বাংলাদেশে দাসতন্ত্র এবং অনুসন্ধানের দায়

অন্তর্জালের যুগে তথ্য এখন আর স্থানে আটকা পড়ে থাকে না। যে তথ্যের জন্য দিনের পর দিন বইয়ের পর বই হাতড়ে বেড়াতে হতো, তা এখন আঙুলের টোকায় ধরা দেয়। কিন্তু এতে কি নির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্রে জ্ঞানের আটকা পড়ার কায়দা বদলেছে? উপমহাদেশে এই সেদিন, মানে বছর পঞ্চাশেক আগেও বড় শহর থেকে দূরে বড় মাপের পণ্ডিতদের দেখা পাওয়া যেত। তাঁরা সেখানে বসেই মারাত্মক সব কাজ করে গেছেন। আবার কোটি টাকার প্রজেক্ট না পেয়েও চন্দ্রকুমার দে মৈয়মনসিংহ গীতিকাগুলো সংগ্রহ করে গেলেন। বাংলাদেশের বাস্তবতা কী বলে? ঢাকাসহ প্রধান শহরগুলোতেও এখন জ্ঞানচর্চা কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তির প্রতিষ্ঠার সঙ্গেই যুক্ত। কেন্দ্রের বাইরে নিয়ে আর বলার কিছু নেই।

ইসহাক সিদ্দিকী বাংলাদেশের দাসতন্ত্রের ইতিহাস নামে একটি বই লিখেছেন। এমন কাজ করে লেখক নিজে ব্যক্তি বা পেশাগত লাভ পাবেন, সে আশা নেই। রাজধানীকেন্দ্রিক বিভ্রম থেকে দূরে কুমিল্লা শহরের এই কবি ও আইনজীবী বিস্ময়কর রকম অনুসন্ধান করে বইটি লিখেছেন। এ প্রয়াস উপমহাদেশের আধুনিক যুগের আগের সেই কোমল গোঁয়ার্তুমির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই গোঁয়ার্তুমি ছাড়া বড় কাজ হয় না।

লেখক প্রস্তাবনাতে বলছেন, এখানকার ইতিহাসের আড়ালে প্রত্নবস্তুর মতো জেগে আছে দাসতন্ত্র। প্রস্তাবনা হিসেবে এই কথা বিশাল সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সামাজিক আচরণ সম্পর্কে না বোঝার অভিযোগ প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। এই অভিযোগ আসলে নৃতত্ত্ব থেকে সমাজতত্ত্ব পর্যন্ত অনেক জায়গাতে এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গভীর ধারাবাহিক অনুসন্ধানের ঘাটতির কারণেই উঠে আসে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সেদিকে মন দেয় না। তখন ইসহাক সিদ্দিকীর মতো গবেষকদের চেষ্টা মনে করিয়ে দেয় যে এ কাজ আসলে না করলেই নয়।

বইটি তিন পর্বে অনুসন্ধান করেছে—আর্য অনুপ্রবেশ, মুসলমান শাসন পর্ব এবং ইউরোপীয় পর্ব। লেখক বহাল থাকা লিখিত কাজের মধ্যেই নিজের অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন। প্রতিটি পর্বের, বিশেষ করে আর্যভাষী প্রাধান্যের কালে, শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে দাসপ্রসঙ্গ এসেছে। পরবর্তী কালগুলোর শাসনতান্ত্রিক নথি বেশি পাওয়া যায়। সেই সময়ের তথ্যও তাই অনেক বেশি নিরেট।

তবে গবেষণার, অথবা বলা যায় অনুসন্ধানের পদ্ধতি সম্পর্কে একটি ধারণা বইয়ের কোথাও থাকলে তা কাজে দিত। আরেকটি মৌলিক সমস্যা লেখক নিজেও অনুভব করেছেন। তার ইঙ্গিত তিনি জানিয়েছেন। বলা হচ্ছে বাংলাদেশের দাসতন্ত্রের কথা। কিন্তু দাসতন্ত্র বহাল থাকার কালে বাংলাদেশ বলে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। এখন যা বাংলাদেশ, তা একেক সময়ে একেক রাষ্ট্র বা প্রশাসনিক কাঠামোর অন্তর্গত ছিল। এখন যাঁরা বাংলাদেশের অধিবাসী, তাঁরা অনেকেই সাংস্কৃতিক পরিচয়ে তখন এমনকি বাঙালিও ছিলেন না। বাংলা না বাংলাদেশ? বইটি জুড়েই এ প্রশ্ন মীমাংসা না করে এগোনোর একটি ছাপ আছে।

কোনো ইতিহাস নিয়ে গবেষণা যখন বর্তমানের সঙ্গে প্রসঙ্গ টেনে কাজ করে, তখন এ রকম হয়। স্থানের পরিচয় ইতিহাসের সঙ্গে পাল্টায়। পাল্টায় সেই স্থানের মানুষের পরিচয়। এ রকম ক্ষেত্রে একটা সমাধান হতে পারে বহাল জনমানুষের সমাজে সংস্কৃতিতে উদ্দিষ্ট বিষয়ের প্রভাব বা অবশেষ অনুসন্ধান। ইসহাক সিদ্দিকীর তা এই বইয়ে করার কথা নয়। কিন্তু যে শ্রম তিনি এখানে ব্যয় করেছেন, সেই সাপেক্ষে এর কিছু ইশারা দিয়ে রাখলে পরের গবেষক ও আগ্রহী পাঠকের উপকার হতো।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। আজকের বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড অতীতে যতটা আর্য, তার চেয়ে অনেক বেশি বৌদ্ধচিন্তা–প্রভাবিত ছিল। সারা দেশে ছড়িয়ে আছে বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ। আজকের থেরবাদী শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারে, তিব্বতের বৌদ্ধদর্শনের জাগরণ ঘটেছে এই বাংলা থেকে। কিন্তু বৌদ্ধকাল আলাদা করে আলোচিত না হওয়া এই অনুসন্ধানের জন্য একটি ঘাটতি হয়ে চোখে পড়ে। লেখক নিজেও এর কোনো
সদুত্তর দেননি।

বাংলাদেশের দাসতন্ত্রের ইতিহাস

ইসহাক সিদ্দিকী

প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী, ঢাকা; প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০২৪;
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ; ১২৮ পৃষ্ঠা;
দাম: ৪০০ টাকা।

বই টি পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে