তখন জোসেফ স্তালিনের শাসনামল। বাংলাদেশের এক কমিউনিস্ট বিপ্লবী গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীকে নির্মমভাবে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যা করা হলো সোভিয়েত ইউনিয়নে। এই অন্যায় মৃত্যু সম্পর্কে এতকাল ভাসা–ভাসা আলোচনা থাকলেও বিশদ কিছু তেমনভাবে জানা যায়নি। তবে গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী: এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি বই সূত্রে বাংলার এই কীর্তিমান বিপ্লবী আবার আলোয় এসেছেন। নতুনভাবে আলোচিত হয়েছে উপনিবেশিত ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে সেই সময়ের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘মুকুটরত্ন’খ্যাত ভারতের মতো এত বিশাল ও বিস্তৃত পরিসরে দেশে ও দেশের বাইরে বিরাট ক্যানভাসে স্বাধীনতার সংগ্রাম মনে হয় আর কোনো উপনিবেশের স্বাধীনতার জন্য করতে হয়নি। দেশের মাটিতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ও আত্মোৎসর্গকারী বীর সংগ্রামীদের সম্পর্কে কমবেশি আলোচনা হয়ে থাকে। তবে ভারত উপমহাদেশের বাইরে ইউরোপ–আমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা জায়গায় ভারতীয় বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের কাহিনি অনেকাংশেই কম চর্চিত। প্রবাসে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য বহুল পরিচিত বাঙালি বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র বসু। কিন্তু তাঁর অনেক আগেই ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ইউরোপপ্রবাসী বহু বিপ্লবী নানা রকম চেষ্টা–তদবির করছিলেন। প্রথমে জার্মানি, পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় তাঁরা চেষ্টা করছিলেন ভারতকে ব্রিটিশ শাসনের জোয়াল থেকে মুক্ত করতে। গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী: এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি বই থেকে আমরা জানতে পারি সিরাজগঞ্জের এই বিপ্লবীর বর্ণাঢ্য জীবন ও নানামুখী কর্মতৎপরতার কথা। বইয়ের লেখক সাংবাদিক মতিউর রহমান এই বই রচনা করতে গিয়ে যেন গবেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে তিনি গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর জীবন ও কর্ম নিয়ে খোঁজ করে যাচ্ছিলেন। ১৯৮১ সালে দিল্লিতে বিজ্ঞানী ও কমিউনিস্ট নেতা ড. গঙ্গাধর অধিকারীর কাছ থেকে প্রথম লুহানী সম্পর্কে জানতে পারেন। ড. অধিকারী ছিলেন একজন গুণী গবেষক। তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস নিয়ে বেশ কয়েক খণ্ডের বই লিখতে গিয়ে লুহানীর নানা রকম কাজ সম্পর্কে জানতে পারেন। ড. অধিকারী ১৯২৯ সালে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর মুক্তি চেয়ে ব্রিটিশ সরকারের ভারত সচিবকে চিঠি লিখেছিলেন স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইন।
১৯৮১ সাল থেকেই এই বইয়ের লেখক লুহানীকে নিয়ে অনুসন্ধান করে যাচ্ছেন। বার্লিন, মস্কো, দিল্লি, কলকাতাসহ নানা জায়গায় তিনি লুহানী সম্পর্কে যেখানে যা পেয়েছেন, তা জোগাড় করার চেষ্টা করেছেন। সবকিছু হয়তো জোগাড় করতে পারেননি, কিন্তু বিপুল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত অনালোচিত একজন বিপ্লবী সম্পর্কে যত কিছু তিনি হাজির করেছেন, তা–ও বিস্ময়কর। লুহানীর কর্মব্যস্ত জীবন শুধু নয়, এই বইয়ে উঠে এসেছে তাঁর পারিবারিক জীবনের নানা ঘটনা ও জোগাড় করেছেন প্যারিস থেকে মায়ের কাছে লুহানীর লেখা চিঠিপত্র, শাশুড়ির কাছে লুহানীর স্ত্রী ফরাসি মডেল ও ফ্যাশন ডিজাইনার গ্যাব্রিয়েলের লেখা চিঠিপত্র, লুহানীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তৎকালীন এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও শিপিং এজেন্সির সঙ্গে লুহানীর ভাই ও মায়ের যোগাযোগ ইত্যাদি নানা রকম দলিল।
মতিউর রহমান কতটা দীর্ঘ সময় এই বইয়ের পেছনে লেগে আছেন, তা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকে। আশির দশকের মাঝামাঝি মস্কোয় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ভারতবিশেষজ্ঞ রুশ লেখক লিওনিদ মিত্রোখিনের। তারও অনেক পরে ১৯৯১ সালে দিল্লি থেকে প্রকাশিত সোভিয়েত ল্যান্ড পত্রিকায় মিত্রোখিন লুহানীসহ আরও দুই বাঙালি বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও অবনী মুখার্জি সম্পর্কে দুই কিস্তিতে বড় একটি লেখা লিখেছিলেন। মস্কোয় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই তিন বিপ্লবীরই শিকড় আমাদের বাংলাদেশে। সেই দীর্ঘ লেখার শেষে মিত্রোখিন লিখেছিলেন, মতিউর রহমান লুহানীকে নিয়ে বই লেখার পরিকল্পনা করছেন। বইটি লুহানীর জীবন ও কর্মকাণ্ড নিয়ে নতুন কিছু অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালে এসে বহু পরিশ্রমের ফসল এই বই আলোর মুখ দেখল।
বইটি থেকে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ থেকে এন্ট্রান্স (তৎকালীন মাধ্যমিক পরীক্ষা) পাস করার পর ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী। এরপর ১৯১৪ সালে তিনি ভর্তি হন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সে। বাংলাদেশের তারকা ব্যক্তিত্ব ফতেহ লোহানী, ফজলে লোহানী ও তাঁদের বোন হুসনা বানু খানমের মামা ছিলেন এই লুহানী। ফজলে লোহানীর সূত্র ধরেই লেখকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে লুহানীর ভাতিজা মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদের। তাঁর কাছ থেকেই পারিবারিক চিঠিপত্র জোগাড় করেছেন লেখক।
২০২৪ সালের মে মাসে জুলিয়া বডেউইন নামে নিউইয়র্কের এক শিল্প–গবেষক মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে লুহানীর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েল সম্পর্কে জানতে চান। সেই সূত্র ধরে জানা যায় যে লুহানীর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েল ছিলেন বিখ্যাত ইতালীয় শিল্পী আমেদেও মোদিলিয়ানির মডেল। মোদিলিয়ানি তাঁর একটি ড্রয়িং এঁকেছিলেন। এ ছাড়া ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী রজার ফ্রাই এঁকেছিলেন গ্যাব্রিয়েলের একটি প্রতিকৃতি। ১৯১৯ সালে লন্ডনে তাঁদের বিয়ের দিন–তারিখ ঠিক করা একটি দলিলও পাওয়া যায়। অনেক নাটকীয় কিন্তু বাস্তব এসব কাহিনি জানা যায় এই বই থেকে।
লেখকের সংগৃহীত বিভিন্ন দলিল থেকে দেখা যায়, লুহানী সে সময় লন্ডনে শ্রমিক আন্দোলন ও সোভিয়েত বিপ্লবের পক্ষে কাজ করেছেন। সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতা করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। ১৯২০ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে কাজ করেছেন। এসব দেশের পত্রপত্রিকায় তিনি ভারতের রাজনৈতিক ও শ্রমিক আন্দোলনের পক্ষে লেখালেখি করেছেন। ইংরেজি ছাড়া ফরাসি, জার্মান, ফারসি ও হিন্দি ভাষা বলতে ও পড়তে পারতেন তিনি।
১৯২১ সালে একবার মস্কোয় গেলেও ১৯২৫ সালের অক্টোবরে লুহানী স্থায়ীভাবে পাড়ি জমান মস্কোয়। ১৯২৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। আর ১৯৩৩ সালে পান সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিকত্ব। এই পুরো সময় তিনি সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কেন্দ্র কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে (কমিন্টার্ন) বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। সাংবাদিকতা, অনুবাদ, গবেষণা ও শিক্ষকতা করেছেন কমিন্টার্নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনে। বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত দলিল ও বইপত্রের বরাতে লুহানীর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে বইটিতে।
লুহানী ছাড়া সে সময় বার্লিন ও রাশিয়ায় ভারতীয় বিপ্লবীদের নানামুখী তৎপরতার বর্ণনা পাওয়া যায় এখানে। ‘নাইটিঙ্গেল অব দ্য ইস্ট’ হিসেবে পরিচিত সরোজিনী নাইডুর ভাই বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও পাণ্ডুরাজ খানখোজের সঙ্গে মিলে লুহানী ১৯২১ সালে ‘ভারত ও বিশ্ববিপ্লব’ শিরোনামে একটি থিসিস লিখে পাঠান রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিনের কাছে, যার উত্তরও দিয়েছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম নেতা।
সোভিয়েত গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বরাতে এই বই থেকে জানা যায়, সে সময় লুহানীকে নিয়ে নানা সন্দেহ–অবিশ্বাস দানা বাঁধতে থাকে। ভিন্নমতের দায়ে স্তালিনের আমলে অনেককেই সোভিয়েত ইউনিয়নে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। লুহানীও রেহাই পাননি সেই ভয়াল পরিণতি থেকে। তৎকালীন পূর্ব বাংলার সিরাজগঞ্জ থেকে গিয়ে ইউরোপের নানা শহরে কর্মব্যস্ত লুহানীকে স্তালিনের শাসনামলে রুশদেশে ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর নিছক সন্দেহের বশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও পরবর্তীকালে ১৯৫৭ সালে সেই বিচার ভুল ছিল বলে লুহানীর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ তুলে নিয়েছিল সোভিয়েত সুপ্রিম কোর্টের সামরিক কলোজিয়াম। এরপর তাঁকে মরণোত্তর সসম্মান পুনর্বাসিতও করা হয়েছিল।
সুলেখনী ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য লুহানী সুবিদিত ছিলেন। বইয়ে স্থান পাওয়া লুহানীর প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং অন্য লেখাগুলোর তালিকা থেকে বোঝা যায় তাঁর লেখার হাত কেমন ছিল। বিপ্লবী এম এন রায় থেকে শুরু করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাইয়ের নাতি সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত তাঁর বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা না করে পারেননি।
জীবন ও কর্ম ছাড়া বইটির প্রথম অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে লুহানীর পারিবারিক চিঠিপত্র, নিজ হাতে লেখা জীবনবৃত্তান্ত, সোভিয়েত কর্তৃপক্ষকে লেখা তাঁর চিঠিপত্র, লুহানীকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের চিঠি আদান–প্রদান এবং এই বিপ্লবীর মতো একই ভাগ্য বরণ করা আরও দুই বাঙালি বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও অবনী মুখার্জির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পাণ্ডুরাজ খানখোজে ও লুহানীর ‘ভারত ও বিশ্ববিপ্লব’ শিরোনামের থিসিসের বাংলা অনুবাদ স্থান পেয়েছে।
তৃতীয় অধ্যায়ে লুহানীর লেখা বেশ কিছু প্রতিবেদন ও নিবন্ধ ইংরেজি ও রুশ ভাষা থেকে অনুবাদ করে যুক্ত করা হয়েছে। শেষ অধ্যায়ে রয়েছে সে সময়ের বিপ্লবীদের ভাবাদর্শগত পটভূমি নিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেনের একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখা।
এ ছাড়া লিওনিদ মিত্রোখিনের ‘আ ট্রিপল ট্র্যাপ’ নিবন্ধটি অনুবাদ করে যুক্ত করা হয়েছে। সবশেষে রয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কমিন্টার্ন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্তের সঙ্গে মতিউর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার। এতে সে সময়ের বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড, কমিন্টার্ন এবং সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন দুজন। এ ছাড়া বেশ কিছু দুর্লভ ছবি যুক্ত করার মধ্য দিয়ে বইটি সামগ্রিকতা পেয়েছে।
এই বইয়ের মাধ্যমে পাঠক এক বাঙালি বিপ্লবীর মর্মান্তিক কাহিনি সম্পর্কে যেমন জানতে পারবেন, তেমনি জানা যাবে সে সময়ের বিপ্লবীদের অসমসাহসী কর্মকাণ্ড আর ত্যাগের পরিক্রমা। পাশাপাশি আছে তৎকালীন ইতিহাসের কম আলোচিত কিন্তু বাঁকবদলের আরও বেশ কিছু ঘটনা।
বইটি উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী: এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি
মতিউর রহমান
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০২৪; প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল; ২৯৬ পৃষ্ঠা; দাম: ৬০০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com
এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে