আন্না ও ফিওদরের প্রেমাখ্যান
রুশ কবি ইয়েভগেনি ইয়েফতুশেনকোর একটি জনপ্রিয় উক্তি আছে অনুবাদ সম্পর্কে, অত্যন্ত নারীবিদ্বেষী সেই কথার ভাবার্থ হচ্ছে, ‘অনুবাদ অনেকটা নারীর মতো, সুন্দরী হলেই বিশ্বস্ত হবে না, আর বিশ্বস্ত হলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই সুন্দরী নয়।’ মশিউল আলম অনূদিত আমার দস্তইয়েফ্স্কি অনুবাদ হিসেবে বিশ্বস্ততা আর সৌন্দর্যের সমন্বয় ঘটাতে পেরেছে কি না, তা বিচার করার মুরোদ অন্তত আমার নেই। ইংরেজি থেকে হলে আর মূল বই পড়া থাকলে সেটি করা যেত। বিশ্বসাহিত্যের জগতে আমাদের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে একটিমাত্র ভাষা আর সেটি ইংরেজি। সে জন্য মশিউল আলম জানানোর আগে আমরা দস্তইয়েফ্স্কির নাম ইংরেজি বানানের অনুগামী হয়ে উচ্চারণ করতাম ‘দস্তয়ভস্কি’। এ প্রসঙ্গে আমার গুরু মোহাম্মদ রফিকের একটি কথা মনে পড়ছে, স্যার বলতেন ব্রিটিশরা লোকের নাম বিকৃত করতে ওস্তাদ।
আমার দস্তইয়েফ্স্কি বইটির প্রসঙ্গে আসি। এটি মূলত দস্তইয়েফ্স্কির দ্বিতীয় স্ত্রী আন্না গ্রিগরিয়েভনা দস্তইয়েফস্কায়ার আত্মজীবনীর একটি অংশ। অনুবাদকের দেওয়া শিরোনাম আমার দস্তইয়েফ্স্কি। এতে লিপিবদ্ধ হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ ফিওদর দস্তইয়েফ্স্কির সঙ্গে আন্নার পরিচয়, প্রণয় আর পরিণয়ের বিবরণ। ঘটনার পরম্পরা বোঝার সুবিধার্থে অনুবাদক শুরুতেই দস্তইয়েফ্স্কির একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী জুড়ে দিয়েছেন। পাঠক হিসেবে দস্তইয়েফ্স্কির জীবনের প্রতি আগ্রহ আছে অনেকেরই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এক ভক্ত পাঠকের কাছে শুনেছিলাম, দস্তইয়েফ্স্কি নাকি প্রকাশকের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে সেই টাকা জুয়া খেলে উড়িয়ে দিতেন। অথচ এক প্রকাশক যে ভয়ানকভাবে তাঁকে ঠকানোর চেষ্টা করেছিলেন অবিশ্বাস্য এক ডেডলাইন বেঁধে দিয়ে, সে কথা আমার জানা ছিল না।
খামখেয়ালিপূর্ণ এই লেখকের জীবনে বহু উত্থান–পতন এসেছে, তাঁর উপন্যাসের মতোই বর্ণাঢ্য তাঁর জীবন। দেনার দায়ে যখন ঘরের জিনিসপত্র বন্ধক রাখতে শুরু করেছেন লেখক, তেমনই এক দুঃসময়ে লেখক দেখা পান আন্না গ্রিগরিয়েভনার। স্টেনোগ্রাফার হিসেবে ৫০ রুবলের বিনিময়ে আন্না ডিকটেশন নিয়ে শর্টহ্যান্ডে লিখে পরে লেখাগুলো লংহ্যান্ডে জমা দেন লেখকের কাছে। আর এভাবেই মাত্র ২৬ দিনে লেখা হয় পৃথিবীর ইতিহাসের বিরল রত্ন জুয়াড়ি। ১৮৬৬ সালের নভেম্বরের ১ তারিখের মধ্যে সেই উপন্যাস জমা দিতে না পারলে ধূর্ত সেই প্রকাশক জগতের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তইয়েফ্স্কির সব লেখার স্বত্ব নিয়ে নিতেন চিরতরে। সে হিসেবে বলা যায়, ফিওদরের জীবনে আন্নার আগমন ছিল এক অতীব শুভ ঘটনা, আন্না এসেছিলেন ত্রাতা হয়ে। পরে তিনি প্রণয়িনী হন। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৬৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পরিণত হন লেখকের গৃহিণীতে।
স্মৃতিকথা হলেও গ্রন্থটি উপন্যাসের মতোই ঘটনাবহুল। দ্বিগুণের বেশি বয়সী লেখকের সঙ্গে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে দেখা করতে যাওয়ার সময় সদ্য তরুণী আন্নার মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল, তার বিশদ বিবরণ যেমন রয়েছে, তেমনই আছে লেখকের পরিবারের অন্য সদস্যদের, বিশেষত বড় ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী এমিলিয়া ফিওদরভনা আর প্রথম স্ত্রী মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার আগের পক্ষের সন্তান পাভেল আলেকসান্দ্রোভিচ ইসায়েভের শীতল আচরণের কথাও। আন্না ও ফিওদর পরস্পরকে পছন্দ করতে শুরু করার পর এমিলিয়া আর পাভেলের দিক থেকে অসন্তোষ ঠিক টের পেয়েছিলেন বুদ্ধিমতী আন্না। কিন্তু প্রেমের শক্তির সামনে স্বার্থান্বেষীদের বিদ্বেষ টিকতে পারেনি। ফিওদর এক ছেলেমানুষি উপায়ে আন্নাকে প্রেম নিবেদন করেন। বয়স তখন ৪৬ হলেও হৃদয়ের দিক থেকে আবেগপ্রবণ ছিলেন ফিওদর। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে সুখী দাম্পত্যের জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যথেষ্ট নয়। বিবাহিত সঙ্গীর প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রচণ্ড প্রেমও থাকা দরকার। সম্ভবত মারিয়ার সঙ্গে সাত বছরের অসুখী দাম্পত্যের স্মৃতি তাঁর হৃদয়ে গভীর ক্ষত হিসেবে বিরাজ করছিল। আর সে জন্যই প্রেমের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন, প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও হয়ে ছিলেন ভালোবাসার কাঙাল। আন্না লেখকের জন্য শ্রদ্ধার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জন্য অনুভব করেছেন তীব্র ভালোবাসাও। আর সে জন্যই ভক্ত কিংবা পাণিপ্রার্থী যুবকদের পাত্তা না দিয়ে বর হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন প্রৌঢ় বিপত্নীক হতদরিদ্র লেখককে।
আন্নার সঙ্গে বিবাহের পর দস্তইয়েফ্স্কির জীবনে সাংসারিক স্থিরতা আসে, চার সন্তানের পিতা হন তিনি। কিন্তু অভাব যে কেটেছিল, তা নয়। ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, ইডিয়ট, দ্য ডেমনস আর দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ—কালজয়ী এই চার উপন্যাসও লেখা হয় আন্নার সঙ্গে বিবাহিত থাকা অবস্থায়ই। তাঁদের দাম্পত্য জীবনে অর্থসংকট যে কখনোই তাঁদের পিছু ছাড়েনি, সে কথা উল্লেখ করেছেন আন্না। কিন্তু সেসবের বিশদ বিবরণ এই গ্রন্থে নেই। এতে শুধু পরিচয়, প্রেম আর বিবাহের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করেছে। বিয়ের অনুষ্ঠান দিয়েই শেষ হয়েছে বইটি।
আন্নার পরিণত বয়সের লেখা এটি। তিনি যে স্মৃতি থেকে লিখেছেন, সেটি বোঝা যায়। কারণ, অনেক ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে, আবার কিছু জায়গায় হুট করে পরদিনে চলে গেছেন। ১৮৬৬ সালে কোনো ডায়েরি বা জার্নাল সম্ভবত রাখতেন না আন্না গ্রিগরিয়েভনা। তাই লেখার সময় স্মৃতির ওপরই ভরসা করতে হয়েছে তাঁকে। দস্তইয়েফ্স্কি–ভক্তদের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য।
উম্মে ফারহানা
আমার দস্তইয়েফ্স্কি
অনুবাদ: মশিউল আলম
প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা; প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২৪;
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈশব্দ্য; ১০৩ পৃষ্ঠা;
দাম: ২৫০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে: prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে