আমি কখনো কথা বলতাম না, কেবল বিতর্কে অংশ নিতাম
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুদিবস আজ ৫ ডিসেম্বর। ১১ বছর আগে এই দিনে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান এই মহান কৃষ্ণাঙ্গ নেতা। তাঁর লেখা কনভারসেশন উইথ মাইসেল্ফ অবলম্বনে প্রথম আলোর ২০১৩ সালের ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল ‘নেলসন ম্যান্ডেল: ঐ মহামানব আসে’ শিরোনামে লেখাটি। এই লেখার ভূমিকা ও নির্বাচনে ছিলেন মতিউর রহমান। অনুবাদ করেছেন রামেন্দ্র চৌধুরী। তাঁর স্মরণে আজ লেখাটি ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে তিন কিস্তিতে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল। এখন দেওয়া হচ্ছে প্রথম কিস্তি
মানুষ হিসেবে আমরা অনেকে যার যার কল্পলোকে সত্যিকারের এক নায়কের স্বপ্ন দেখি। বর্তমান সময়ে সব বিচার শেষে নেলসন ম্যান্ডেলাই সত্যিকারের সেই নায়ক হিসেবে আমাদের সামনে প্রতিভাত হন। সদা হাস্যোজ্জ্বল, আত্মত্যাগের মহান প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলা এখন বিশ্বের লক্ষ-কোটি মানুষের কাছে পুণ্যবান, পরিপূর্ণ এক মানুষের নাম।
খুব শক্ত মনের মানুষ নেলসন ম্যান্ডেলা। কিন্তু খুব সহজেই তিনি ব্যথিত হন। তাঁর মধ্যেও রয়েছে অনেক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। ছোট্ট প্রজাপতিও হয়তো তাঁর দ্বারা কষ্ট পাবে না, কিন্তু তিনিই আবার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সামরিক শাখার প্রথম প্রধান ছিলেন! একদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের সত্যিকারের নেতা, অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত সেলিবেটি তিনি। যিনি সবাইকে আনন্দ দিতে চান, আবার কাউকে ‘না’ বলতেও দ্বিধা করেন না। তিনি কৃতিত্ব নিতে চান না। কিন্তু জেনে যান, কখন তিনি সেটা পাবেন। তিনি রান্নাঘরের সকলের সঙ্গেও হাত মেলান, আবার নিজের দেহরক্ষীদেরও চিনতে পারেন না। বর্ণবাদবিরোধী কৃষ্ণাঙ্গ এই নেতা প্রেসিডেন্ট হলে অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও নিজের প্রধান দেহরক্ষী নিযুক্ত করেন একজন শ্বেতাঙ্গকে।
এত বড় জীবনের ক্যানভাস যাঁর, সেই ম্যান্ডেলার রয়েছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের প্রতিও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। তিনি যদি একটি টিস্যু হাতে তোলেন টিস্যুবক্স থেকে, অত্যন্ত সুচারুভাবে তা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে নেন বুকপকেটে। জেলখানায় থাকা অবস্থায় যত চিঠি পেয়েছেন—পাওয়া আর উত্তর দেওয়ার তারিখসহ লিখে রেখেছেন ডায়েরিতে। উত্তরে কী লিখেছেন, তা-ও কপি করে রেখেছেন ডায়েরির পাতায়। কখনো কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে তিনি বিলম্ব করেননি। সময়ানুবর্তিতার ব্যর্থতাকে তিনি মনে করেন চরিত্রের দুর্বলতা।
২৭ বছরের কারাজীবন থেকে বেরিয়ে তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে (এএনসি) নতুন করে সংগঠিত করেছেন। বহুবিধ সংকট-সন্ত্রাস-আক্রমণ-বিপদের খাদ পেরিয়ে ম্যান্ডেলা দেশের প্রথম সাধারণ নির্বচনের পর শ্বেতাঙ্গদের দল ও উগ্র অশ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে জাতীয় ঐকমত্যের গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করেন। একই সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম অশ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন। খুব অল্প সময়েই দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বের বুকে একটি সম্মানজনক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে মাত্র এক মেয়াদ সম্পন্ন করেই প্রেসিডেন্টের পদ থেকে বিদায় নেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এই স্বল্প সময় রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দক্ষিণ আফ্রিকার চরম বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থাকে তিনি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় উন্নীত করেন, যাতে প্রতিফলন ঘটে তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা আর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার। তিনি ‘এক নতুন দক্ষিণ আফ্রিকা’ গড়ে তোলার পথ উন্মুক্ত করেছেন।
কলেজে অধ্যয়নকালেই তিনি সক্রিয় হয়েছিলেন বর্ণবাদবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে। সেই থেকে জীবনের এক পর্ব থেকে আরেক পর্ব কেটেছে তাঁর জেল-জুলুম, সংগ্রাম আর সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্ত্ততির পেছনে। জীবনের এক বাঁকে ২৭ বছর তাঁকে কারা ভোগ করতে হয় রববেন দ্বীপের কারাগারসহ অন্যান্য কারাগারে।
নেলসন ম্যান্ডেলা বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় রাষ্ট্রনেতা, যিনি নিজেকে জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একজন পিতা, একজন স্বামী, একজন দাদা, একজন নানা, একজন বন্ধু—এভাবে তিনি একজন সম্মানিত মানুষ বিশ্বের সর্বত্র।
১৯৯০ সালে জেল থেকে মুক্ত হয়ে আসার পর বিগত দুই দশকে অসংখ্য প্রকাশনা, ব্যাপক প্রচার আর বহুমুখী আলোচনায় এসেছেন তিনি। ১৯৯৪ সালে তাঁর আত্মজীবনী লং ওয়াক টু ফিডম প্রকাশের পর থেকে এখন পর্যন্ত এটি সারা বিশ্বে সর্বাধিক বিক্রীত বই হিসেবে সমাদৃত। এ ছাড়া তাঁর অফিস থেকে, তাঁর ফাউন্ডেশন থেকে শত শত বক্তৃতা, বিবৃতি আর বাণী দিয়েছেন তিনি। আরও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই কনভারসেশন উইথ মাইসেল্ফ্: নেলসন ম্যান্ডেলা ও নেলসন ম্যান্ডেলা: ইন বিজ ঔন ওয়ার্ডস ।
উল্লেখিত গ্রন্থ দুটির কিছু অংশ এখানে পত্রস্থ হলো।
বিয়ে থেকে পালিয়ে
গোষ্ঠীপতি হওয়ার জন্য আমাকে প্রস্ত্তত করা হচ্ছিল,...কিন্তু আপনি জানেন, একটি বাধ্যতামূলক বিয়ের উদ্যোগ থেকে রক্ষা পেতে আমাকে সে দিন পালিয়ে যেতে হয়েছিল...। ঘটনাটি আমার জীবনের পথটাকেই পাল্টে দিয়েছিল। আপনি কি জানেন, সেদিন আমি যদি বাড়িতেই থাকতাম, তাহলে এত দিনে একজন সম্মানিত গোষ্ঠীপতি হয়ে যেতে পারতাম? আমার একটা বিরাট ভুঁড়ি থাকত, আর থাকত প্রচুর গরু-মহিষ আর ভেড়া।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা
ফোর্ট হেয়ারে শিক্ষাগ্রহণ
‘তুমি এখন ফোর্ট হেয়ারে পড়তে এসেছ। ভবিষ্যতে তোমাকেই তোমার জনগণের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে।’৬ শিক্ষকেরা এমন কথা বলায় আমি গৌরববোধ করেছিলাম। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই গৌরববোধ করেছিলাম। সারাক্ষণ আমাদের এ ধরনের কথাই শোনানো হতো। এ কথাও ঠিক যে, তখনকার দিনে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জন্য ডিগ্রি অর্জন করার বিষয়টি যথার্থই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই আমার এমন অনুভূতি হয়েছিল। আর এ কথাও অনস্বীকার্য যে, তাঁর ছেলে—গোষ্ঠীর একজন সদস্য—ফোর্ট হেয়ারে যোগ দিতে পেরেছে বলে রাজা নিজেও এ গর্ববোধ করেছিলেন।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সীমাবদ্ধতা
মোহাচ্ছন্নতা ও মোহভঙ্গের দুটি প্রক্রিয়াই জীবনের অংশ। এটি চলতে থাকে নিরন্তর ও অনিঃশেষ। ১৯৪০-এর দশকের শুরুর দিকে আমার প্রত্যাশা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার সংঘাত তীব্রভাবে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। কলেজে আমি বিশ্বাস করতাম যে, আমি স্বাভাবিকভাবেই সর্বোচ্চ অবস্থানটি পেয়ে যাব, আমার জনগণের সব প্রচেষ্টা আমার নেতৃত্বেই পরিচালিত হবে। প্রকৃতপক্ষে ফোর্ট হেয়ারের অধিকাংশ ছাত্রের জন্যই এটা সত্য ছিল। তাদের অনেকেই কলেজ ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত উপার্জনের আরামদায়ক চাকরিতে যোগ দিয়ে বেশ কিছুটা প্রভাবও বিস্তার করতে পারত। এ কথাও ঠিক যে, ডিগ্রি অর্জনকারীরা বিশেষত শিক্ষাক্ষেত্রে যথেষ্ট সামাজিক সম্মান পেত।
কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা হয়েছিল ভিন্ন। এমন সব মহলে আমার যাতায়াত ছিল, যেখানে সাধারণ জ্ঞান ও প্রায়োগিক অভিজ্ঞতাই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতো। সেখানে উচ্চশিক্ষার দিকটিকে অপরিহার্য নিয়ামক বলে ভাবা হতো না। কলেজে আমাকে যা কিছু পড়ানো হয়েছে, তার খুব কমই আমার নতুন পরিবেশে প্রত্যক্ষভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হলো। জাতিগত নির্যাতন, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জন্য সুযোগের অভাব ও প্রাত্যহিক জীবনের অসংখ্য অপমানকর অভিজ্ঞতার বিষয়াদি আলোচনা করতে সাধারণ শিক্ষকেরা সংকোচ বোধ করতেন। কীভাবে আমরা চূড়ান্ত পর্যায়ে বর্ণবাদী সংস্কারের পাপ থেকে মুক্তিলাভ করতে পারি, এ বিষয়ে আমার কোন কোন বই পড়া দরকার, শৃঙ্খলাবদ্ধ স্বাধীনতা আন্দোলনে শরিক হতে চাইলে কোন রাজনৈতিক সংগঠনে যুক্ত হতে হবে ইত্যাদি কোনো কথাই তাঁরা কেউ আমাকে বলেননি। সুযোগমতো নিজে চেষ্টা করে এবং নিজেই নিজের ভুল সংশোধন করে করেই বিষয়গুলো আমাকে শিখতে হয়েছে।
কারাবন্দী অবস্থায় লেখা আত্মজীবনীর অংশ
সাদা আর কালো
রিচার্ড স্টেঙ্গেল: এ সময়টাতে সামাজিক মেলামেশার কাজটা বেশ জোরেশোরেই চলছিল, তাই না? আপনি আগেই বলেছেন যে, জোহানেসবার্গে আসার পর থেকেই আপনাকে বিভিন্ন সমাবেশে নিয়ে যাওয়া হতো। কমিউনিস্ট পার্টির এক সমাবেশেই মাইকেল হারমেলের৯ সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় হয়। তা ছাড়া, জো স্লোভো১০ আর রুথ ফার্স্ট প্রমুখের সঙ্গে মেলামেশা সম্পর্কেও অনেক লেখালেখি হয়েছে।
নেলসন ম্যান্ডেলা : না, ঠিক তা নয়, এটা বিশেষ কিছু ছিল না। সাদা ও কালোদের সমাজে যেমন ঘটে, এ দেশে স্বাভাবিক নিয়মে সবই সে রকম ছিল। ব্যতিক্রম ছিল শুধু এই যে, এখানে আপনি সাদা ও কালোদের একত্রে দেখছেন।
স্টেঙ্গেল: কিন্তু এটাইতো ছিল বিশেষ ব্যতিক্রম, তা- ই নয় কি?
ম্যান্ডেলা : মেলামেশার এ ব্যাপারটা যথেষ্টই ব্যতিক্রমী ছিল। কিন্তু সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে ব্যাপারটা এ দেশে নিতান্তই স্বাভাবিক। প্রায়ই এটা ঘটে থাকে। হ্যাঁ, এটা আদৌ নতুন কিছু ছিল না। আর তেমন নিয়মিতভাবে এটা ঘটত না। এখানে মূল বিষয়টা হচ্ছে, এসব গ্রুপকে অবশ্যই (কমিউনিস্ট) পার্টি নতুন সদস্য সংগ্রহের জন্য কাজে লাগাত।
স্টেঙ্গেল : বুঝতে পারছি...অন্তত সাদাদের মধ্যে তো বটেই। আচ্ছা, তাঁরা কি মনে করত না যে, এ ধরনের মিশ্র-সমাবেশে যোগ দিয়ে তারা খুবই দুঃসাহসী ও উত্তেজনাকর কাজ করছে?
ম্যান্ডেলা : না, না, না, আমি সেভাবে ভাবিই না। এমন সাদারাই সেখানে থাকতেন, যাঁরা যথার্থই গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পরিবেশে লালিত-পালিত হয়েছেন, যাঁরা নির্যাতিতদের সংগ্রামের সঙ্গী হতে সংকল্প করেছেন। তাই সহজ পরিবেশে সময় কাটানোর জন্যই তাঁরা কালোদের আমন্ত্রণ জানাতেন।
স্টেঙ্গেল : আপনি সেসব পার্টিতে যোগ দিতেন?
ম্যান্ডেলা : হ্যাঁ, দিতাম বৈকি। তবে পার্টিতে যাওয়ার ব্যাপারে আমি নিয়মিত ছিলাম না। একসময় জো আমার সম্পর্কে ওয়াল্টারের কাছে অভিযোগ করেছিল যে, নেলসন পার্টি পছন্দ করে না।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা
প্রগতি চিন্তা ও কমিউনিস্ট পার্টি
ম্যান্ডেলা : জোহানেসবার্গে বহু রকমের চিন্তাভাবনার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটানো হচ্ছিল।
স্টেঙ্গেল : আপনি যখন কোনো সভায় যেতেন, বসে বসে শুধুই শুনতেন?
ম্যান্ডেলা : আমি কখনো কোনো কথা বলতাম না, কেবল বিতর্কে অংশ নিতাম। না, কোনো রাজনৈতিক বিতর্কে নয়, শুধুই জ্ঞানজাগতিক বিতর্কে। যেমন, ব্লোমফনটিন থেকে একটি দল আসবে জোহানেসবার্গে, আমাকে জোহানেসবার্গের পক্ষ থেকে আলোচনার নেতৃত্ব দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি তাতে অংশ নিয়েছি, কিন্তু এএনসির ইয়ুথ লিগে যোগদানের আগে পর্যন্ত আমি কোনো সভায় কথা বলিনি। তার পরও আমি যথেষ্টই নার্ভাস ছিলাম। সত্যিই খুব নার্ভাস ছিলাম।
স্টেঙ্গেল : নার্ভাস, কেন? সেটা বিরাট কোনো পদক্ষেপ ছিল বলে, নাকি বিপজ্জনক ছিল বলে?
ম্যান্ডেলা : আপনি কি জানেন, আমি রাজনীতি বুঝতাম না? রাজনৈতিক দিক থেকে আমি পশ্চাৎপদ ছিলাম। আমি শুধু সেসব লোকের সঙ্গেই কথা বলতাম, যাঁরা রাজনীতি বুঝতেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় আর দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরে কী ঘটছে, সেসব বিষয়েও তাঁরা বলতে পারতেন। তাঁদের কারও কারও কেবল চতুর্থ মান পর্যন্ত শিক্ষা ছিল, অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল খুবই কম, কিন্তু তাঁরা আমার চেয়ে অনেক বেশি জানতেন।...ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি স্নাতক পর্যায়ে ইতিহাসের দুটি কোর্স করেছি, খুবই গভীরভাবে পড়েছি আফ্রিকার ইতিহাস, ইউরোপের ইতিহাসও পড়েছি। কিন্তু আমি যা জনতাম, গাউর রাদেবে১১ জানতেন তার চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, তাঁর শুধু তথ্যই জানা ছিল না, তথ্যের পেছনের সত্যটাও তিনি জানতেন। তাই তিনি যেকোনো দৃষ্টিভঙ্গির কারণও ব্যাখ্যা করতে পারতেন। আমি সবে ইতিহাস পড়েছি আর তখনই তাঁদের অনেকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল। আপনি জানেন, মাইকেল হারমেলের কয়েকটা এমএ ডিগ্রি ছিল, রাস্টি বার্নস্টাইন১২ উইটওয়াটারস্ট্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ করেছিল—এঁরাও ইতিহাস বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখতেন। আমি অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলাম না, তবু খুব মনোযোগ দিয়ে তাঁদের কথা শুনতাম। তাঁদের কথা শোনার অভিজ্ঞতা সত্যিই আকর্ষণীয় ছিল।
স্টেঙ্গেল : আপনি প্রথম কখন কমিউনিস্ট পার্টিতে গিয়েছিলেন, তখন কি আপনি কমিউনিস্টবিরোধী ছিলেন?
ম্যান্ডেলা : হ্যাঁ, তখন আমি কমিউনিস্টবিরোধী ছিলাম।
স্টেঙ্গেল : তাহলে যখন আপনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যেতে শুরু করেছিলেন, তখনকার অভিজ্ঞতা কি আপনাকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলেনি?
ম্যান্ডেলা : না, না, মোটেই না। আমাকে আমন্ত্রণ করা হতো বলেই আমি যেতাম। পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে আমার আকর্ষণ ছিল। সেটা ছিল একটা নতুন সমাজ—ইউরোপীয়, ভারতীয় ও আফ্রিকানসহ সব মানুষই সেখানে একত্র হতো। বিষয়টি আমার কাছে নতুন লাগত। এমনটা আমি আগে কখনো জানতাম না। এটিই ছিল আমার আকর্ষণের প্রধান কারণ।
স্টেঙ্গেল : রাজনীতির চেয়ে সামাজিক পর্যবেক্ষণের দিকেই আপনার আকর্ষণ বেশি ছিল।
ম্যান্ডেলা : আসলে রাজনীতিতে আমার কোনো উৎসাহই ছিল না। আমার আকর্ষণ ছিল, হ্যাঁ, আপনি যেমনটি লক্ষ করেছেন, সামাজিক অনুষঙ্গের দিকেই।...কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের দ্বারা আমি প্রভাবিত হয়েছিলাম। সাদা মানুষেরা বর্ণবাদী চেতনা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করছেন, এটা সত্যিই...আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা ছিল।
স্টেঙ্গেল : এটা কি কোনোভাবে মুক্তির চেতনা সঞ্চার করছিল, নাকি উন্মত্ততা?
ম্যান্ডেলা : না, সেটা আকর্ষণীয় ছিল। আমি বলব না যে বিষয়টি মুক্তির চেতনা সঞ্চার করছিল। তাই রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার পর, আপনি জেনে থাকবেন, আমি কমিউনিস্টদেরও আক্রমণ করতাম। আমি তখনকার ঘটনাবলিকে কোনোভাবেই মুক্তির চেতনাসঞ্চারী বলে মনে করিনি। আমি মনে করতাম, মার্ক্সবাদী চিন্তাই আমাদের বিদেশি আদর্শে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা
প্রতিবাদ
একটি ছোট্ট আইন লঙ্ঘনের দায়ে আমাকে এক দিনের আটকাদেশ দেওয়া হয়েছিল। না, সারা দিনের জন্য নয়। সকালে আটক করে বিকেলে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।...আমি আইন মানতে চাইনি বলে যে আমাকে আটক করা হয়েছিল তা নয়। আমাকে আটক করা হয়েছিল, আপনারা যাকে বলেন কেবল শ্বেতাঙ্গদের শৌচাগারে, সেখানে প্রস্রাব করতে গিয়েছিলাম বলে। কথাটি এভাবেও বলা যেতে পারে, শ্বেতাঙ্গদের শৌচাগারে হাত ধুতে গিয়েছিলাম বলে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমার দিক থেকে এটা ছিল ভুল। আমি সেখানকার লেখাটি পড়িনি। তো তারা আমাকে গ্রেপ্তার করে একটি থানায় নিয়ে যায়, কিন্তু দিনশেষে ছেড়ে দেয়। এখন কিন্তু লোকেরা আইনকে অন্যায় মনে করে তার বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করেই জেলে যাচ্ছে। ছাত্ররা, যারা আমার সহকর্মী ছিল, তারা নিজেদের দেশকে ও তার মানুষকে ভালোবাসে বলেই আইন অমান্য করে শ্রেণীকক্ষের বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। এটা আমাকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করেছিল।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা
আপোস করে মুক্তি নয়
মনে হচ্ছে, তোমার ও সরকারের অভিপ্রায় হচ্ছে উমতাতায়১৩ পাঠিয়ে দিয়ে কয়েকজন সহকর্মীসহ আমাকে মুক্তি দেওয়া হোক। সম্ভবত তোমাকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, তুমি যখন ১৯৭৭ সালে প্রথম আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতে চেয়েছিলে, তখন আমার সহকর্মীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, বান্টুস্তান পরিকল্পনার বাস্তবায়নে তোমার ভূমিকার কারণেই তোমার অনুরোধ১৪ রক্ষা করা সম্ভব নয়। আবার এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে যখন আমাদের মুক্তির ব্যাপারে আলোচনার জন্য আসতে চেয়েছিলে, তখনো আমরা অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে জানিয়েছিলাম যে, তোমার পরিকল্পনাটি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বিশেষত আমরা সুনির্দিষ্টভাবেই উল্লেখ করেছিলাম যে, আমাদের মুক্তির প্রসঙ্গটিকে বান্টুস্তান পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগটি সম্পূর্ণ ও দুঃখজনকভাবে অগ্রহণযোগ্য।
রাজনৈতিক বন্দীদের বিষয়ে তোমার দুর্ভাবনার দিকটিকে প্রশংসা করার পাশাপাশি তোমাকে অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দেব যে, আমরা পরিষ্কারভাবে বিরোধিতা করা সত্ত্বেও তুমি নিরবচ্ছিন্নভাবেই আমাদের মুক্তির বিষয়টিকে বান্টুস্তান পরিকল্পনার সঙ্গে সংযুক্ত করে অগ্রসর হচ্ছ। এটি উসকানিমূলক না হলেও অবশ্যই বিরক্তিকর। আমরা অনুরোধ করছি, তোমাকে এ পরিকল্পনা ত্যাগ করতেই হবে, নইলে তোমার সঙ্গে আমাদের অপ্রীতিকর সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। আমরা কোনো অবস্থাতেই ট্রানস্কি বা অন্য কোনো বান্টুস্তানে মুক্তি পেতে চাই না।
তুমি ভালোভাবেই জানো, আমরা আমাদের জীবনের শেষাংশ কারাগারেই কাটিয়ে চলেছি, কারণ, আমরা পৃথক উন্নয়ন পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিরোধী। আমরা মনে করি, এমন উদ্যোগ আমাদের স্বদেশেই পরবাসী করে ফেলবে এবং সরকার সেদিন থেকেই আমাদের প্রতি নির্যাতন শুরু করতে পারবে। এ জন্যই আমরা তোমাকে অনুরোধ করছি, এমন বিস্ফোরক পরিকল্পনাটি থেকে তুমি বিরত হও। আমি আন্তরিকভাবে আশা করব, এটাই হবে শেষবারের মতো, ভবিষ্যতে তুমি এ বিষয়ে আর আমাদের বিরক্ত করবে না।
উইনি ম্যান্ডেলাকে ২৭ ডিসেম্বর ১৯৮৪-এ লেখা চিঠি
কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গিনী
স্টেঙ্গেল: ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব কেমন ছিল?
ম্যান্ডেলা : জোহানেসবার্গ ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলোর মেলামেশার সুযোগ করে দিয়েছিল।...এটি ছিল শহরের এমন একটি জায়গা, যেখানে মানুষেরা একত্র হয়ে মতবিনিময় করতে পারত। আগন্তুকদেরও সেখানে আমন্ত্রণ জানানো যেত।...সেখানে খাবার পরিবেশন করা হতো, খেলাধুলা, বিতর্ক—বহু কিছুর ব্যবস্থা ছিল। সামাজিক অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবেও জায়গাটা ব্যবহার করা হতো। একসময় এক আমেরিকান ভদ্রলোক এসেছিলেন—দুজন মার্কিন অভিনেতাও এসেছিলেন: কানাডা লি, আরেকজন তো এখন অনেক বড় মাপের অভিনেতা, সিডনি পটিয়ের। আমরা তাঁদের সেখানেই আপ্যায়ন করেছিলাম। ক্লাবটি সত্যিই খুব আকর্ষণীয় ছিল। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে একত্রে পাওয়া সম্ভব, তেমন বিরল স্থানগুলোর মধ্যে সে সময় এটি ছিল একটি।
স্টেঙ্গেল : ক্লাবটি কি শহরেই ছিল? এর অবস্থান ঠিক কোথায় ছিল?
ম্যান্ডেলা : হ্যাঁ, একটু দূরে ছিল, পশ্চিমের দিকে...
স্টেঙ্গেল : আপনি সেই ক্লাবের সেক্রেটারি হয়েছিলেন?
ম্যান্ডেলা : হ্যাঁ, আমি সেক্রেটারি হয়েছিলাম।
স্টেঙ্গেল : সেখানে আরও একজন ছিলেন, যিনি, আমার ধারণা, আপনার পরে সেক্রেটারি হয়েছিলেন, যাঁর সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব ছিল—গর্ডন গুজ।
ম্যান্ডেলা : গর্ডন গুজ, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন।
স্টেঙ্গেল : আপনি তখন মানুষজনের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশা শুরু করেছিলেন।
ম্যান্ডেলা : হ্যাঁ, গর্ডন একজন ইংরেজ ভদ্রলোক, ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলেন, খুবই ধার্মিক। একটি ইহুদি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন—উরসুলা। মেয়েঠি অন্ধ হলেও খুবই সক্ষম ছিলেন। এখন শিক্ষকতা করেন। জেল থেকে মুক্তি পেলে আমি তাঁদের দেখতে যেতাম।...একদিন বিকেল পাঁচটার দিকে স্ত্রীকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য গর্ডনের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না, তিনি আমাকেই কাজটি করতে বললেন। তাঁর কাজের জায়গাটি ছিল এখান থেকে কয়েক ব্লক দূরে কমিশনার স্ট্রিটে। আমি সেখানে গিয়ে তাঁকে পেয়ে গেলাম। তিনি অন্ধ ছিলেন বলে আমার বাহুতে হাত রাখলেন। আমি তাঁকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। সেদিন তো সাদারা আমাকে প্রায় মেরেই ফেলছিল। তিনি সুন্দরী ছিলেন।...এক কৃষ্ণাঙ্গ এক শ্বেতাঙ্গিনীর হাত ধরে ওভাবে পথ চলছে? ওহ্, সেদিন ওরা আমাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল। কিন্তু আমিও ভান করতে পারি,..যে আমি খুবই সাহসী। আমি এমন ভান করলাম যেন সারা দুনিয়াকে মেরে তাড়িয়ে দিতে পারি। আমি তাদের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখালাম। এভাবেই এসে গাড়িতে উঠেছিলাম। পরে যখন আত্মগোপন অবস্থায় ছিলাম, তখন তাঁদের সঙ্গে প্রচুর সময় কাটিয়েছি। আমি যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে তাঁদের বাসাটা বিশেষ দূরে ছিল না। বিকেলের দিকে আমি তাঁদের বাসায় যেতাম।
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে আলাপচারিতা
দ্বিতীয় কিস্তি পড়ুন: বিচারককে নার্ভাস লাগছিল, বোঝা যাচ্ছে তিনি মৃত্যুদণ্ডই ঘোষণা করতে যাচ্ছেন