ছাত্ররাজনীতির অন্ধকার সময়
চার্লি চ্যাপলিনের দ্য কিড যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন বাচ্চারা ইট মেরে শার্সি ভেঙে ফেলে, যাতে চ্যাপলিন সেগুলো সারাতে পারেন। কারণ, চ্যাপলিনের পেশাই হচ্ছে শার্সি সারানো। তাঁর এই কৌশলের কারণে তিনি শার্সি সারানোয় কিছুটা হলেও সফলতা পান।
—দেবেশ রায়
উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে
উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে লেখকদের শুধু শার্সি ভাঙলে হয় না, দরকার হয় প্রচলিত বিষয় ও কাঠামো নামের বাড়িটাকে চুরচুর করে ভেঙে ফেলা। আর এ জন্য লেখককে সত্য আবিষ্কার করতে হয়। এই সত্য ভালো-মন্দ কিছুই নয়, সত্য শুধু সত্যই। যতই ভয়ানক হোক না কেন, সত্য থেকে একবিন্দু সরে গেলে তা কি আর উপন্যাসে আনা যায়! তাই অনেক সত্য উপন্যাসে আসেও না।
কথাগুলো মনে হলো আসিফ নজরুলের উপন্যাস আমি আবু বকর পড়তে পড়তে। উপন্যাসটি সময়ের এক না বলা ক্ষত ধারণ করে আছে। উচ্চারণ করেছে এমন কিছু সত্য, যা আমরা সচরাচর জানলেও মুখে আনতে অস্বস্তি বোধ করেন অনেকেই। ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ তকমা দিয়ে যেকোনো মানুষকেই যে হেনস্তা থেকে শুরু করে এমনকি হত্যাও যে করা যায়, গল্পের মাধ্যমে সেটিই মূলত বলা হয়েছে এখানে। বইয়ে লেখক এমন কিছু বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরেছেন, যা আমাদের গল্প–উপন্যাসে একেবারেই গরহাজির।
আমি আবু বকর আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্ররাজনীতির নামে কীভাবে ছাত্রদের ব্যবহার করা হয়। আর কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে থাকার জন্য ক্ষমতাসীন দলের হয়ে কী কী করতে হয় ছাত্রদের।
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং ছাত্র ও শিক্ষকদের রাজনীতির অন্তরালের বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। প্রধান চরিত্র আবু বকরকে প্রচণ্ড প্রহার করা হয়। কারণ, সে নাকি নিষিদ্ধ এক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারে না। মূলত সন্দেহের বশেই মারা হয় আবু বকরকে। মারে তারই সহপাঠীরা। হাসপাতালে নেওয়া হলে প্রাণে বেঁচে যায় আবু বকর। তবে হাসপাতালে তাকে থাকতে হয় অনেক দিন। বন্ধুরা প্রথম দিকে দেখতে এলেও ধীরে ধীরে আসা বন্ধ করে দেয়। এমনকি নিজের বোনও আসা বন্ধ করে দিলে একসময় নিজেকে অসহায় ভাবতে শুরু করে আবু বকর। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকে, কী হবে এই জীবনের, বেঁচে থেকেই বা কী হবে?
পরবর্তীকালে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে আবু বকর নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় তাকে নির্যাতন করা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনে যোগ দেয়। পুরোদমে সেই দলের একজনে পরিণত হয় সে। যাদের কারণে তার মৃত্যু হতে পারত, পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম হয়েছিল, সেই দলেরই ক্যাডার হয়ে যায় সে।
আমি আবু বকর
আসিফ নজরুল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪; প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী; ১৩৬ পৃষ্ঠা; দাম: ৩৫০ টাকা।
নেতাদের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা ও স্বাধীনতাবিরোধী তকমা দেওয়া, ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে বিভিন্নজনকে পুলিশে দেওয়া, বিরোধী ছাত্রসংগঠনের ওপর হামলা, বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, অস্ত্র রাখা—এসব হয়ে ওঠে আবু বকরের নিত্যকর্ম। বলা যায়, দেশের শিক্ষায়তনে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন চিত্রই প্রতিভাত হয়েছে এই উপন্যাসে।
শিক্ষাঙ্গনে পড়তে এসে একে অপরের মধ্যে যেমন প্রেম হয়, আবু বকরের জীবনেও তেমন প্রেম আসে। প্রেম। উপন্যাসে অন্যান্য চরিত্রের জীবনেও ঘটে প্রেমের ঘটনা। কেউ প্রেমের আঘাতে মুষড়ে পড়ে, কেউ নতুন প্রেমে পড়ে, আবার কেউ পড়াতে গিয়ে প্রেমে পড়ে ছাত্রীর। প্রেম এখানে বিচিত্রভাবে হাজির।
তবে উপন্যাসটির মূল কেন্দ্র ছাত্ররাজনীতি। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালগুলোয় যে নষ্ট রাজনীতি রয়েছে, উপন্যাসে তা দারুণভাবে ফুটিযে তুলেছেন লেখক। আছে গণরুমে ‘ইলিশ কাইত’ হয়ে থাকা থেকে শুরু করে পথে পথে রাজনৈতিক নেতাদের সামনে মাথা নিচু করে চলা পর্যন্ত।
উপন্যাসটি একদম বাস্তব রাজনীতিঘেঁষা। মানুষের জীবন রাজনীতির কারণে কোথা থেকে কোথায় চলে যায়, তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি আবু বকর। তবে লেখক এখানে মূল চরিত্র আবু বকরকে যতটা মায়া দিয়ে বিশদভাবে এঁকেছেন, অন্য চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে তেমন ঘটেনি। বিশেষত আবু বকরের বন্ধু মিনহাজ আর তার প্রেমিকা নিন্মি ও বোন ফাহিমা—এসব চরিত্রকে আরেকটু বিস্তারিত করার সুযোগ ছিল মনে হয়।
আসিফ নজরুলের লেখার বড় গুণ, খুব সাবলীল ও সহজ ভাষায় লেখেন তিনি। পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না। আমি আবু বকর–এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।