কবিতায় নিপীড়িত নারীর ভাষ৵

‘আমাকে শাস্তি দাও/ আমি বেঁচে থাকলে তোমার পাগড়ি না আবার পড়ে খসে/ ...আমার ছেলেদের হাত উঠে গেলে তুমি পারবে না বাঁচতে...’।

কবিতায় উচ্চারিত ওপরের কথাগুলো যদি হয় কোনো নারীর, তাহলে সহজেই উপলব্ধি হয় যে পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীলতার ব্যূহ ভেদ করার জন্যই পঙ্‌ক্তিগুলো প্রণীত। আর যদি তা হয় পাকিস্তান নামক দেশের কোনো কবির লেখা, তবে স্বাভাবিকভাবেই এর তাৎপর্য নিহিত থাকবে আরও গভীরে।

ইসমাইল সাদী

নির্বাচিত কবিতা:

কিশওয়ার নাহীদ

অনুবাদ: সফিকুন্নবী সামাদী

প্রকাশক: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা;

 প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪; প্রচ্ছদ: কাজী যুবাইর মাহমুদ; ১৫২ পৃষ্ঠা; দাম: ৪৫০ টাকা।

পাকিস্তানের উর্দু কবি কিশওয়ার নাহিদ এমন অনেক কবিতার রচয়িতা। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা। নারীবাদী উর্দু কবি ও অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে তিনি স্বনামধন্য। স্বীকৃতি যেমন পেয়েছেন, তেমনি পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় লাঞ্ছনাও। তাঁর কবিতা নিপীড়িত নারী ও সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা বলে।

কিশওয়ার নাহিদের জন্ম ভারতের উত্তর প্রদেশের বুলন্দ শহরে, ১৯৪০ সালে। ভারতভাগের নিয়তি মেনে সপরিবার তাঁদের চলে যেতে হয় পাকিস্তানে। সাত বছরের মেয়েশিশু কিশওয়ারকে দেখতে হয়েছিল সাতচল্লিশের দেশভাগের ভয়ার্ত-ক্লেদাক্ত রূপ। দেশান্তরি হওয়ার কদিন আগে প্রতিবেশী বহু নারী অপহৃত হয়ে ফিরে এসেছিল গায়ে-পোশাকে রক্তচিহ্ন, অকথ্য নির্যাতন ও ধর্ষণের শারীরিক-মানসিক ক্ষত নিয়ে। সেই দুঃসহ স্মৃতি কিশওয়ারের হৃদয়ে অম্লান, অমোচনীয়। যে দেশে তাঁর পরিবার থিতু হয়েছে, সেই দেশটিতেও নেই নারীর নিরাপত্তা, নেই বিদ্যালয়ে যাওয়ার সাবলীল পরিবেশ। কবিতাচর্চা ও প্রগতিশীল কার্যক্রম চালাতে গিয়ে তাঁকে সইতে হয়েছে নানা অবিচার; ‘স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে তাঁর দুই ছেলেকে মায়ের লেখার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।’ সেই অবমাননাকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে যতটা সাধনা করতে হয়েছিল, ততধিক বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছিল কিশওয়ারকে।

প্রতিবাদী কবি কিশওয়ার কবিতায় একসময়  নিজেকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘পাপী নারী’ বলে: ‘আমরা এই পাপী নারীরা/ জোব্বাধারীদের গর্বিত প্রতাপে/ হইনি সন্ত্রস্ত/ না প্রাণ বিক্রয় করেছি /না হাতজোড় করেছি... / যেসব জিভ পারত বলতে তাদের দেওয়া হয়েছে কেটে।’

সব সহ্য করে হলেও কবি নারীর মুক্তির প্রশ্নে আপসহীন। ব্যঙ্গের তীর্যকতা, তুমুল তাচ্ছিল্য, সাহসী প্রতিবাদ আর ক্ষোভের সঙ্গে অভিমানও জারিত হয় কিশওয়ারের কবিতায়। নইলে তিনি বলতে পারতেন না, ‘তুমি আমাকে কাঁদাতে পারো/ আমি নিজেই নিজেকে হত্যা করে/ নিজের রক্তকে পানি-পানি করে/ চোখের মাঝে ঝিল বানিয়ে নিয়েছি।’ কিশওয়ারের কবিতার ক্ষেত্রে দ্রোহ ও প্রেম হাত ধরাধরি করে চলে।

নির্বাচিত কবিতা: কিশওয়ার নাহীদ নামে পাকিস্তানের এই কবির আলোচ্য বইটি উর্দু থেকে অনুবাদ করেছেন সফিকুন্নবী সামাদী। ইতিমধ্যে তিনি উর্দু ও হিন্দি থেকে অনুবাদের পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। উর্দুভাষী খ্যাতিমান কবি কিশওয়ার নাহিদকে বাংলা ভাষার পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে তাঁর এই প্রয়াস অনবদ্য। কেবল কবিতা নয়, কিশওয়ারের বেশ কিছু গজলও তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছেন গ্রন্থটিতে। ভাষার প্রাঞ্জলতা ও কাব্যময়তার গুণে কবিতাপাঠে মূলানুগ এক আনন্দ লাভ করা যায়। কবিতা কেবল অনূদিত হলেই হয় না, তা রসোত্তীর্ণও হতে হয়। অনুবাদক এ ক্ষেত্রে সফল।

ইসমাইল সাদী