শব্দগল্পের বোঝাপড়া
বাংলাদেশের অন্যতম শব্দবিশারদ ও ভাষাচিন্তক ফরহাদ খানের শব্দের গল্প এমন একটি বই, যেখানে বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত শব্দের উৎস, অর্থগত ও প্রয়োগের তাৎপর্য, শব্দগঠনের ইতিহাস প্রভৃতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ স্থান পেয়েছে। শব্দের উৎস ও ব্যাকরণবিধি এবং বাক্যে তা প্রয়োগের নানা ধরন নিয়ে বাংলা শব্দের উৎস-অভিধান ও শব্দের চালচিত্র নামে তাঁর আরও দুটি গ্রন্থ রয়েছে। বই তিনটি হলেও এর মধ্যে রয়েছে অন্তর্গত সাদৃশ্য। তাই বই তিনটিকে ‘ট্রিলজি’ও বলা যেতে পারে।
বাংলা ভাষার শব্দ নানাভাবে গঠিত হয়ে আসছে। কখনো সমাসের মাধ্যমে, কখনো সন্ধিজাত হয়ে, কখনোবা প্রত্যয়সাধিত উপায়ে। আবার অন্য ভাষার প্রচুর শব্দ বাংলা ভাষায় আত্তীকরণও হয়েছে। যেকোনো ভাষায় শব্দের গঠন, গ্রহণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, শব্দসৃজনের মধ্য দিয়ে ভাষার সমৃদ্ধি ঘটে থাকে। এটিই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই অন্তর্নিহিত থাকে একটি ভাষার শব্দসমূহের উৎপত্তি, আগমন, প্রয়োগ-অপপ্রয়োগের নানান গল্প।
ইসমাইল সাদী
শব্দের গল্প
ফরহাদ খান
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪; প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল; ১৩৬ পৃষ্ঠা; দাম: ২৭০ টাকা।
সময়স্রোতের ধারাবাহিকতা এবং শব্দের প্রয়োগভিন্নতার কারণে অভিন্ন শব্দের অর্থগত পরিবর্তন যেমন হয়, তেমনি অন্য ভাষার শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশের সময় রূপান্তরও সাধিত হয়। যেমন ‘সরঞ্জাম’। শব্দটি ব্যবহৃত হয় উপকরণ, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ইত্যাদির প্রতিশব্দ হিসেবে। শব্দটি এসেছে ফারসি ‘সার আনজাম’ থেকে। ফারসিতে শব্দ দুটির অর্থ শেষ, অন্তিম, পরিণতি ইত্যাদি। অর্থাৎ উৎস ভাষার সঙ্গে রূপান্তরিত ভাষায় শব্দগত সাদৃশ্য বিরাজ করলেও প্রযুক্ত শব্দটির অর্থগত ভিন্নতা তৈরি হয়েছে।
এভাবেই শব্দাশব্দের খেলা চলতে থাকে পৃথিবীর সব ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে। কোনো ভাষা যদি রক্ষণশীল হয়ে ওঠে, তখন শব্দচর্চার এই খেলা বন্ধ হয়ে যায়। আর তখন সেই ভাষাকে আর জীবিত ভাষা বলা যায় না। জীবিত ভাষায় রক্ষণশীলতার স্থান নেই। এমন অনেক শব্দ বাংলা ভাষায় আমরা নিত্যদিন লেখায়-বলায় প্রয়োগ ঘটাই, যার প্রচলিত অর্থ আর প্রকৃত অর্থের ব্যাপক ভিন্নতা রয়েছে। তেমনই একটি শব্দ ‘সম্ভ্রান্ত’। শব্দটি আমরা সচরাচর ব্যবহার করে থাকি ‘অভিজাত’, ‘মর্যাদাশীল’, ‘মান্য’ ইত্যাদি অর্থে। এই কারণে ‘সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে দেখলেই আমরা চিনে ফেলি ‘কিংবা চিনতে বাধ্য হই’। ইদানীং অধিক ‘ধনসম্পদের মালিক’ কিংবা ‘ক্ষমতার দাপট’ দেখানো ব্যক্তিদেরও সম্ভ্রান্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। অথচ ‘সম্ভ্রান্ত’ শব্দের মূল অর্থ হলো ‘আবর্তিত’, ‘ভীত’, ‘উৎকণ্ঠিত’, ‘হতবুদ্ধি’ প্রভৃতি। ফরহাদ খান রসিকতা করে বলেছেন, ‘একজন সম্ভ্রান্তের দাপটে সাধারণ মানুষ যা হয়ে থাকে, সেটাই সম্ভ্রান্ত শব্দের আসল অর্থ।’ এভাবেই ‘শব্দের অর্থ প্রায়ই অর্থের মূল সীমানা পেরিয়ে যায়। পরিবর্তিত হয়ে যায় শব্দের অর্থ। বাংলা ভাষায় সম্ভ্রান্ত শব্দটি সেই জাতীয় একটি শব্দ, যার অর্থ এ যুগে এসে একেবারেই পাল্টে গেছে।’ বাক্যে প্রয়োগের তারতম্য অনুযায়ী শব্দের অর্থগত পরিবর্তন সাধিত হয়। পরিবর্তনের প্রতিটি ধাপে থাকে লেখকের লক্ষ্যযোগ্য বাসনা। কেবল লেখকের নয়, কথকেরও থাকে এমন আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষা তখনই পূরণ হয়, যখন তাতে সংঘটিত হয় সর্বোত্তম শব্দের যথাযোগ্য ব্যবহার।
ফরহাদ খানের শব্দের গল্প বুঝিয়ে দিচ্ছে, যেকোনো লেখকেরই শব্দশক্তির ওপর দখল থাকতে হয়; থাকতে হয় রসবোধও। যেমন ‘বিনীত’ শব্দটি আমরা সাধারণত প্রয়োগ করি দাপ্তরিক চিঠিতে কিংবা আবেদনের শুরুতে কিংবা শেষে। এসব ক্ষেত্রে ভদ্রতাবশত শব্দটির প্রয়োগ যথাযথই। কিন্তু ফরহাদ খান বলেছেন, ‘বিনীত শব্দের যে মূল অর্থ, তার সঙ্গে কিন্তু এসব ভাবের কোনো সম্পর্ক নেই। বিনীত শব্দের মূল অর্থ যদি অনুসরণ করা হতো, তাহলে মানুষ চিঠিপত্রে বিনীত না লিখে বিনত লিখত আর বালক ও যুবারা আরও বিনীত হওয়ার চেষ্টা করত।’ শব্দের তাৎপর্য ও আর্থিক দ্যোতনার নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করে শব্দ সম্পর্কে লেখকের গভীর ধারণার ওপর। তা না হলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনাও অনেক সময় পাঠকের কাছে স্পষ্ট বক্তব্য প্রকাশে ব্যর্থ হতে পারে।
এমন অনেক শব্দ আছে, যা চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অপূর্ব কোনো চিত্ররূপের অবতারণা ঘটায়। তেমনই একটি শব্দ ‘গোধূলি’। অস্তগামী সূর্যালোকের সময়কে আমরা গোধূলিবেলা বলে থাকি। সংস্কৃত এ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ‘যখন গরুর পাল ধূলি উড়িয়ে গোশালায় ফেরে, সেই সময়টা’কে বোঝাতে। এভাবেই সহজ ও সাবলীলভাবে ফরহাদ খান আমাদের শুনিয়েছেন শব্দের গল্প। তিনি ‘অভিধানের গল্প’, ‘রান্না হওয়া শব্দগুলো’, ‘শব্দগুলো ইংরেজদের নয়’, ‘শব্দগুলো অনেক মজার’, ‘শব্দের মজা’, ‘বাংলা মাসের নামের কথা’, ‘জীবনের শব্দগল্প’, ‘শব্দগুলো গানের’, ‘গল্পকথার শব্দগুলো’, ‘রহস্যে ঘেরা শব্দগুলো’ প্রভৃতি ছোট ছোট শিরোনামে পাঁচ-ছয়টি করে শব্দকে ধরেছেন এবং তার সুখপাঠ্য বিশ্লেষণসহ উৎস, উৎপত্তি, বিবর্তন, রূপান্তর ও প্রয়োগের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেছেন শব্দের গল্প বইয়ে।
ইসমাইল সাদী