কী আছে সালমান রুশদির শেষ উপন্যাসে
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক সালমান রুশদির নতুন উপন্যাস ভিক্টোরি সিটি। ইতিহাসের আড়াল থেকে এখানে উঁকি দিয়েছে দক্ষিণ ভারতের এক ভুলে যাওয়া বাস্তবতা।
পম্পা কম্পনা—এই নামের সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। পরিচিত থাকার কারণও অবশ্য নেই। কেননা, পম্পা কম্পনা হলো একজন লেখকের সৃষ্টি একটি চরিত্র, যেসব চরিত্রের দেখা মেলে গল্প-উপন্যাস পড়ার সময়। বাস্তব জীবনে সেই অর্থে তাদের উপস্থিতি না থাকলেও লেখকের বলিষ্ঠ উপস্থাপনার কারণে রক্তমাংসের মানুষের চেয়েও অনেক বেশি করে নিজেদের মনের মানুষ হিসেবে কখনো আমরা এসব চরিত্রকে গ্রহণ করি। সব লেখকই যে সে রকম চরিত্র সৃষ্টিতে পারদর্শী, তা নয়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশেষ কোনো গল্প-উপন্যাস পড়ার পর মনে কোনো রকম দাগ না রেখে অল্প সময়ের মধ্যে হারিয়ে যায়।
অন্যদিকে ভেনিসবাসী ওথেলো, নাতাশা রস্তোভা, জান ভালজান কিংবা গ্রেগর সামসার মতো চরিত্রগুলো শতাব্দী পেরিয়েও থেকে যায় মানুষের মনের আয়নায়। লেখক হিসেবে কে কতটা সফল আর সময়োত্তীর্ণ, তার একটি মানদণ্ডরূপে একে মনে হয় দেখা যেতে পারে। পম্পা কম্পনা সে রকম একটি চরিত্র হলেও যে উপন্যাসে তার উল্লেখ, সেটি পড়ার পর মনে হবে, চরিত্রটি আমাদের কত কাছের মানুষ! ইংরেজি সাহিত্যে বর্তমান সময়ের নেতৃস্থানীয় ঔপন্যাসিক সালমান রুশদি তাঁর সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস ভিক্টোরি সিটির শুরুতে এই নারী চরিত্রের যে পরিচিতি আমাদের দিচ্ছেন, তা এ রকম:
‘জীবনের শেষ দিনটিতে যখন তিনি ছিলেন ২৪৭ বছর বয়সের বৃদ্ধা, অন্ধ কবি, অলৌকিক সব আখ্যানের মুখ্য চরিত্র ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা পম্পা কম্পনা সেদিন বিসনাগা রাজ্যকে নিয়ে লেখা তাঁর বিশাল বর্ণনামূলক মহাকাব্য রচনা শেষ করেন এবং ভবিষ্যতের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটি বার্তা হিসেবে গলানো মোম দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া মাটির পাত্রে সেটি রাখেন, ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাজপ্রাসাদ চত্বরের ঠিক মাঝখানে মাটিচাপা দিয়ে রাখেন।’
ঔপন্যাসিক এরপর আমাদের বলছেন, ৪৫০ বছর পর আমরা সেই পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাই। ২৪ হাজার কাব্যের সমন্বয়ে সংস্কৃত ভাষায় লেখা মহাভারত–এর মতো দীর্ঘ, অমর সেই সৃষ্টি ‘জয়–পরাজয়’ পাঠ করে ইতিহাসের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা সমৃদ্ধ এক সাম্রাজ্যের গোপন সব ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারি। আর সেসব ঘটনার চমৎকার বর্ণনার পাশাপাশি পম্পা কম্পনার জীবনের কথা আমাদের শুনিয়েছেন বরেণ্য এই ঔপন্যাসিক তাঁর সর্বশেষ উপন্যাসে।
গত জুন মাসে প্রকাশিত সালমান রুশদির উপন্যাস ভিক্টোরি সিটির কাহিনির সবটা জুড়ে আছে কাল্পনিক সেই চরিত্র পম্পা কম্পনার জীবনের উত্থান-পতনের কাহিনি। তবে মূল চরিত্র লেখকের কল্পনায় তৈরি হলেও কাহিনির পটভূমির সবটাই হলো দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসের অংশ। বিপরীতমুখী দ্বৈত বাস্তবতা এবং এর চমৎকার সমন্বয় উপন্যাসটিকে করে তুলেছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়, বাস্তবমুখীও।
মানবজীবন কখনোই পম্পা কম্পনার মতো এতটা দীর্ঘস্থায়ী নয়। অকল্পনীয় সেই আয়ুষ্কালই যে এই নারী পেয়েছিল, শুধু তা–ই নয়, কাহিনির ভেতরে প্রবেশ করার পর আমরা আরও জানতে পারি, দীর্ঘ সেই জীবনের প্রায় সবটা জুড়ে অক্ষত ছিল তার যৌবন, সে পেয়েছিল একের পর এক রাজা আর ধর্মগুরুদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। তবে এ সত্ত্বেও জীবনের কঠিন বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়া পম্পা কম্পনার পক্ষে সম্ভব হয়নি। যখন তার বয়স মাত্র ৯ বছর, তখন থেকেই ‘জীবন যে কঠিন’—এই সত্য বুঝতে শুরু করে সে।
পিতা অর্জুন কম্পনার মৃত্যুর সময় পম্পা ছিল একেবারেই শিশু। তাই পিতার কোনো স্মৃতি তার মনে নেই, যেটুকু আছে, তা হলো মা রাধার মুখ থেকে শোনা পিতার কথা। তার পিতা ছিল দক্ষিণ ভারতের কাম্পালি শহরে বসবাসরত একজন কুমার, মাটির দলা কুমারের ঘূর্ণমান চাকতিতে ঢেলে নিয়ে তৈরি করত নানা রকমের সুন্দর মৃৎপাত্র। নিজের যুগের তুলনায় অগ্রসর চিন্তার অধিকারী ছিল লোকটি। স্ত্রীকেও সে শিখিয়েছিল মাটির পাত্র তৈরির কাজ। ফলে অর্জুনের মৃত্যুর পর স্বামীর শেখানো এই কাজই রাধাকে বেঁচে থাকার পথ দেখিয়েছিল। তবে বেশি দিন বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
পম্পারা যে কাম্পালির বাসিন্দা ছিল, সেটি ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল এক অধিপতির নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডের অংশ, শক্তিশালী প্রতিবেশী একদিন সেটা দখল করে নেয়। আর এর ঠিক পরপরই সম্ভ্রম হারানোর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শহরের নারীরা সবাই দলবদ্ধ হয়ে যাত্রা করে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুকে বরণ করার জন্য। মায়ের হাত ধরে পম্পাও সেই পথে যাত্রা করেছিল। জ্বলন্ত অগ্নিশিখার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে হয়েছিল নগরীর অন্য রমণীদের সঙ্গে তার নিজের মায়ের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া। লেখক আমাদের বলছেন, সেটি ছিল সেই মুহূর্ত, ঐশ্বরিক আশীর্বাদ যখন সে পেয়েছিল। অসহায় সেই বালিকা এরপর আশ্রয় নেয় পুরোহিত বিদ্যাসাগরের পর্বতগুহায়, সেখানেও বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাকে। জীবনের তিক্ততা সেদিনের সেই বালিকাকে নিয়ে যায় মানবিকতার শীর্ষে।
উপন্যাসের শুরুর ঘটনাবলি এ রকম উদ্ভট কল্পনার মিশ্রণে ভরা থাকলেও সেই পথ ধরেই লেখক একসময় পাঠকদের নিয়ে যান বাস্তব জীবনের দিকে, যার মূলে আছে বিজয়নগর নামে পরিচিত এক সাম্রাজ্যের পত্তন থেকে শুরু করে প্রায় ২৫০ বছর ধরে টিকে থাকা দক্ষিণ ভারতের মধ্যযুগের সমৃদ্ধ এক জনপদের কাহিনি। বর্তমান ভারতের কর্ণাটক, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাডু, কেরালা, গোয়া ও মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ নিয়ে ১৩৩৬ সালে সেই রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুই গো–পালক রাখাল ভ্রাতা হরিহর আর বুক্কা রায়া। সাঙ্গামা রাজবংশ হিসেবে পরবর্তীকালে এই রাজবংশ ইতিহাসে পরিচিতি পেয়েছে। সামান্য রাখাল হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে তাঁরা সাম্রাজ্যের পত্তন করেন, সেই কাহিনির বর্ণনা সালমান রুশদি ফুটিয়ে তুলেছেন উপন্যাসে। বলা বাহুল্য, ঐশ্বরিক আশীর্বাদপুষ্ট পম্পা কম্পনা এই সৃষ্টির পেছনে রেখেছেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। লেখক বিজয়নগর নামের উল্লেখ করলেও উপন্যাসজুড়ে সাম্রাজ্যকে তিনি বর্ণনা করেছেন ‘বিসনাগা’ হিসেবে, যার পেছনে আছে ভারতে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসা পর্তুগিজ বণিকদের রেখে যাওয়া বিবরণ।
ভারতের ইতিহাসে বিজয়নগরের উল্লেখ আছে শিল্প–সংস্কৃতির বিকাশে এর বলিষ্ঠ অবদানের সূত্রে। সাঙ্গামা রাজবংশ হানাহানির সেই সময়ে নিজেদের সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল নেতৃত্বের বিচক্ষণতার পাশাপাশি দৃষ্টির আড়ালে থেকে পম্পা কম্পনার নানামুখী ভূমিকার কল্যাণে। ভারতের ওই অঞ্চলজুড়ে পম্পা নদী আজও বহমান। নদীর নাম অনুসরণ করে মা রাধা তার মেয়ের নাম এ কারণে রেখেছিলেন যে সেই নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ আর কৃপা। পম্পা একই সঙ্গে দেবী পার্বতীর স্থানীয় নাম, যার প্রেমিক শিব ঠিক সেই জায়গাটিতে প্রথম দেখা দিয়েছিলেন পার্বতীর সামনে।
বিজয়নগরের ইতিহাসের সন্ধান করলে সহজেই যে বাস্তবতা আমাদের সামনে ক্রমে ফুটে উঠবে, তা হলো পম্পা কম্পনা নিজেই হচ্ছেন সেই সাম্রাজ্য, যার ইতিহাসের ভিন্ন বর্ণনা তিনি দিয়েছেন নিজের রচিত মহাকাব্য ‘জয়–পরাজয়ে’। সেদিক থেকে ভিন্ন মাত্রার উপন্যাস হয়ে উঠেছে সালমান রুশদির ভিক্টোরি সিটি, পম্পা কম্পনা নামের আড়ালে যেখানে সাম্রাজ্যের উত্থান–পতনের গল্প আমাদের শুনিয়েছেন লেখক। বুক্কা আর হুক্কা নামে দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া সাম্রাজ্য টিকে ছিল ১৬৬৪ সাল পর্যন্ত। তবে ১৫৭২ সালের পর থেকে কয়েকটি ভাগে সেই সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে এ রকম বলা যায় যে বিজয়নগর সত্যিকার অর্থে টিকে ছিল ১৩৩৬ থেকে ১৫৭২ সাল পর্যন্ত—২৩৬ বছর। অন্যদিকে সালমান রুশদি আমাদের বলছেন, মহাকাব্য রচনা শেষ করার পর সেটিকে ধ্বংসস্তূপের নিচে মাটিচাপা দিয়ে পম্পা কম্পনা নশ্বর জীবন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ২৪৭ বছর বয়সে। যে কারণে এই রমণীর জীবনকাল বলে দেয়, তাঁর জীবন অন্য অর্থে, আদতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যেরই কথা, জয়-পরাজয় মহাকাব্য থেকে বিভিন্ন উদ্ধৃতি তুলে ধরার মধ্য দিয়ে সেই কাহিনি আমাদের কাছে বর্ণনা করছেন সালমান রুশদি। সাঙ্গামা রাজবংশের বিভিন্ন প্রজন্মের অধিকর্তাদের সরাসরি উপস্থিতির দেখা আমরা উপন্যাসে পাই। ইতিহাস বলছে, যে দুই রাখাল যুবক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠ করছিলেন, তাঁরা হলেন হরিহর ও বুক্কা রায়া। ভিক্টোরি সিটিতে বুক্কা নিজের নামে উপস্থিত হলেও হরিহর সেখানে হয়ে উঠেছেন হুক্কা। পরবর্তী প্রজন্মের শাসকদের অনেকেই স্বনামে উপন্যাসে উপস্থিত হওয়ায় পম্পা কম্পনার কাল্পনিক চরিত্র উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবের দেখা সেখানে খুব সহজে মেলে।
পাশাপাশি ভারতের ইতিহাসে উত্তরণের সেই কালে দূর থেকে আসতে থাকা বিদেশি বণিক এবং ভিন্নধর্মাবলম্বীদের ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশের বর্ণনাও এতে আমরা পাই। সব মিলিয়ে ইতিহাস ও কল্পনার মিশেলে চমৎকার এক কাহিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন সালমান রুশদি। উপন্যাসের সমাপ্তিও ঔপন্যাসিক টেনেছেন পম্পা কম্পনার জয়–পরাজয় মহাকাব্যের সমাপ্তির উদ্ধৃতি টেনে। বিদুষী সেই রমণী সেখানে বলছেন:
আমি, পম্পা কম্পনা, এই গ্রন্থের রচয়িতা।
একটি সাম্রাজ্যের উত্থান আর এর পতন
আমি প্রত্যক্ষ করেছি।
হারিয়ে যাওয়া সেই সব রাজা-রানিদের
এখন কীভাবে মনে করা হচ্ছে?
তাঁদের অস্তিত্ব আছে কেবল শব্দে,
যখন তাঁরা জীবিত ছিলেন—
তাঁরা ছিলেন বিজয়ী অথবা বিজিত;
কিংবা উভয়ই।
এখন তাঁরা কেউ নন।
শব্দই কেবল একমাত্র বিজয়ী।
তাঁরা যা করেছেন, কিংবা যে চিন্তা তাঁদের মনে দেখা দিয়েছিল, তা এখন অস্তিত্বহীন।
কেবল তা বর্ণনা করে যাওয়া এই সব শব্দই সত্য, যা টিকে আছে এখনো।
যেভাবে বর্ণনা করা আমি বেছে নিয়েছি,
সেভাবেই কেবল তাঁদের স্মরণ করা হবে।
তাঁদের কীর্তি জানা যাবে কেবল
যেভাবে তাঁদের তুলে ধরা হয়েছে সেই পথ ধরে।
আমি তাঁদের যেভাবে বোঝাতে চেয়েছি,
সেভাবেই তাঁরা ফুটে উঠবেন।
আমি নিজে এখন আর কিছুই নই।
যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা হচ্ছে এই শব্দের শহর।
শব্দই হচ্ছে একমাত্র বিজয়ী।
মনজুরুল হক প্রথম আলোর টোকিও প্রতিনিধি