‘কখনো আমার মাকে’ এবং জীবনের ফেলে আসা অতীত
কান্না আছে সুখের, কান্না আছে বেদনার। জীবনের পরতে পরতে সাজানো, শিশু থেকে প্রৌঢ়, আনন্দ-হাসি-বেদনার ধারাপাত। এর কোনো ব্যত্যয় নেই। আছে কি? বাবার সততা, বাবার দায়িত্ব; মায়ের শাসন-আদর-ভালোবাসা সফল জীবনের গাথা।
সন্তানের সাফল্যে গর্বিত মা, সন্তানের কষ্টে আড়ালে-আবডালে নীরবে আঁচলে চোখ মোছেন মা। মায়ের আঁচল সন্তানের নির্ভরতার ছায়া। আমার মা আমার স্বর্গ। এ কথাগুলো আমরা সবাই জানি, মানি কি না–মানি। তবু বারবার, আবার নতুন করে মনে পড়ছে এ কথাগুলো বরেণ্য কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের ‘কখনো আমার মাকে’ উপন্যাসটি পড়ে।
লেখক তাঁর স্মৃতির পাটাতন খুলে তুলে এনেছেন মায়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সন্তানের সাফল্যের সোপান। ফুটিয়ে তুলেছেন আধুনিকতার ছোঁয়াহীন, বিদ্যুৎবিহীন কুপিবাতির যুগের গ্রাম্য আবহপরম্পরায় শহুরে জীবনের পর্বাপর্ব।
এই হৃদয়ছোঁয়া উপন্যাসটি পড়ে বিচরণ করলাম নিজের ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের সোনালি অতীতে। আমার গ্রামের তেপান্তরের মাঠ বলতে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র অপু-দুর্গা যেমন কাশবন, মাঠ, বিল-জলা পেরিয়ে দেখতে গিয়েছিল যাত্রীবাহী বগি নিয়ে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলা রেলগাড়ি, সেভাবে না হলেও দাপিয়ে বেড়াতাম ভয়হীন ফসলের মাঠ, খাল–বিল, যেন এক উড়ন্ত প্রজাপতি। কোনো দিন স্কুলে যেতে অনীহা থাকলেও বৃষ্টির দিনে স্কুলে যাওয়ার তাড়া থাকত ততোধিক, স্যার ও মা-বাবাকে দেখানো যে আমি পড়াশোনায় কত আগ্রহী আর মনোযোগী।
দড়ি দিয়ে বই-খাতা বেঁধে প্লাস্টিকে মুড়িয়ে ছাতা না পেলে মানকচুর পাতা মাথায় দিয়ে স্কুলে যাওয়ার মজাটা ছিল খুব আনন্দের। আমি যখন ক্লাস টুতে পড়ি, স্যার একদিন ১৮ ও ১৯-এর ঘরের নামতা পড়তে দিলেন। আমি পরের দিন স্কুলে গেলাম ১৮-এর ঘরের নামতা মুখস্থ করে, ১৯-এর ঘরের নামতা মুখস্থ হয়নি। স্যার ক্লাসে এসে বললেন, কার কার পড়া হয়েছে? সবাই চুপ করে থাকল। আমি দাঁড়িয়ে বললাম, স্যার, আমার ১৮-এর ঘরের নামতা মুখস্থ হয়েছে। স্যার বললেন স্কুলের পেছন থেকে দুটি ছিকটি তুলে আনতে।
আমি মনের আনন্দে ভালো দেখে দুটি ছিটকি তুলে আনলাম, যাতে মার লাগে খুব করে। মনে করেছিলাম, আমি তো আর মার খাব না। ছিটকি দুটি স্যারের সামনের টেবিলে রেখে বেঞ্চে নিজের সিটে বসার জন্য এগিয়ে যেতেই স্যার দাঁড়াতে বললেন। যেই না ঘুরে দাঁড়িয়েছি, অমনি স্যার জোড়া ছিটকি হাতে সপাসপ দুটি বাড়ি বসিয়ে দিলেন আমার পিঠে। ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম, কুঁকড়ে গেলাম।
এই হৃদয়ছোঁয়া উপন্যাসটি পড়ে বিচরণ করলাম নিজের ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের সোনালি অতীতে। আমার গ্রামের তেপান্তরের মাঠ বলতে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র অপু-দুর্গা যেমন কাশবন, মাঠ, বিল-জলা পেরিয়ে দেখতে গিয়েছিল যাত্রীবাহী বগি নিয়ে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলা রেলগাড়ি, সেভাবে না হলেও দাপিয়ে বেড়াতাম ভয়হীন ফসলের মাঠ, খাল–বিল, যেন এক উড়ন্ত প্রজাপতি।
স্যার আর কাউকে মারলেন না। পরদিনের জন্য আবার আগের পড়া দিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেন। আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছিল। সেদিন বিকেলেই বাজারে স্যারকে দেখে দূর দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু স্যার নিজে এসে হাত ধরে বাজারের অস্থায়ী চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে নিজ হাতে দুটি সন্দেশ খাইয়ে দিলেন। আর বললেন, ‘খুব ব্যথা পেয়েছিলি রে?’ আমি মাথা ওপর-নিচ করলাম। স্যার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোর ১৯-এর ঘরের নামতা পড়া হয়নি শুনে খুব রেগে গিয়েছিলাম।’ আরও বললেন, ‘প্রতিদিন পড়া ঠিকভাবে পড়ে আসবি, আর যেন কোনো দিন না শুনি তোর পড়া হয়নি।’ আমার সেই লুৎফর স্যার প্রয়াত অনেক দিন। আজ এই বইটি পড়ে খুব মনে পড়ছে স্যারের কথা।
মনে পড়ছে গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, আয়রে আয় টিয়ে, কানামাছি ভোঁ–ভোঁসহ আনন্দময় গ্রামীণ সেই খেলাগুলোর কথা। স্কুলের টিফিনের সময় বা কোনো খেলার ফাঁকে প্রস্রাব করার সময়ও ছিল আমাদের কঠিন প্রতিযোগিতা। কয়েকজন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতাম আর এতে প্রতিযোগিতার বিষয়, কার প্রস্রাব কত দূরে গিয়ে পড়ে। কানশিসার মধু খাওয়ার প্রতিযোগিতায়ও মেতে উঠতাম খেলার সাথিরা মিলে। বর্ষাকালে যখন বাড়ির চারদিকের মাঠ, ডোবা, খাল পানিতে থই থই করত, সমবয়সী বন্ধুরা গরম থেকে রেহাই পেতে ডুবসাঁতারে মেতে উঠতাম। কখনো কখনো এই জলকেলি এত সময় ধরে চলত যে চোখ লাল হয়ে পিঁচুটি বেরিয়ে যেত। বড় ভাইয়ের দাবড়ানি খেয়ে উঠে আসতাম পানি থেকে। মাছ ধরার নেশাও নেহাত কম ছিল না। খেলতে গিয়ে কখনো কোথাও কেটে গেলে বা ছড়ে গেলে দূর্বাঘাস চিবিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলে অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করত। আরও কত স্মৃতি ভেসে উঠছে মনবাতায়নে ‘কখনো আমার মাকে’ বইটি পড়ে।
ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন। রাতে কুপিবাতি জ্বালিয়ে পড়তে বসেছি। তখন মাত্র বসতে শেখা ছোট বোনকে আমার পাশে বসিয়ে মা রান্না করছিলেন পাকঘরে। হঠাৎ আমার বোনটি হামা দিয়ে কুপিবাতির আগুন মুঠি করে ধরেই বিকট চিৎকার। বাতি নিভে যায়। চিৎকার শুনে মা ছুটে আসেন অন্ধকার ঘরে। বোনটিকে কোলে তুলে নেন। ভাগ্য ভালো, ফোসকা পড়েনি হাতে, তবে লাল হয়ে গিয়েছিল। মা একচোট নিয়েছিলেন আমার ওপর। আজও মনে হলে চোখ ভিজে আসে, সেই বোনটি আমার এক বছর বয়সেই মারা যায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। তখনো আমার কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী থানার সীমান্তঘেঁষা অজপাড়াগাঁয় আধুনিক চিকিৎসার ছোঁয়া লাগেনি। সে সময়ে ভরসা ছিল হোমিও ও হাতুড়ে ডাক্তার। এই বইটি পড়ে স্বার্থপরের মতো নিজের অতীত স্মৃতির ঝাঁপির ঢাকনা খুলে বসেছি।
লেখক ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার বিষয়ে মায়ের যে কঠোরতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, এ অভিজ্ঞতা আমার মনে হয় কমবেশি সবার আছে। মাকে পড়া দিতে না পারলে হাতের কাছে যা পেতেন, তা-ই দিয়ে পিঠে ঝড় বইয়ে দিতেন। তখন মাকে নিজের মা বলে মনে করতে কষ্ট হতো। আবার যখন আদর করে নিজ হাতে খাইয়ে দিতেন, স্কুলের জন্য তৈরি করে দিতেন, তখন মনে হতো আমার মায়ের মতো ভালো মা আর কারও নেই।
শিশুকালে আমার মনকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল কল্পিত প্রেমের হলুদ ফুল। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের ‘কখনো আমার মাকে’ উপন্যাসের চরিত্র মাবলুর মতো। তবে মজার ব্যাপার হলো, পছন্দ করতাম আমার চেয়ে অনেক বড় কোনো আপুকে। নিজের চেয়ে ছোট কাউকে নয়। ধুলোবালি দিয়ে খেলতাম কত বর-বউয়ের সংসার খেলা। মনে মনে চলে যেতাম কোনো রাজকন্যার স্বপ্নমহলে। মাবলুর শিশুকালকে কিছুটা নিজের শিশুকালের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলতে ভালো লাগছে।
লেখক দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ভাইবোনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের বিষয়টি। এমনভাবে বিষয়টি ফুটিয়ে তুলেছেন, যেন ভাই ভাইয়ের জন্য সবকিছু করতে মরিয়া, যা আজকাল সেভাবে চোখে পড়ে না। এ প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের জন্য অনুকরণীয় শিক্ষাকবচ এই বইটি। সহজ শব্দচয়নে ছোট ছোট বাক্যে লেখা এই উপন্যাস বোদ্ধা পাঠকদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা শিকড়ে।
মুক্তিযোদ্ধা সার্কেল অফিসার একজন অন্তঃসত্ত্বা বীরাঙ্গনাকে বিয়ে করে যে মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা সমীহজাগানিয়া; যদিও তিনি বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, সরলপ্রাণ নিঃসন্তান বড় বউ তাঁর দ্বিতীয় বিয়েকে সহজভাবে নেবেন। হয়েছেও তা-ই। তিনি হয়ে উঠেছেন সতিনের প্রিয় বড় বোন, সহনশীলতার মূর্ত প্রতীক। তিনি সব সন্তানের প্রিয় বড়মা হয়ে ছিলেন আমৃত্যু। এই সার্কেল অফিসারের মতো অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও যদি মহানুভবতার পরিচয় দিতেন, তাহলে অগণিত যুদ্ধশিশুকে দেশে-বিদেশে অনাথাশ্রমে কিংবা দত্তক হয়ে পিতৃমাতৃহীন বেড়ে উঠতে হতো না। হানাদার বাহিনী আর এদেশীয় কুলাঙ্গার রাজাকার-আলবদর বাহিনীর পাপের দায় বহন করতে হচ্ছে যুদ্ধশিশু আর বীরাঙ্গনা মায়েদের। জাতি হিসেবে এ বড় লজ্জার, মর্মযাতনার।
অন্যদিকে সততার পুরস্কার পেলেন না মুক্তিযোদ্ধা সার্কেল অফিসার, পেলেন তিরস্কার। প্রভাবশালীর নষ্টক্রোধে গ্রেপ্তার হতে হয় তাঁকে, চলে যায় চাকরি। অপমান সইতে পারলেন না তিনি। তাই হয়তো অসময়ে নষ্ট সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাড়ি জমালেন না-ফেরার দেশে। তাঁর মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধা আজও দুষ্ট-লোভী প্রভাবশালীর নিগ্রহের শিকার। কে রাখে সে খবর! লেখক এখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন বীরাঙ্গনার জীবনালেখ্য রচনা করে আত্মত্যাগী নিগৃহীত সব মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন।
সার্কেল অফিসারের বড় ছেলে যুদ্ধশিশু বাবলু কিন্তু জানত না তার জন্মপরিচয়। সে জানত, সার্কেল অফিসার রফিকুর রহমানই তার বাবা। কিন্তু সমাজে তো দুষ্টলোকের অভাব নেই। কেউ একজন গোপনে গ্লানিময় দুঃসহ অতীত তার সামনে নিয়ে আসে। না হলে সে হয়তো জানতেও পারত না এই নির্মম ইতিহাস। সে মুষড়ে পড়ে, কিন্তু ভেঙে পড়েনি। মায়ের কাছে কখনো এ বিষয়ে জানতেও চায়নি। বরং বাবার মৃত্যুর পর কাঁধে তুলে নেয় সংসার ও ছোট ভাইবোনদের মানুষ করার কঠিন দায়িত্ব। ম্যাট্রিক পাস করেই সে চাকরি নিয়ে চলে যায় ঢাকায়। এতে ভাইবোনদের লেখাপড়া হয় নির্বিঘ্ন এবং নিজেও লেখাপড়া চালিয়ে যায় নাইট কলেজে। এমন সন্তান আজ বাংলার ঘরে ঘরে প্রয়োজন। লেখক পরোক্ষে এ বিষয়টির প্রতিও ইঙ্গিত দিয়েছেন। ছোটমার তত্ত্বাবধান আর বাবলুর ত্যাগে তার অন্য ভাইবোনেরা লাভ করে সমাজের মর্যাদার আসন। লেখকের আশা, এমন পরিবার হোক সমাজের প্রতিটি পরিবার।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছোটমা তাঁর সব ছেলেমেয়ের সামনে অকপটে বলে যান যুদ্ধদিনের নির্মম ঘটনাপ্রবাহ। তাদের হাতে তুলে দেন নিজের লেখা ডায়েরি। এমন সময় মুক্তিযোদ্ধা রফিকুর রহমান বীরাঙ্গনা আইনুন নাহারকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, যখন আইনুনের বাবা অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করেন। অন্যদিকে রফিকুর রহমানকেও বীরাঙ্গনাকে বিয়ে করার কারণে ত্যাজ্য করেন তাঁর বাবা আবদুর রহমান। সেই থেকে তাঁরা শিকড়ছিন্ন হয়ে ফুলপুরে গড়ে তোলেন আপন নিবাস। লেখকের মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাঠে চোখ ভিজে যায়। লেখক কিন্তু কাঁদাতে চাননি পাঠকদের। পাঠকেরাই কেঁদে ওঠেন কষ্ট-দংশনে।
না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান ছোটমা। সর্বংসহা বাবলু ভাইবোনদের বলে, ‘তোরা কি বিশ্বাস করেছিস ছোটমার কথা? তাঁর কথা সত্য নয়, তিনি সব বানিয়ে বানিয়ে বলেছেন। রোগের প্রকোপ আর ওষুধের প্রভাবে তিনি এমনটা বলেছেন।’ বাবলুর এ কথা বলার অর্থ হলো, কেউ যেন ছোটমার কথা শুনে তার থেকে দূরে সরে না যায়। ভাইবোন সবাই যে তার বড় আপন। তার বেঁচে থাকার অবলম্বন।
‘কখনো আমার মাকে’ উপন্যাসটি উপহার দিয়ে আমার মতো অগণিত পাঠককে আনিসুল হক ঋণী করলেন।
কখনো আমার মাকে
আনিসুল হক
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
দাম: ৫৫০ টাকা।