিটিতেই সেই সময়ের দার্শনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমির গভীর বিশ্লেষণ এবং চিন্তার নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে, যা এখনো সমান প্রাসঙ্গিক।

 প্রবন্ধগুলোয় রাসেল নৈতিকতা, জ্ঞানের প্রকৃতি, রাজনীতি, ধর্ম এবং মুক্তচিন্তার বিষয়–আশয় গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। গভীর দার্শনিক তত্ত্ব ও জটিল ধারণা নিয়ে আলোচনা করলেও সব শ্রেণির পাঠকের কাছেই এগুলো বোধগম্য। যুক্তি উপস্থাপনার স্বচ্ছতা বইটিকে সহজ করে তুলেছে। লেখক তাঁর মতামতকে কেবল তাত্ত্বিক পরিসরে সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং সেগুলোকে বাস্তব জীবনের উদাহরণের মাধ্যমে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।

এই বই এমন সব প্রশ্ন তোলে, যা প্রায় প্রতিটি মানুষের মনে কোনো না কোনো সময় আসে, ‘জীবনের উদ্দেশ্য কী?’, ‘নৈতিকতা মানে কী?’ ‘সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য কী?’—এসব কঠিন প্রশ্নের সহজ উত্তর সহজ ভাষায় পাওয়া যায় এখানে। তাই রাসেলের দার্শনিক ভাবনার আয়না বলা যায় এই বইকে।   

বইয়ে রাসেল এমন সব প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যা কেবল তত্ত্বেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানবজীবনের গভীর বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত। ধর্ম, জাত, বর্ণ বা অন্য কোনো বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাকে সবচেয়ে বড় করে দেখেছেন রাসেল। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান যুগের বৈষম্য ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে খুবই প্রাসঙ্গিক।

সাতটি প্রবন্ধে নৈতিকতা, ইতিহাস, প্রয়োগবাদ, বিজ্ঞান, হাইপোথিসিস, সত্যের মনিস্টিক থিওরি, উইলিয়াম জেমসের সত্যের ধারণা, সত্য ও মিথ্যার প্রকৃতি নিয়ে আলাপ এমনভাবে বলা হয়েছে, যাতে দর্শন নিয়ে যাঁর আগ্রহ নেই, তিনিও যেন এটি বুঝতে পারেন। লেখাগুলোতে রাসেল দর্শনকে সাবলীল ভঙ্গিমায় সামনে নিয়ে এসেছেন।

সাতটি প্রবন্ধ আলাদাভাবে নিজের গুরুত্বেই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসকেও যে কবিতার মতো করে পাঠ করা যায়, ধারণ করা যায় আরও বিস্তৃতভাবে, তা রাসেল নিজে যেমন বিশ্বাস করতেন, পাঠকদের জন্যও ভাবনার সেই সুযোগ তিনি রেখেছেন।

শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো একজন মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখানো। বর্তমান সমাজে যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই অন্ধ অনুসরণ ও চাপানো মতাদর্শ দেখা যায়, সেখানে নিজের আদর্শ ধারণ করার এই চিন্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসেল দেখিয়েছেন, সত্যিকারের স্বাধীনতা পেতে হলে আমাদের সঠিক নৈতিকতাকে ধারণ করতে হবে। বর্তমান দুনিয়ায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও নৈতিকতা নিয়ে যে তর্ক চলছে, এ বইয়ে আছে সেসবের অনেক কিছুর জবাব। আমিনুল ইসলাম ভুইয়ার সুখপাঠ্য অনুবাদে বইটি সবারই ভালো লাগবে; বিশেষত যাঁরা চিন্তাশীল এবং প্রশ্ন করতে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য এ বই ভাবনার খোরাক জোগাবে।

সৈয়দ মিজানূর রহমান

দার্শনিক প্রবন্ধাবলি

বার্ট্রান্ড রাসেল, অনুবাদ: আমিনুল ইসলাম ভুইয়া

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০২৪; প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল; ১৮৪ পৃষ্ঠা; দাম: ৫০০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে