এক বর্ণাঢ্য জীবনচিত্র 

স্ত্রী শিরী হায়াতের সঙ্গে আবুল হায়াত

পুরকৌশলে স্নাতক আবুল হায়াত অভিনয়শিল্পকে গ্রহণ করেছিলেন অন্তর ও অন্দর থেকে, যেহেতু অভিনয়ে তাঁর হাতেখড়ি বাড়িতে, সেই স্কুলে পড়ার সময়, একটা চৌকিকে মঞ্চ বানিয়ে, তাতে একটা ‘নাটক’ নামিয়ে। শৈশবের ওই ঘটনাটি স্মরণীয় অভিনয় এবং অভিনয়সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতিকে তাঁর চিত্তবিকাশের একটি অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করে ভবিষ্যতের পথচলার উৎস চিহ্ন হিসেবে। আবুল হায়াতকে পরিবারের লোকজন ডাকতেন রবি নামে, যে রবি স্কুল-কলেজে পড়ার সময়েই আরেক রবির প্রভাববলয়ে ঢুকে পড়েন; এবং তাঁর সাহিত্যকর্মকে অনুপ্রেরণার একটা বড় অঞ্চল হিসেবে গ্রহণ করেন। জীবনের সায়াহ্নবেলায় পৌঁছে পেছন ফিরে তিনি তাঁর দীর্ঘ পথচলাকে দেখেছেন, এর বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে থাকা নানা ঘটনা আর অভিজ্ঞতার কাছে ফিরে গেছেন, স্মৃতির ধূসর অঞ্চল থেকে তাদের তুলে এনেছেন এবং এই চলায় কারা কতভাবে তাঁকে প্রস্তুত করেছেন এবং তাঁর সঙ্গে ছিলেন—অথবা প্রতিকূলতা তৈরি করেছেন—তার একটা খতিয়ান তিনি একটি বইয়ের সীমিত পরিসরে তুলে ধরেছেন। আত্মজীবনীমূলক এই বইটির নাম রবি পথ, যা এ বছর বাজারে এনেছে সুবর্ণ প্রকাশনী।

তিনি শুরু করেছেন, প্রত্যাশিতভাবেই, তাঁর পরিবার থেকে, তারপর তাঁর শৈশব-কৈশোর পার হয়ে এসেছেন যৌবনে। এবং ঘটনাবহুল যৌবনের অর্জন-বিসর্জন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির একটা নির্মোহ বর্ণনা দিয়েছেন। যদিও পাঠক বুঝতে পারেন, আবুল হায়াতের প্রাপ্তির হিসাবটা সব অপ্রাপ্তিকে ছাড়িয়ে গেছে। তাঁর বর্ণনাকে নির্মোহ বলার একটা কারণ, নাটকের ভাষায় বলতে গেলে, প্রধান চরিত্রের দৃষ্টিতে যতটা তাঁর ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন, পেশা ও অভিনয়জীবন এবং এগুলোর সমান্তরালে চলা আরও অনেক জীবনযাপনের ছবি তিনি তুলে ধরেছেন, তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য চরিত্রের ছবিগুলোও সমান একাগ্রতা নিয়ে এঁকেছেন। পাদপ্রদীপের আলোয় তিনি তাই একা নন। এ জন্য তাঁর আত্মজীবনী ‘আমি-প্রধান’ হয়নি—তাঁর বেড়ে ওঠার সময়, সমাজ ও ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর নিজের অবস্থান বা অর্জন থেকেও বেশি। আত্মজীবনীকে আমি সাধারণভাবে ‘লিটেরারি সেলফি’ হিসেবে দেখি। অ্যান্ড্রোয়েড ফোনে যাঁরা সেলফি তোলেন, তাঁরা প্রায়ই নিজের মুখ বা অবয়বকে প্রধান করে অন্যদের পেছনে ঠেলে দেন। এসব জীবনবর্ণনায় ব্যক্তির অহমিকাটা বর্ণনাকে নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার সুযোগ তেমন দেয় না। আবুল হায়াত রবি পথ লিখেছেন ১০ বছর সময় নিয়ে, ফলে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের যে প্রতিফলন বইটিতে আছে, তার একটা পূর্বাপর ক্রম যেমন আছে, তেমনি আছে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পারিবারিক, সামাজিক এবং জাতীয় ইতিহাসের একটি গতিধারাও। এই বড় ইতিহাসটি শুরু হয়েছে দেশভাগ থেকে এবং মুক্তিযুদ্ধ হয়ে এই সময় পর্যন্ত এটি চলমান। এই ইতিহাস তুলে আনতে গিয়ে তাঁর আবেগ যেমন সক্রিয়, তেমনি সক্রিয় জনমনে এর নানা অভিঘাত বর্ণনায়। বলা যায়, তাঁর জন্ম থেকে নিয়ে বাল্যকাল, স্কুল-কলেজের জীবন—যা কেটেছে চট্টগ্রামে—তারপর পুরকৌশল বিষয় পড়ার জন্য বর্তমানের বুয়েটে ভর্তি হওয়া, তাঁর হলজীবন, পাস করে বেরোনোর পর চাকরিতে যোগ দেওয়া, বিয়ে করে সংসারী হওয়া, সন্তানের বাবা হওয়া, একসময় উন্নত একটি চাকরি নিয়ে লিবিয়ায় কিছুকাল পরিবার নিয়ে কাটানো, আবার দেশে ফেরা এবং মঞ্চ, টিভি, রেডিও, চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে খ্যাতিমান হওয়া—প্রতিটি পর্যায় যতটা পেরেছেন সঠিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

আবুল হায়াত একজন প্রতিষ্ঠিত ছোট গল্পকার। ‘ছোট ছোট দুঃখ কথা’ যেগুলো আবার নিতান্ত সহজ-সরলও নয়—নির্মেদ ও স্বচ্ছন্দ গদ্যে তুলে ধরতে তিনি পারঙ্গম। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর তীক্ষ্ণ রসবোধ এবং সেই রসবোধকে আরও উপভোগ্য করে নিজেকে নিয়ে তাঁর কৌতুক করার কুশলতা। ফলে রবি পথ একবার হাতে নিলে শেষ না করে রাখা যায় না। চরিত্রায়ণে তাঁর দক্ষতা আত্মজীবনীকে জীবন্ত করেছে। সেই স্কুলজীবনের বন্ধু নাট্য অভিনেতা জামালউদ্দিন হোসেনের মতো তাঁর শিক্ষা ও পেশাজীবনের বন্ধু ও পরিচিতদের তিনি যে আন্তরিকতা দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি তুলেছেন তাঁর পেশা ও অভিনয়জীবনের সব সহকর্মী ও সতীর্থদের। সব বর্ণনাই যে সুখকর, তা নয়, তবে আবুল হায়াতের বড় গুণ হলো ভালো-মন্দ সব নিয়ে চরিত্রের যোগফলটা আকর্ষণীয় করতে পারা।

সবচেয়ে বড় হয়ে যা দেখা যায় বইটাতে, তা হলো, লেখকের পরিবারের—জন্ম থেকে যে বৃহত্তর পরিবার তাঁকে সংজ্ঞায়িত করেছে, যাতে বড় দুই চরিত্র তাঁর বাবা–মা; এবং স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে তাঁর যে পরিবার—তার আবেগপ্রবণ চিত্রায়ণ। রবি পথ-এর কাহিনি শুরু হয়েছে গল্পের আদলে দুই চরিত্র দিয়ে, একজন সালু মিয়া, অন্যজন শানু বিবি। দেশভাগের সময় তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে চট্টগ্রামে চলে আসেন, সালু মিয়া যেহেতু রেলওয়েতে চাকরি করতেন। ওই দুজন আসলে তাঁর বাবা-মা, যাঁদের কাছে তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তাঁদের সঙ্গে আবুল হায়াত স্মরণ করেছেন তাঁর পূর্বপুরুষদের, তাঁর বোনদের, বৃহত্তর পরিবারের অনেককেই। চট্টগ্রামের টাইগার পাস রেলওয়ে কলোনি তাঁর জীবনের এক বড় অংশজুড়ে আছে, যেমন আছে লিবিয়ার প্রবাসজীবন। তাঁর স্ত্রী, যিনি তাঁর লেখায় এসেছেন শিরী নামে, তাঁর দুই কন্যা বিপাশা ও নাতাশা আছেন তাঁর বর্ণনার হৃদয়জুড়ে। আর আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এবং বাকি ইতিহাস।

বইটি নিঃসন্দেহে সংগ্রহে রাখার মতো।

রবি পথ

আবুল হায়াত

প্রকাশক: সুবর্ণ, ঢাকা; প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০২৪; প্রচ্ছদ: বিপাশা হায়াত; ৩০৪ পৃষ্ঠা; দাম: ৯০০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে